থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত সে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে সংবিধান লংঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। তার সাথে তার মন্ত্রিসভার আরো ৯ জন মন্ত্রীকে একই অভিযোগে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালত তার স্থলাভিষিক্তও ঘোষণা করেছেন এবং এর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে তার দায়িত্ব পালনের সম্ভাবনারও ইতি ঘটেছে।
থাইল্যান্ড আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ না হলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। কিন্তু দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে এই দেশটি রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কেন্দ্রভূমি হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে এসেছে। ২০০৬ সালে জেনারেল থাকসিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস ও স্বৈরাচারী আচরণ প্রভৃতি কারণে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। পরবর্তীকালে তারই বোন ইংলাক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু দেখা যায় যে দলীয়করণ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং বিরোধী দল নির্যাতনে তিনি তার ভাই থাকসিনকেও অতিক্রম করেছেন। ফলে দেশ অশান্ত হয়ে পড়ে। তিনি ক্ষমতা ও দলীয় স্বার্থে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করতে গিয়ে অত্যাচারের নতুন মাত্রাও যোগ করেন। সারা দেশ সরকারবিরোধী আন্দোলন ও ইংলাকের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে। তিনি গণদাবিকে উপেক্ষা করে একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসেন। বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচন বর্জন করেন। পরবর্তীকালে দেশের সাংবিধানিক আদালত এই নির্বাচন বাতিল করে দেন। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে তিনি আদালতের তরফ থেকে প্রথম ধাক্কা পান এবং আগামী জুলাই মাসে সকল দলের অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো তার পদত্যাগ দাবি অব্যাহত রাখেন। সম্প্রতি তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিদেশে অবস্থানরত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির দায়ে অভিযুক্ত তার ভাই জেনারেল থাকসিনকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ সফল হবার আগেই ২০১১ সালে গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে দলীয় স্বার্থে বদলির কারণে সাংবিধানিক আদালত তাকে বরখাস্ত করলেন। আমরা থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালতের নীতিবোধ এবং নিরপেক্ষতা গণতান্ত্রিক নিষ্ঠার প্রতি সম্মান জানাই।
আমাদের দেশেও বর্তমানে গণতন্ত্রের নামে নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার চলছে। মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও ইজ্জতের এখানে কোনও মূল্য নেই। দুর্নীতি সারা দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। মানবাধিকার লংঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম-খুন এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্যাতন সকলকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী, বিচার বিভাগ সর্বত্র চরম দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার সামগ্রিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। সরকার বিরোধী দল ও তার নেতা-কর্মীদের উপর বেপরোয়া নির্যাতন চালাচ্ছেন এবং হত্যা-গুমে দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের, তাদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পৃক্ততা এবং এমনকি সিনিয়র র্যাব কর্মকর্তাদের জড়িয়ে পড়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা জনপ্রতি একাধিক অস্ত্রের বৈধ লাইসেন্স নিয়ে অবৈধ কাজ বিশেষ করে খুন-ডাকাতির কাজে ব্যবহার করেন। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের নজরুল হত্যাকা-ের ঘটনায় এ সংক্রান্ত একটি ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে সরকার আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। মানুষের এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিও নেই। এই অবস্থায় থাইল্যান্ডের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা থাই প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্য থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে বলে মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন