রবিবার, ১৮ মে, ২০১৪

শামীম ওসমান পরিবারের বিরামহীন কর্মকান্ড


আতঙ্কে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাঁটছে দেশবাসীর। অপহরণের পাশাপাশি চলছে খুন। অপহৃতদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদী ও বিভিন্ন স্থান থেকে। অপহরণের শীর্ষে নারায়ণগঞ্জ। তালিকায় রয়েছে শিশু থেকে আইনজীবী। নারায়ণগঞ্জ এখন কোলাহলমুখর কোনো জনপদ নয়। নীরব-নিথর মৃত্যুপুরী। লাশের পাশে স্বজনদের আহাজারি ও বুকফাঁটা আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু ঘাতকের সন্ধান মেলে না। তারা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান?
নারায়ণগঞ্জে কারা লাশ হচ্ছেন, সেটি জানা গেলেও কারা লাশ করছেন, সেটি কখনো জানা যাবে কি না-আমরা জানি না। জানে না নারায়ণগঞ্জের মানুষও। এ পর্যন্ত এই বন্দরনগরে এ ধরনের খুনের বিচারের নজির নেই। আসামী ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে যায়। খুনির পক্ষে নানা তদবির চলে। দোষ স্বীকার করার পরও অভিযুক্ত উচ্চ আদালতে জামিন পেয়ে যায়। তাই প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে, সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে-আদৌ হত্যাগুলোর বিচার হবে কি না? ঘাতকেরা শাস্তি পাবে কি না?
দেশের অন্যান্য স্থান থেকে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির চালচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাহলে নারায়ণগঞ্জে এসব গুম-খুন কারা করছে? আওয়ামী লীগের ভেতরেরই কোনো শক্তি বা অপশক্তি? মানবাধিকার কর্মীদের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নারায়ণগঞ্জের অবস্থা খুবই বেহাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতে মাদক ব্যবসা, ভূমি দখল, জোরজুলুম ও নারীদের হয়রানির কারণে এই ধরনের খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন নতুন নতুন সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের আওতায় উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীরাই লাগামহীন অপরাধ ঘটিয়ে চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেই তারা অপহরণ ও গুমের পথ বেছে নিচ্ছে। (সূত্র : দৈনিক সংবাদ ৩ মে ২০১৪)
অপহরণের পরে মুক্তিপণ আদায়, পূর্বশত্রুতা ও তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অকালে জীবন দিতে হচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই নারায়ণগঞ্জে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। প্রায় প্রতিদিন শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে লাশ ভাসতে দেখা যায়। এককালের প্রাচ্যের ডান্ডি এখন গুম, খুন ও আতঙ্কের শহর। নদীতে ভাসছে লাশ আর তীরে স্বজনের আহাজারি। এমনকি অন্য এলাকায় খুন করে খুনিরা নারায়ণগঞ্জে ফেলে রেখে যায়। কেননা, এখানে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মিলে নারায়ণগঞ্জে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে। যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬-২০০১ সালে।
এসব গুম ও অপহরণের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জবাসী শঙ্কিত। রাস্তায়, হোটেলে, রেস্তোরাঁয়, সরকারি-বেসরকারি অফিসে সবাই শঙ্কিত। ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে টানা ২২ দিনের অসহযোগ আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জে সরকার ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বন্দুকযুদ্ধে ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন একটি করে লাশ পড়ে। ওই ঘটনার পর থেকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসাবে নারায়ণগঞ্জ দেশব্যাপী আলোচনায় উঠে আসে।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যবসায়ী ভুলু সাহার লাশ নিখোঁজের ২ দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়।
৬ মার্চ বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের শায়েস্তা খাঁ সড়কের বাসা থেকে সুধীজন পাঠাগারের উদ্দেশে বের হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনের নেতা রফিউর রাব্বির ছেলে মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী নিখোঁজ হয়। নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধেও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর রাব্বি। ৮ মার্চ সকালে শহরের চারারগোপে শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ত্বকী এ লেভেল পরীক্ষা দিলেও ফল প্রকাশের আগেই তাকে হত্যা করা হয়। লাশ উদ্ধারের দিনে প্রকাশিত ফলে সে রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে সারাদেশে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল।
মূলত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ ও বর্ধিত বাস ভাড়া কমানোর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব হওয়ায় রফিউর রাব্বির প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয় ওসমান পরিবার। মূলত রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করতেই তার নিরপরাধ মেধাবী কিশোর সন্তানকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
ত্বকী হত্যাকা-ের সময় রাজধানীসহ সারাদেশের তরুণ প্রজন্ম কাদের মোল্লার বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিল। শাহবাগে তারুণ্যের গণজোয়ার টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছিল। ওই সময় ব্লগার রাজীব হায়দারকে খুন করা হয়। এতে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। একই সময় ত্বকীকে অপহরণ করে খুন করা হয়। অনেকের ধারণা, হত্যার মোটিভ ভিন্ন দিকে নিতেই ত্বকীকে খুন করার জন্য এমন সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল।
এ ঘটনায় রফিউর রাব্বি ৬ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং ৮ মার্চ রাতে একই থানায় হত্যা মামলা করেন। এজাহারে আসামী হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা না হলেও তিনি অভিযোগ করেন, তার বর্তমান ও বিগত সময়ের নাগরিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ক্ষুব্ধ কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ত্বকীকে খুন করেছে। এর সপ্তাহ খানেক পর ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে তিনি একটি অবগতিপত্র দেন। এই তালিকায় আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত প্রচার সম্পাদক জহিরুল ইসলাম ভূইয়া ওরফে ক্যাঙ্গারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ওরফে সুজন, সহ-সভাপতি রাজীব দাস, অয়ন ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রিফাত বিন ওসমান, সালেহ রহমান ওরফে সীমান্তর নাম ছিল।
ত্বকী হত্যা নারায়ণগঞ্জের মানুষকে ব্যাপক নাড়া দেয়। লাশ উদ্ধারের পর পুরো নারায়ণগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে আসে। আন্দোলন, প্রতিবাদ নারায়ণগঞ্জের সীমানা পেরিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, যা এখনও চলমান। রফিউর রাব্বিকে আহ্বায়ক করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ। ত্বকী মঞ্চ ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে প্রতি মাসের ৬ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে হত্যাকা-ের বিচার দাবিতে চাষাড়া মোড়ে শহরের প্রধান শহীদ মিনার চত্বরে নানা কর্মসূচি পালন করছে। এসব কর্মসূচি থেকে ওসমান পরিবারের কাউকে দশম সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না দিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হলেও শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের ও নাসিম ওসমান (৩০ এপ্রিল ২০১৪ মারা গেছেন) জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
অন্যদিকে দেশের আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ত্বকী হত্যাকা- নিয়ে দুই শিবিরে বিভক্ত নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ। রীতিমতো মারমুখো অবস্থান নেয় মেয়র আইভী এবং নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি শামীম ওসমান ও জাপা এমপি নাসিম ওসমান। তাদের পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা বিবৃতিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ।
 অভিযোগের বিষয়ে শুরু থেকেই তিন ভাই শামীম, নাসিম ও সেলিম ওসমান সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন। শুরুতে তারা দাবি করেছিলেন, জামায়াত-শিবির ত্বকীকে খুন করেছে। তবে নাসিম ওসমান ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ নারায়ণগঞ্জে এক সমাবেশে মেয়র আইভীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ত্বকীকে হত্যার অভিযোগে শিগগির এক কালো মহিলা গ্রেপ্তার হবে।’
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে শামীম ওসমান চাষাড়া শহীদ মিনারে সমাবেশে বলেন, ‘ত্বকী হত্যা মামলায় আমাদের কিছুই হবে না।’(সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ৬ মার্চ ২০১৪)
ছেলেকে হারানোর পর রফিউর রাব্বি ফেসবুকে নানা ছবি ও নিজের কিছু লেখা নিয়মিত পোস্ট করছেন। এসব ছবি ও লেখার সবই ত্বকীর স্মৃতিবিজড়িত। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর ত্বকীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত বাবা ত্বকীর জন্মদিন উপলক্ষে ফেসবুকে একটি লেখা পোস্ট করেন। তা হলো-‘আজ তোমার জন্মদিনে কোনো কেক নয়, কালো গোলাপ পাঠালাম।’ ছেলেকে নিয়ে সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যান রফিউর। ওই সুখকর দিনের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘পেছনে অনন্ত ঢেউয়ের হাতছানি, তবু সাগর বেলায় হাঁটতে গিয়ে শেষ হয়ে গেল বেলা...।’
ত্বকী হত্যার এক বছর পূরণ হয়েছে ৬ মার্চ ২০১৪। আমাদের দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে যেকোনো খুনের আসামীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু এই সময়ে মামলার তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এ ঘটনায় পাঁচজন গ্রেপ্তার হলেও হত্যাকারী ও হত্যার নির্দেশদাতাদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
বিচারের দাবি রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। বরং হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের আস্ফালন আতঙ্কিত করে তুলেছে নিহতের পরিবার ও ত্বকী হত্যার প্রতিবাদকারীদের। নতুন খেলায় মেতে উঠেছে ঘাতক চক্র। ত্বকী হত্যাকা-কে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার মিশন নিয়ে তারা এখন সক্রিয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সন্ত্রাসী ক্যাঙ্গারু পারভেজ গুমের মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়েছে ত্বকী হত্যার বিচার দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীদের। রফিউর রাব্বি অভিযোগ করেন, ৮ জানুয়ারি ২০১৪ শামীম ওসমানের অনুগত ছাত্রলীগের বাধার কারণে শহীদ মিনারে ত্বকী মঞ্চের পূর্বঘোষিত আলোচনা সভা ও আলোক প্রজ্বলন অনুষ্ঠান করা যায়নি।
মামলাটি প্রথম তদন্ত করেন সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মঞ্জুর কাদের। হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে পুলিশ রিফাত, সীমান্ত (হাজি রিপনের ছেলে) ও নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটনকে গ্রেপ্তার করে। লিটন পরে জামিনে মুক্তি পান।
ত্বকী হত্যারহস্য উদ্ঘানে পুলিশের তদন্ত থমকে থাকায় বাদী রফিউর রাব্বি উচ্চ আদালতে মামলাটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের আবেদন করেন। ২০১৩ সালের ২৮ মে আদালত মামলাটির তদন্ত র‌্যাবে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন।
তদন্ত শুরু করে র‌্যাব প্রথমে গ্রেপ্তার করে ইতিপূর্বে জামিনে মুক্তি পাওয়া লিটনকে। মাদক মামলায় গ্রেপ্তার লিটন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ত্বকী হত্যা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য দেন। ওই জবানবন্দীর ভিত্তিতে র‌্যাব জুলাইয়ে জামতলায় সীমান্তর বাসায় অভিযান চালায়। ৭ আগস্ট র‌্যাব কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের নির্যাতনকেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে বস্তাভর্তি নাইলনের রশি, রক্তাক্ত জিনসের প্যান্ট, রক্তমাখা দুটি গজারির লাঠি উদ্ধার করে। দেয়াল ও শোকেসে অসংখ্য গুলীর আলামত জব্দ করা হয়।
ওই নির্যাতনকেন্দ্রে অভিযানের পর শামীম ওসমান বিভিন্ন সভা-সমাবেশে র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। ওই অভিযানের পরপর র‌্যাব-১১-এর পরিচালক লেঃ কর্নেল জাহাঙ্গীর আলমকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। এরপর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর।
ত্বকী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর আসামী সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ১২ নভেম্বর ২০১৩ নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এম এম মহিউদ্দিনের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তিনি আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তার মা মেহের নিগার মিতা জেলা জাতীয় মহিলা পার্টির সাবেক সভানেত্রী এবং সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
জবানবন্দীতে ভ্রমর বলেন, আজমেরী ওসমানের শহরের কলেজ রোডে অবস্থিত উইনার ফ্যাশন নামের টর্চার সেলে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ রাতে ত্বকীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আজমেরীর নেতৃত্বে হত্যাকা-ে কালাম, লিটন, রাজীব, মামুন, কাজল, শিপন, জ্যাকি ও লিটন অংশ নেয়। পরে আজমেরীর ড্রাইভার জামশেদ ও অন্যরা টয়োটা এক্স ফিল্ডার প্রাইভেট কারের পেছনে ত্বকীর লাশ তুলে চারার গোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। হত্যাকা- ও লাশ নদীতে ফেলার পুরো কার্যক্রমেই ভ্রমর উপস্থিত ছিলেন বলে আদালতকে জানান।
হত্যাকা-ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্তা অস্বীকার করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন শামীম ওসমান ও নাসিম ওসমান। এ নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি। বছর জুড়ে পাল্টাপাল্টি নানা কর্মসূচিও পালিত হয়। কিন্তু আদালতে দুই ঘাতকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবীন্দতে নারায়ণগঞ্জবাসী নিশ্চিত হয়, ত্বকী হত্যাকা-ের সঙ্গে ওসমান পরিবার জড়িত। অন্যদিকে ত্বকী হত্যার বিচার দাবিতে পরিবারের সঙ্গে সোচ্চার নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সর্বস্তরের মানুষ। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চও ঘোষণা দিয়েছে, ত্বকীসহ নারায়ণগঞ্জের সব হত্যাকা-ের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবেন না।
আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়া আসামী ভ্রমর জামিন প্রশ্নে ১৩ মার্চ ২০১৪ হাইকোর্টের দুই বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত ভ্রমরের ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। আদালতের আদেশনামায় স্বাক্ষর করা হয় ১৮ মার্চ। খুবই দ্রুততার সঙ্গে আদালতের জামিন আদেশনামার কপি নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে পৌঁছানো হয়। ২০ মার্চ বিকেল চারটায় কারাগার থেকে বেরিয়ে যান ভ্রমর। মুক্ত হওয়ার পর থেকে সে লাপাত্তা। র‌্যাবের তদন্তে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে ভ্রমরের নাম থাকার কথাও সাংবাদিকদের জানায় র‌্যাব।
মামলায় ভ্রমরই একমাত্র আসামী যিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামী সালেহ রহমান ওরফে সীমান্তকে ২০১৩ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছিলেন। জামিননামার আদেশের কপি জেলা কারাগারে পৌঁছার আগেই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগে উপস্থিত হয়ে জামিন বাতিলের আবেদন জানালে তা মঞ্জুর হয়।
আইনি বিধান না থাকলেও প্রচলিত নিয়ম আছে চাঞ্চল্যকর কোনো মামলার আসামীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলে সরকারি পিপি বা কোর্ট ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে পুলিশকে জানানো হয়। কিšুÍ ভ্রমরের বিষয়টি জানানো হয়েছে তার মুক্তি পাওয়ার অনেক পরে। (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ২৪ মার্চ ২০১৪)    
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে গ্রেপ্তার করা হয় সাইফুদ্দিন আহমেদ ওরফে জ্যাকিকে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১১)-এর সূত্র মতে, তদন্ত শেষ, এখন আদালতে চার্জশিট দাখিলের দিন গণনা চলছে। তবে আরেকটি সূত্র জানায়, অদৃশ্য হাতের ইশারায় আদালতে চার্জশিট দাখিল বিলম্ব হচ্ছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে মামলার তদন্ত কাজ মাঝপথে থামিয়ে দেয়ারও চেষ্টা চালানো হয়েছে। এখন চেষ্টা চলছে মামলার তদন্ত ও চার্জশিট দাখিলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার। (সূত্র : দৈনিক মানব জমিন ৬ মার্চ ২০১৪)
তদন্ত প্রক্রিয়া তদারকির সঙ্গে যুক্ত র‌্যাবের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ত্বকী হত্যার ঘটনায় নাসিমপুত্র আজমেরী ওসমানসহ অন্তত ১১ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। নাসিমপুত্রসহ ১১ জন ত্বকী হত্যায় জড়িত। তবে এই হত্যাকা-ের সঙ্গে শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানের জড়িত থাকার কোনো সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ এখনও মেলেনি।
এদিকে, নাসিম ওসমান এমপি এ হত্যাকা-ের সঙ্গে তার ছেলের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য ত্বকী হত্যার সঙ্গে ওসমান পরিবারকে জড়ানোর অপচেষ্টা চলছে।
এ ঘটনায় প্রভাবশালী অনেকের নাম আসায় তারা মামলার গতিপথ পাল্টাতে চেষ্টা-তদবির করতেই পারে বলে মন্তব্য করেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি মনে করেন, এসব অগ্রাহ্য করেই তদন্ত এগিয়ে চলছে। (সূত্র : দৈনিক সমকাল ৬ মার্চ ২০১৪)
আলোচিত এ মামলার তদন্তে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে র‌্যাব। তারা হলো- আজমেরী ওসমান, সুলতান শওকত ভ্রমর, ইউসুফ হোসেন লিটন, তায়েব উদ্দিন আহমেদ ওরফে জ্যাকি, কালাম শিকদার, কাজল, অপু, মামুন, রাজীব, শিপান ও জামশেদ। তাদের মধ্যে আজমেরী, রাজীব, মামুন, অপু, কাজল, শিপান ও জামশেদ পলাতক।
১৯ এপ্রিল ২০১৩ রাতে সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ঝাউগড়া এলাকার নিজ বাড়িতে খুন হয় পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের স্ত্রী, শ্যালক এবং বাড়ির ২ গৃহপরিচারিকা। ওই ঘটনায় শামীম আহমেদ নামে এক আসামী সোনারগাঁ থানায় নির্যাতনের কারণে নিহত হয়।
১৩ জুন ফতুল্লার দুর্গম চরাঞ্চল বক্তাবলী ইউনিয়নের চর রাধানগরে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে স্কুল ছাত্র ইমনকে নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ ৯ টুকরা করে ধঞ্চে ক্ষেতের পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়।
প্রেম সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ৩ জুলাই রূপগঞ্জের সিনহা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌসুমী আক্তারকে (১৮) পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। ৯ জুলাই ফতুল্লার পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র নাজমুল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২২ জুলাই আড়াইহাজারে স্কুল ছাত্র মাহাবুবকে হত্যার পর নাক ও কান কেটে নেয়ার পাশাপাশি চোখ উপড়ে ফেলা হয়। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর নিখোঁজ রয়েছেন যুবলীগ নেতা পারভেজ ও ব্যবসায়ী কালাম শিকদার। তাদেরকে এখনও পাওয়া যায়নি। (চলবে)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads