শুক্রবার, ২৩ মে, ২০১৪

র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পটভূমি আর বিলুপ্তির দাবি এক নয়


১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি দলের অনৈক্যের সুযোগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো। তাদের এই সময়ে লক্ষ্মীপুরের পৌরসভার চেয়ারম্যান আবু তাহের, ফেনীর এমপি জয়নাল হাজারী, নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমান, ঢাকার এমপি ডা. ইকবাল, এমপি কামাল মজুমদার, এমপি হাজী সেলিম, বরিশালের জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এমপি, খুলনা-বাগেরহাটের শেখ হেলাল এমপি, সিলেটে মহিবুর রহমান মানিক এমপি (বোমা মানিক), মোমেনশাহীতে গোলন্দাজসহ অসংখ্য গডফাদার তৈরি হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের ৫ বছরে দেশে অন্তত ৫০ হাজার লোক ‘গডফাদারদের’ হাতে নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২ হাজার ৯২৫টি।  শেখ হাসিনা (১৯৯৬-২০০১) নিজে ক্ষমতায় থেকে একটা লাশের পরিবর্তে দশটি লাশ চেয়েছেন এবং ক্ষমতা হারানোর পর দলীয় নেতা-কর্মীদের বলেছেন, তারা যেন সরকারি ক্যাডারদের হাত পা ভেঙে দেয়।
শেখ হাসিনার বান্ধবীর ছেলে রাজধানীতে সায়েম ও মহসীনকে হত্যা করে ১২ টুকরো করে নৃশংসতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এমপি ইকবাল বিরোধী দলের মিছিলে গুলি করে পুলিশ ও জনগণকে হত্যার পরও বিচার হয়নি। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করে। শেখ হাসিনা একটি গরীব দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ৫২টি দেশে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সফর করে ৬০,৮৮,৯১,৩৩৩ কোটি টাকা ব্যয় করেন।
 ২৩ জুন ১৯৯৬ আওয়ামী মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে নোয়াখালীর মাইজদীতে ছাত্রদল নেতা জাফরুল্লাহ সুমনকে আওয়ামী লীগের ‘গডফাদাররা’ কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সাতক্ষীরায় সাপ্তাহিক পত্রদূত পত্রিকার সম্পাদক আলহাজ্ব স.ম আলাউদ্দিন, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপায় মোসলেম কাজল, জিয়া, চট্টগ্রাম এমইএইচ কলেজের ছাত্র ইয়ার মোহাম্মদ, যশোর ইউপি মেম্বার ডাক্তার ইজ্জত আলী, ঢাকার লালবাগে এরশাদুল হক, কেরাণীগঞ্জে ইউপি চেয়ারম্যান তরিক উল্লাহ, জিয়াউর রহমান, সবুজবাগে রবিউল, নারায়ণগঞ্জে রুবেল, ডেমরায় আনোয়ারা বেগম, তেজগাঁও এলাকায় আমির হোসেন রানা, বরিশালের বাংলা বাজারে দোকানদার ধনু মিয়া, গাজীপুরে আমান উল্লাহ, যশোরের সাজিয়ালী গ্রামে আব্দুল জলিল ও আনিসুর রহমান, রমনায় আনিসুর রহমান, পটুয়াখালীর গলাচিপায় নুরু মুন্সী, বাগেরহাটের রামপাশেল কবির, ময়মনসিংহে নাজমুল ইসলাম নাজু, সবুজবাগে আয়নাল হক, ডেমরায় মামুন, ফজলুল হক, মিরপুরে ফারুক হোসেন, টঙ্গীতে ইলিয়াস আহমদ, লালবাগে মাকসুদ, রমনায় রুহুল আমীন, তেজগাঁওয়ে সৈয়দ সাদেকুর রহমান, পল্লবীতে নাহিদ খান পলাশ, জোহরা বেগম ও মিজানুর রহমান, রমনা থানা এলাকায় সৈয়দ শফিকুল হক খোকন, মতিঝিল থানা এলাকায় ডলি, সবুজবাগে মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যুগ্ম সচিব নিকুঞ্জ বিহারী, আজিমপুর কোয়ার্টারে কলেজ ছাত্র ও সিনিয়র সহকারী সচিব পুত্র ফয়সাল, মোহাম্মদপুরে কলেজ ছাত্র হিমেল, সুজন, পলাশ, ইউনুস, ফরিদ, দু’ভাই জুয়েল ও রিবেল, বাড্ডার খিলক্ষেতে দু’বন্ধু টিপু-ইমরান, গুলশানের রসুলবাগে তিন বন্ধু রাসেল-সেলিম-বাবর, লালবাগে মুরাদ, ডেমরার ইকবাল, সূত্রাপুরে এডভোকেট হাবিবুর রহমান মই-ল, মাইকেল, সেন্টু, ফারুক, শ্যামপুরে ব্যবসায়ী সুমন, দুলাল, সেলিম যশোর দৈনিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল, দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক শামসুর রহমান, উদীচী হত্যাকা-, কুষ্টিয়ার জাসদ নেতা কাজী আরেফসহ ৬ জন, খুলনার মেয়র প্রার্থী আব্দুর রব, চট্টগ্রামে ৮ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী, বনানীর ব্যবসায়ী শিপু, রমনা কলেজ ছাত্রী বুশরা ফুল, বাগেরহাটে এডভোকেট কালিদা রায় প্রমুখ।
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে বাংলাদেশকে এক মৃত্যুর উপত্যকার সঙ্গে তুলনা করা হয়। রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, ‘এ যেন এক মৃত্যুর উপত্যকা। কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই। গণতন্ত্র আছে, সংসদ আছে, সর্বোচ্চ আদালত কাজ করছে। অথচ মানুষ দেখছে তারা নিরাপদ নয়।’
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ প্রদত্ত রিপোর্টে ১৯৯৮ সালে শিউরে ওঠার মতো মানবাধিকার লংঘনের অনেক চিত্র প্রকাশ করা হয়। এ সময় পুলিশ হেফাজতে খুন হয়েছে ৬০ জন। এ ছাড়া সরকারিভাবে রাজনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন ঘটনায় ৩২ বার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, এসিড নিক্ষেপ, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন-সবদিক থেকেই ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার লংঘনের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। পুলিশ কোর্ট ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর ব্যাপকতা সম্পর্কে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রীয় কাঠামোই মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার সংবিধানে গ্যারান্টিকে পদদলিত করেছে। ১৯৯৮ এর মাঝামাঝি রাজধানীতে দুই তরুণ অরুণ ও রুবেলের মৃত্যু সমাজের বিবেকবান মানুষ ও গণমাধ্যমকে নাড়া দেয়। কিন্তু বহুল আলোচিত এই দুই মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব নিয়ে কোনো ফয়সালা হয়নি।’
১৯৯৮-এ রাজনৈতিক নির্যাতন ও নিপীড়ন সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়, ‘প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর রাজনৈতিক হযরানি, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের শ’ শ’ নেতা-কর্মীর নামে বিভিন্ন মামলা দায়ের, হয়রানি ও গ্রেফতার করা হয়। ৭ নবেম্বর টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে পল্টন ময়দানে বিএনপির জনসভা প-, ৯ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখী লংমার্চে বাধা দান এবং সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে জামা-কাপড় খুলে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় সূর্যের দিকে মুখ দিয়ে বসিয়ে রাখার ঘটনা।’
১৯৯৮ সালে রাজধানী ছিল অপরাধীদের অবাধ অঞ্চল। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজির ঘটনা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। নাগরিক জীবন অস্ত্রবাজ-সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়েছিল। পাড়া-মহল্লায় শাসক দলের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনী গড়ে ওঠে। উল্লিখিত সময়ে রাজধানীর থানাগুলোতে ১৮ হাজার অপরাধ পুলিশ রেকর্ড করে। এর মধ্যে নির্যাতনের অপরাধ রয়েছে ৫৩৩টি। এ বছর গড়ে প্রতিমাসে ২২ জন নিহত হয়। নির্মম হত্যার সর্বশেষ শিকার হয় তেজগাঁও থানার শাহীনবাগে মেধাবী ছাত্র আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী। ৯ মার্চ যাত্রাবাড়ী সন্ত্রাসীদের ছোরার আঘাতে দু’কিশোর উজ্জ্বল ও তৌহিদ নিহত হয়। ১০ মার্চ পল্লবীতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপি কর্মী আলমগীরকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করে। ১৪ মার্চ গুলশানে সুমন, ১৫ মার্চ সূত্রাপুর শ্রমিক নেতা গাজী লিয়াকত ওরফে কালা লিয়াকত, ১৬ মার্চ ডেমরায় হযরত আলী, ১৭ মার্চ বনানীতে নৈশপ্রহরী শেখ জামাল ও জহির খুন হয়।
২৪ মার্চ সবুজবাগের গোড়ানে মামুন সরোয়ার, দীপু, ২৫ মার্চ শান্তিনগর বাজারে ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন, ৩০ মার্চ গুলশানে শিল্পপতি লতিফুর রহমানের মেয়ে শাজনীন তাসনীম, ১ এপ্রিল মতিঝিলে ব্রাদার্স ক্লাব কর্মকর্তা আসলাম সরকার খুন হয়। ২২ মে রাতে গুলশানের রামপুরা ওমর আলী লেনে ফজলুল হককে কুপিয়ে-গুলি করে খুন করা হয়। ২ জুন রাতে ডেমরার কোনাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির দু’জন কনস্টেবল আসাদুজ্জামান ও নূর হোসেনকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা ২টি রাইফেল এবং ১০ রাউন্ড গুলি লুট করে পালিয়ে যায়।
১ জুন তেজগাঁও থানা অদূরে সকালে সৈয়দ সাদেকুর রহমান মাসুমকে গুলী করে খুন, ২ জুন রাতে আইন, বিচার সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এটিএম মুসার ৪/২০, হুমায়ুন রোড, মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে একটি রিভলবার, ২৯ হাজার টাকা, সোনার অলংকার ডাকাতি হয়। ৪ জুন মালিবাগ অভিযাত্রিক ক্লাবের সামনে সৈয়দ শফিকুল হক খোকন, লালবাগে  শিশু পিংকি ও রাজা, ৭ জুন বিকেলে ডেমরার জুরাইনে সেলিনা আক্তারকে তিন যুবক ধর্ষণ করে। ১০ জুন রাতে দক্ষিণ বাড্ডায় সিরাজ সরদারকে পিটিয়ে হত্যা, এদিনই সহকারী কর কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনের ৩০/২ চামেলীবাগের বাসায় সকালে ডাকাতি হয়।
১৭ জুন মতিঝিলের ৩২৬/১, গুলবাগের বাসায় গৃহকত্রী নিলুফা আজিজ গৃহপরিচারিকা ডলিকে পিটিয়ে, ২৯ জুন সূত্রাপুরের হাটখোলায় পুলিশের গুলিতে হাতকাটা বাবু, ২২ জুন সন্ধ্যায় শেওড়াপাড়া এলাকায় স্বামীকে বেঁধে রেখে ৯/১০ জন দুর্বৃত্ত স্ত্রী আসিয়া বেগমকে গণধর্ষণ করে। ২৩ জুন লালবাগের সোয়ারীঘাটে পিঠা বিক্রেতা মাকসুদকে খুন করা হয়। ২৪ জুন সবুজবাগের মানিকনগর খালপাড়া মামুনকে, ২৫ জুন তেজগাঁও থানার দুধ ফ্যাক্টরীর মাঠে প্রেমিক বাবুলের হাতে জামেলী খুন হয়। ২৮ জুন রাতে গুলশানের বাগিচার টেকে নানী বকুল বেগম এবং নাতনী মুর্শিদাকে ধর্ষণ করা হয়।
২৮ জুন রাত ১০টায় মিরপুরে ফারুক হোসেন গীটার খুন হয়। ২ জুলাই বাড্ডা সোনালী ব্যাংকে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে এবং মতিঝিলের উত্তর কমলাপুরে শিশু নাইমকে জবাই করে, ১৩ জুলাই কতোয়ালী থানা এলাকায় শাহজাহান, শাহ আলম এবং নাককাটা বাবুল, ২৯ আগস্ট ডেমরার পূর্ব জুরাইনে আব্দুর রব ও বাবুল, ২৭ সেপ্টেম্বর মধুবাজারে এডভোকেট সাহিদাকে খুন করা হয়। ২১ নবেম্বর মরিপুর কনসার্ট দেখতে গিয়ে দুই কলেজ ছাত্র আক্তার ও রিমন, ৩০ নবেম্বর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ডাবলু, ১৭ ডিসেম্বর রাতে বনানীতে নিহত হন চিত্র নায়ক সোহেল চৌধুরী।
২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের প্রথম দিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতির মুখে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় যখন ‘অপারেশন ক্লীন হার্ট’ তৈরি হয় এবং সে পর্যায়ে নির্ধারিত সাফল্যের আস্থা থেকে তৎকালীন সরকার ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ পুলিশের অঙ্গ হিসেবে র‌্যাব প্রতিষ্ঠা করে। শুধু পুলিশে নয় সামরিক বাহিনী, বিজিবি ও আনসারও এর অঙ্গীভূত থাকে। এর কাঠামোগত দিক অনেকটা জটিল। তবে এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের রশিটি থাকে পুলিশ প্রধানের (আইজিপি) হাতে। র‌্যাবের নেতৃত্বটি কার্যত সামরিক অফিসাররাই পরিচালিত করেন। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা কার্যক্রমে তাদের কার্যক্রম নন্দিত ও নিন্দিত দু’রকমই বলা যায়।
পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে অভিযান পরিচালনা পর্যন্ত প্রথম থেকেই র‌্যাব নানা বিতর্কের মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে বিচার বহির্ভূত প্রশ্নবিদ্ধ হত্যাকা--যা আগে এদেশের মানুষ জানত না। তবে কিছু ক্ষেত্রে সুনামও করেছে। বিশেষ করে জঙ্গী দমনে তারা পালন করে দায়িত্বপূর্ণ ও দক্ষ পেশাদারী ভূমিকা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ও সন্ত্রাস দমনে র‌্যাব-এর ব্যাপক সাফল্যে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মনেই র‌্যাব নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে দাড়ায়। মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে অপরাধ দমনে র‌্যাবের বিস্ময়কর এই সাফল্যে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে র‌্যাব সবচেয়ে আস্থাভাজন ও প্রিয় সংস্থায় পরিণত হয়।
 কালো পোশাকধারী এই বাহিনী দেখামাত্রই সাধারণ মানুষ সব ভয়ভীতি ভুলে সাহসে বলিয়ান হয়ে উঠে। দ্রুত অবনতিশীল দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন জনগণ র‌্যাবের কারণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পার্শ্ববর্তী দেশ ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশেই বিশেষায়িত বাহিনীগুলো সরাসরি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। তবে প্রয়োজনে তারা যুগপৎভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। যেমন ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (র্লাক ক্যাটস), জার্মানির জিএসজি-নাইন এবং ইটালির ক্যারাবিনিয়েরি-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জোট সরকারের আমলে সন্ত্রাসী ধরতে গেলে র‌্যাবের সাথে সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধে সন্ত্রাসী নিহত হলে তাদের জন্য মায়াকান্না করা হয়েছে। তখন সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল, ‘সন্ত্রাসীদের প্রতি এত দরদ কেন?’ পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষকে এতই পীড়া দিয়েছিল যার কারণে ‘মানবাধিকার’ শব্দটি পদদলিত করে র‌্যাবের কার্যক্রমকে মানুষ সাধুবাদ জানিয়েছিল।
 আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের লোকজনকে মেরে ফেলা হচ্ছে। তখন যারা নিহতের তালিকায় ছিলেন তারা বাংলাদেশের নামকরা সন্ত্রাসী ছিলেন। তাহলে কি এসব চিহ্নিত, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাথে আওয়ামী লীগের যোগসাজশ রয়েছে? তাদের পৃষ্ঠপোষক কে? তাদের গডফাদার কে? তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কারা?
তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, র‌্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে মানবাধিকারের কোন সম্পর্ক নেই। অপরাধীকে পাকড়াও করতে গেলে যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়, আর আত্মরক্ষার্থে তারা পাল্টা আঘাত হানলে, তার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না।
তৎকালীন জোট সরকার র‌্যাবের ক্রসফায়ার সম্পর্কে অবগত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও সেটা ভালোভাবেই জানতেন। তিনিসহ তাঁর সরকারের মন্ত্রীরা ক্রসফায়ারের ব্যাপারে নিজেদের সন্তোষ গোপন করার চেষ্টা করতেন না বলে মার্কিন দূতাবাসের একাধিক গোপনীয় তারবার্তা থেকে জানা যায়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসকে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তিরা সবাই সন্ত্রাসী ও অপরাধী। তিনি (মওদুদ) বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বড় ধরনের পদক্ষেপ হিসেবে র‌্যাবের কর্মকা-কে বাংলাদেশের জনগণ স্বাগত জানায়।’
র‌্যাব প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৩ আগস্ট চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ শামাস তাঁর সদর দপ্তরে পাঠানো ‘র‌্যাবের বর্ষপূর্তি বিশ্লেষণ’ শিরোনামে একটি গোপনীয় তারবার্তায় লেখেন, ‘র‌্যাবের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ক্রসফায়ারে হত্যাকা-ের ঘটনাগুলোকে কুখ্যাত অপরাধীদের দমন করার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ ও জনপ্রিয় পদক্ষেপ বলে সমর্থন করে সেগুলোকে সংগত বলে দাবি করে এসেছেন। র‌্যাব আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ক্রসফায়ার চালায় অথবা ক্রসফায়ারের শিকার ব্যক্তিরা এমন অপরাধী, যাদের ওই পরিণতিই প্রাপ্য-সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে যাঁরা আমাদের এ ধরনের কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেনঃ প্রধানমন্ত্রী (খালেদা জিয়া), স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (বাবর), আইনমন্ত্রী (মওদুদ) ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী (মোরশেদ খান)।’ (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ১৪ মে ২০১৪)
র‌্যাবের জনপ্রিয়তা মার্কিন দূতাবাস লক্ষ্য করলেও ‘ক্রসফায়ার’সহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রবল বিরোধিতা করেছে একদম শুরু থেকেই। এ কারণে র‌্যাব গঠনের পর অন্তত চার বছর পেরিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থার সঙ্গে কোনো রকম সহযোগিতামূলক কাজ করেনি। মার্কিন দূতাবাস যখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রশ্নটি তুলত, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হতো যে এটা একটা জরুরি স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা (নেসেসারি শর্ট-টার্ম এক্সপিডিয়েন্ট)। সন্ত্রাস ও অপরাধবৃত্তি এমনই গুরুতর এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে যে তা সমাধানের আশু পদক্ষেপ হিসেবে ক্রসফায়ারের সুযোগ সরকারকে নিতে হচ্ছে। কিন্তু এটা স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়।
কিন্তু এই জরুরি স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে চলেছে এবং তার বিপদ কী হতে পারে, সেটা মার্কিন দূতাবাস আগেই জানত। তাই এক বছর না পেরোতেই র‌্যাবের ক্ষমতার অপব্যবহারের কয়েকটি গুরুতর ঘটনা ঘটলে তারা মোটেও অবাক হয়নি। ‘র‌্যাবের বর্ষপূর্তি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গোপনীয় তারবার্তার এক জায়গায় জুডিথ শামাস লিখেছেন, ‘র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-গুলোর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রায় প্রকাশ্য অনুমোদনের ফলে র‌্যাবের সদস্যদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, কোনো পদক্ষেপের জন্য তাঁদের শাস্তির ঝুঁকি নেই। এর ফলে ক্ষমতার অপব্যবহারের কয়েকটি গুরুতর ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।’
প্রকৃতপক্ষে যারা বিষয়টিকে তৎকালীন সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তারা রাজনীতিকে সন্ত্রাসকবলিত রাখার পক্ষে অবস্থান নিলেও দেশবাসী এই অবস্থান সমর্থন করেনি, কেননা তারা সন্ত্রাসের নির্মূল দেখতে চান এবং সমাজে শান্তি ও স্বস্তির পূর্ণ প্রতিষ্ঠা কামনা করেন।
২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠক র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, র‌্যাব কেবল সন্ত্রাস দমনের জন্যই অভিযান চালাবে। এটাই তার সুনির্দিষ্ট কাজও নীতিমালা। এর বাইরে র‌্যাব যাবে না, যেতে পারে না। ২১ অক্টোবর প্রকাশিত খবরে বলা হয় যে, র‌্যাব তার কর্ম পরিধির বাইরে কোন অভিযান চালাবে না। র‌্যাবের সদর দফতর থেকে সাতটি ব্যাটেলিয়ানে এ মর্মে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, নির্দিষ্ট কর্মপরিধির বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ছাড়া র‌্যাব কোন অভিযান চালাতে পারবে না। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে এবং সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাদের পক্ষ থেকেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ দাবি জানানো হয়, ‘র‌্যাবকে ধারালো রাখতে হবে, সস্তা কাজে ব্যবহার করে ভোঁতা করা চলবে না’।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর দৈনিক আমার দেশের সংবাদে বলা হয়, ‘র‌্যাবকে দাগি অপরাধী এবং রাঘববোয়ালদের গ্রেফতারে আরো বেশি তৎপর হওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। সরকারি নীতি নির্ধারক মহল র‌্যাবের কমান্ডার, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের তড়িঘড়ি করে এ্যাকশনে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, এফবিআইয়ের স্টাইলে আগে তদন্ত করে নিশ্চিত হওয়ার পরে এ্যাকশনে যাও। ক্রসফায়ারের ঘটনাও যাতে কম ঘটে এ ব্যাপারে কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি র‌্যাবের কমান্ডিং অফিসারদের ধীরে চলার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপে জনগণ খুশি হবে; কিন্তু একজন নিরীহ মানুষের ক্ষতি জনসাধারণ মেনে নেবে না।
দেশব্যাপী নাশকতামূলক তৎপরতার কারণে র‌্যাবকে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর এলিট ফোর্স হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে র‌্যাবের মহাপরিচালক এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করেন। তারা বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত যন্ত্রপাতি কেনার সিদ্ধান্ত নেন।  
(চলবে)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads