এ পর্যন্ত সেভেন মার্ডারের তদন্তের
অগ্রগতি বলতে যা হয়েছে তাতে নূর হোসেনের আর্থিক প্রলোভনে প্রলুব্ধ একটি রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা
রাকারী বাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নাম প্রকাশিত হয়েছে নিহতদের
পরিবার থেকে। এর মধ্যে র্যাবের তিনজনকে অনেক নাটকীয়তার পর গ্রেফতার করা হয়েছে।
সাধারণ
মানুষ মনে করেন গত তিন-চার বছরে যত মানুষ গুম হয়েছেন, তাদের পরিণতিও নারায়ণগঞ্জের ঘটনার মতো। গত বছরের শুরু থেকে অদ্যাবধি বিএনপি
ও ১৯ দলীয় জোটের শত শত নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। একদলীয় নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন
চলাকালে গুম ও খুনের ঘটনা অনেক। আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলার মামলায় অভিযুক্ত
আসামিদের কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে এখানে-সেখানে। তাদের সাদা পোশাকে তথাকথিত আইনের লোকেরা
তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
বিএনপি
নেতা চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার সময় থেকেই প্রায় সব অপহৃতের পরিবার র্যাবের
নাম উল্লেখ করে বলেছেন, তাদের স্বজনকে র্যাব নিয়ে গেছে। প্রায় চার বছর
এ ধরনের গুম ও খুনের অভিযোগ চাপাস্বরে থাকলেও নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের পরে একে
একে অনেক গুমের রহস্য বের হতে শুরু করেছে। অপহৃতদের পরিবারগুলো সাহস করে কথা বলা শুরু
করেছে। গত ডিসেম্বর লাকসামের বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির
সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুনের পরিবার অভিযোগ করেছেন নারায়ণগঞ্জের ঘটনার যেসব র্যাব
কর্মকর্তার নাম এসেছে, তারাই হিরু, হুমায়ুন ও হিরুর ম্যানেজারকে
গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। কয়েক ঘণ্টা পরে হিরুর ম্যানেজারকে র্যাবের
এক ডিএডি লাকসাম থানায় হস্তান্তর করলেও হিরু-হুমায়ুনকে গ্রেফতার করার কথা অস্বীকার
করেন। ফলে হিরু ও হুমায়ুন গুম হয়ে যান। তাদের আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
নারায়ণগঞ্জ
আজ খুনের শহরে পরিণত হয়েছে। এ শহরের সর্বত্র এখন খুনি ঘুরে বেড়ায় পাগলা কুকুরের মতো।
এমন যখন পরিবেশ তখন অনেকের মতো আমার পরিবার, শুভাকাক্সী সবাই দীর্ঘ দিন ধরে
প্রতিদিনই বলেন, সাবধানে থাকবেন। একা বের হবেন না, সাথে লোকজন রাখবেন। সন্ধ্যার পর কোথাও যাবেন না। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও সরকারের
কাণ্ডজ্ঞানের বেহাল অবস্থা দেখে আমিও যথারীতি নগরভবন থেকে শুরু করে ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান
কোথাও একা যাই না, সাথে কয়েকজন সঙ্গী-সাথী থাকেন। সন্ধ্যার পরে বাইরে কম থাকতে চেষ্টা
করি। গুম হয়ে গেলে সরকার যেহেতু বিষয়টিকে কোনো গুরুত্ব দেয় না, কিংবা গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধার অথবা অপহরণকারী, খুনিকে গ্রেফতারে তৎপর হয় না, যখন একটি পরিবার বছরের পর বছর
জানতেও পারে না তার স্বামী, বাবা, সন্তান ও ভাই কোথায় আছে; বেঁচে আছে কি না, কিংবা তার শেষ পরিণতিই বা কী, সেই দেশে গুম থেকে বাঁচার কৌশল আয়ত্ত করার চেষ্টা করতে হয় নিজেদের উদ্যোগে।
কিন্তু
গত ২৭ এপ্রিল আমার নিরাপত্তা দেয়ালে চির ধরে আর ৩০ এপ্রিল সে দেয়াল ভেঙে পড়ে শীতল্যার
বুকে। গুম হওয়া থেকে বাঁচার জন্য যে দু’টি পদ্ধতি অবলম্বন করে নিজেকে
নিরাপদ মনে করতাম, সেই টিপস দু’টি কাউন্সিলর নজরুলও ব্যবহার করেছিলেন। নজরুল একা
বের হননি, তার সাথে চারজন সঙ্গী ছিল নিজের গাড়িতে এবং তারা অপহরণের শিকার
হয়েছিলেন বেলা ২টা ৪০ মিনিটে, দিনের আলোতে সবার সামনে। ফলে নিরাপত্তা টিপস দু’টি অসার প্রমাণিত হয়। তাই রহস্যের কিনারা করতে পারি না। দিনদুপুরে একজন সিটি
কাউন্সিলরসহ সাতজন (সম্ভবত অপহরণকারীদের দেখে ফেলায় আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক
জাহাঙ্গীরসহ) মানুষ মহাসড়ক থেকে গায়েব হন কিভাবে? সাতজন মানুষকে দু’টি গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্য গাড়িতে তুলে অপহরণ করা কিভাবে সম্ভব? নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় সাতজনকে অপহরণ করতে হইচই ধস্তাধস্তি ও চিৎকার-চেঁচামেচি
হওয়ার কথা। ঘটনার সাী থাকার কথা। কিন্তু চাুষ সাীও নেই। তাজ্জব ঘটনা। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা
পর থেকে প্রকাশিত হতে থাকে অপহরণকারী চক্রের নাম। অপহৃতদের পরিবারের সদস্যরা সরাসরি
অভিযোগ করেন, নূর হোসেনের ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব-১১-এর সাবেক সিও তারেক
সাঈদ, আরিফ ও রানা নামে তিন কর্মকর্তা এই গুম ও খুনের দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রথমে দ্বিধা থাকলেও দিনে দিনে সব কিছু উন্মোচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে তাদের
সম্পৃক্ততা। তাদের র্যাব থেকে প্রত্যাহার ও নিজ বাহিনী থেকে অকালীন অবসরে পাঠিয়ে দেয়া
হয়।
দেশবাসী
মনে করে, রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রায় সৃষ্ট ও নিয়োজিত র্যাবকে সরকার গত ছয়
বছরে ইচ্ছেমতো অনুগত দলীয় কর্মীদের মতো বিরোধী দল দমন ও নিধনে অবৈধ ব্যবহার করায় ধীরে
ধীরে সুশৃঙ্খল বাহিনীটি রীবাহিনীর মতো সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সরকারের
নির্দেশে মানুষ খুন, গুম করে মসনদ রা করায় সরকার ও র্যাব উভয়েরই নৈতিক
অবয়ের চূড়ান্ত ফসল নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার। যেসব র্যাব সদস্য সরকারি নির্দেশে
বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম-খুন করেছে, তারাই ১০টি অফিসিয়াল গুম-খুনের
পাশাপাশি দু-একটি প্রাইভেট ‘পে’ মেরেছে অর্থবিত্তের লোভে। সরকার
তা নিয়ন্ত্রণ করেনি বা করতে পারেনি নৈতিকতার অভাবে। কারণ সরকারের প্রত্য মদদেই তো তাদের
গুম-খুনের হাতেখড়ি।
শুধু সরকারের
মতার লালসার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে সফল একটি বাহিনীর
প্রশংসনীয় ইমেজ। র্যাব ছিল সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কাছে আতঙ্কের নাম, আর সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপত্তার নাম। সেই র্যাবের নাম শুনলে আজ মানুষ আতঙ্কে
আঁতকে ওঠেন। ১৯৭৩-৭৫ সালে বিরোধীদলীয় কাউকে রীবাহিনী ধরে নিয়ে গেলে যেমন আর জীবিত ফিরতেন
না, তেমনি গত কয়েক বছরে র্যাবও যেসব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে
গেছে, তারাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জীবিত ফিরে আসেননি। রীবাহিনীর সময় নিহতদের
লাশ পাওয়া গেলেও ডিজিটাল বাংলাদেশে বেশির ভাগ েেত্রই লাশও পাওয়া যায় না। ‘হারিয়ে যাওয়া’ কিংবা সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর পরিচয়ে
তুলে নেয়া ব্যক্তিদের শেষ পরিণতি নিয়ে দীর্ঘ দিনের না জানা তথ্য আবিষ্কার হয়েছে নারায়ণগঞ্জের
সেভেন মার্ডারের মধ্য দিয়ে। ধারণা করা হয়, হারিয়ে যাওয়া প্রায় সবারই পরিণতি
হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের মতো সলিল সমাধি। এই সাতজনের লাশের সাথে বাঁধা ইটের
বস্তা, রশি, রশি বাঁধার পদ্ধতি দেখে ধারণা হয়, নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারে র্যাবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ও তাদের অধীনস্থ
র্যাব সদস্যরা জড়িত। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের ব্যাপারে তিন র্যাব কর্মকর্তাকে
চাকরিচ্যুত করলেও তাদের রা করতে সরকারের অবাঞ্ছিত আচরণে দেশবাসী হতবাক ও ুব্ধ। বিশ্লেষকদের
ধারণা, চাকরিচ্যুতি ও হাইকোর্টের নির্দেশের পরও সাবেক র্যাব কর্মকর্তাদের
গ্রেফতারে টালবাহানা করে সাত দিনের বেশি সময় পেণ এবং অবশেষে গ্রেফতার করলেও তাদের সেভেন
মার্ডারের আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করায় সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ দিন দিন ঘনীভূত
হচ্ছে।
সেভেন
মার্ডারের ঘটনায় দেশবাসী যখন ভারাক্রান্ত, তখনই জনমনে আরো ক্ষোভ ও হতাশার
সৃষ্টি করেছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী মন্ত্রী থেকে শুরু
করে ‘টোকাই’ নেতা পর্যন্ত সবার একবাক্যে সেভেন মার্ডারের জন্য
বিএনপিকে দায়ী করা। সুশীলসমাজে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, সরকারের নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যের প্রতি দোষ চাপানোর আগে কি ভেবে দেখা উচিত
ছিল না? সরকার কোন বিবেচনায় নূর হোসেনের মতো একজন খুনিকে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের
লাইসেন্স দিয়েছিল? নূর হোসেনকে সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক নিয়োগের জন্য কেন এইচ
টি ইমাম ডিও লেটার দিয়েছিলেন? অপহৃতদের পরিবার থেকে বারবার নূর হোসেনের নাম বললেও
তাকে গ্রেফতার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ না করে কেন এসপি নূরুল ইসলাম নূর হোসেনের পে সাফাই
গাইলেন? কিসের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন ডিসি নূর হোসেনের আগ্নেয়াস্ত্রের
লাইসেন্সে সই করেছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলেই জানা যেত নূর হোসেনের
মতার উৎস কী এবং কারা? নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন ডিসি মনোজ কান্তি বড়াল ও এসপি
নূরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। নূর হোসেনকে দানবে পরিণত
করার দায়ে নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন ডিসি ও এসপি কম দায়ী নন।
বাংলাদেশের
সংবিধান অনুযায়ী জনগণের জানমাল হেফাজতের দায়িত্ব সরকারের হলেও সরকার এবং তার নিয়ন্ত্রিত
আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীই জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ
যদি চোখে দেখে, কানে শুনে প্রতিবাদ করেন কিংবা ভিন্নমত পোষণ করেন, তবে তার পরিণতি কি গুম ও খুন? বাঁচতে হলে নিজ থেকে অন্ধ ও বধির
হয়ে যাওয়াই একমাত্র নিরাপদ উপায় হতে পারে।
মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন