মানুষের মুখে মুখে এখনো র্যাবকে নিয়েই যতো আলোচনা। একযোগে বইছে নিন্দা-সমালোচনার ঝড়ও। প্রকাশিত বিভিন্ন সচিত্র খবরে তথ্যের পর তথ্য সাজিয়ে প্রমাণ করা হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে র্যাবই হত্যা করেছে। কারা এই হত্যাকা-ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের কে কোন মন্ত্রীর জামাতা, কে ক্ষমতাসীনদের অন্য কারো স্বজন এবং কোন মন্ত্রীর গুণধর পুত্রকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে খুবই তৎপর দেখা গেছে এ ধরনের অনেক তথ্যও বেরিয়ে এসেছে। লাশগুলোকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য ঠিক কোন বাহিনীর অফিসের কাছাকাছি স্থানে স্তূপ করে রাখা কোন কোম্পানির ইট ব্যবহার করা হয়েছিল এবং মাসের পর মাস ধরে ঘাটে বেঁধে রাখা বিশেষ বাহিনীর দুটি নৌকা যে হঠাৎ করেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে এসব খবরও মানুষ জানতে পেরেছে। ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ আদৌ সত্য কি না সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যও এখন আর মানুষের মধ্যে তাড়া নেই। কারণ, যাদের বিরুদ্ধে নিহত নজরুলের শ্বশুর অভিযোগ তুলেছেন সে তিনজনকে অভিযোগ ওঠার পরপরই প্রথমে প্রত্যাহার এবং পরে চাকরি থেকে বিদায় করা হয়েছে। ‘অকালীন’ ও ‘বাধ্যতামূলক’ অবসরের আড়ালে তাদের আসলে বাঁচিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না সে প্রশ্নটিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে।
আমরা অবশ্য অনুমাননির্ভর কোনো তথ্য নিয়ে কথা বাড়ানোর পক্ষপাতী নই। এই নিবন্ধে বরং দুটি বিষয়কে প্রাধান্যে আনা হবে। প্রথম বিষয় ঘটনার সময়কাল আর দ্বিতীয় বিষয় অবশ্যই র্যাব। প্রথমে সময় সম্পর্কে বলা দরকার। হঠাৎ শুনলে পাঠকরা অবাক হতে পারেন কিন্তু রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করি বলেই সাত খুনের মতো যে কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে এদিক-সেদিকে লক্ষ্য না করে পারি না। দেখতে ও বুঝতে চেষ্টা করি, অন্য কোনো ঘটনা বা কারণের দিক থেকে জনগণের দৃষ্টি ও মনোযোগ সরিয়ে দেয়ার কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি না। অর্থাৎ কৌশল হিসেবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে কি না। বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাকেও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণই বলতে হয়। কারণ, এমন এক সময়ে রক্ত হিম করা এ হত্যাকা-ের মাধ্যমে দেশকে কাঁপিয়ে তোলা হয়েছে যখন তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করছিল। পানির দাবিতে তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ করা হয়েছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি সমাবেশ ও সেমিনার। এসব সমাবেশ ও সেমিনারে রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে ভারত যথেচ্ছভাবে পানি সরিয়ে নেয়ায় নদীটির বাংলাদেশ অংশ শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়েছে। এপ্রিল-মে মাসে তিস্তায় যেখানে অন্তত ১০ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা সেখানে এখন চার-পাঁচশ কিউসেক পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে নদীই শুধু শুকিয়ে যায়নি, আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও মরুকরণ প্রক্রিয়া ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, তিস্তায় পানি না থাকার কারণে বাংলাদেশের বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদ-নদীগুলোতে ভারত বাঁধের পর বাঁধ নির্মাণ করায় একদিকে মৎস্য, পশু-পাখি ও গাছপালা মরে যাচ্ছে এবং কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি বছর অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ১৩৫ বিলিয়ন টাকার। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬০ ভাগ এলাকাই মরুভূমিতে পরিণত হবে।
কিন্তু দেশ এত বিপুল ও প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছে প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাচ্ছে না। সরকারের এই ভারতের সেবাদাসসুলভ মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতেই তিস্তা ও গঙ্গাসহ অভিন্ন সব নদ-নদীর পানির হিস্যার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার দাবি জানানো হয়েছে। এভাবেই দেশে ভারতের বিরুদ্ধে প্রচ- আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উত্থাপিত হতে যাচ্ছিল। একই কারণে জনগণের দৃষ্টি ও মনোযোগ সরিয়ে দেয়াটাও সেবাদাসদের জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্যে পরিণত হয়েছিল। আমরা অবশ্য বলতে চাই না, সে উদ্দেশ্যেই সাত-সাতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু একথাও তো সত্য যে, এই হত্যাকা-ের ফলে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে গড়ে উঠতে থাকা আন্দোলন হঠাৎই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। পানির দাবি বা ভারতের পানি আগ্রাসন নয়, মানুষের মুখে মুখে এখন কেবলই ওই হত্যাকা-ের কথা।
এবার দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে র্যাব প্রসঙ্গ। কথা উঠেছে অনস্বীকার্য কিছু কারণে। এই সত্য স্বীকার করতেই হবে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মানুষ হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে। গুম হচ্ছেন বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদী ও খালের পাশে, ফসলের ক্ষেতে। আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব গুম ও হত্যাকা-ের জন্য পুলিশ ও র্যাবসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে জনমনে শুধু ভীতি-আতংকই ছড়িয়ে পড়ছে না, জীবনের নিরাপত্তার জন্য সরকারের ওপর মানুষের আস্থাও কমে যাচ্ছে। গুম ও খুনের বিষয়টি নতুন করে প্রাধান্যে এসেছে সাম্প্রতিক কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনার কারণে। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে, রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি গুম ও হত্যার ব্যাপারেও সরকার সমান তালে এগিয়ে চলেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন বিরোধী দলের নেতা-কর্মী মাত্রকেই গুম হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকতে হচ্ছে। কারণ, একবার কাউকে গুম করা হলে তার আর কোনো হদিসই মেলে না। বলা দরকার, ঘটনাপ্রবাহে সরকারের জন্য দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ, প্রতিটি ঘটনায় বিশেষ করে র্যাবের অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। প্রসঙ্গক্রমে র্যাবের গুলীতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া ঝালকাঠির কলেজ ছাত্র লিমন হোসেনের ঘটনা উল্লেখ করা যায়। এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমন ২০১১ সালের ২৩ মার্চ র্যাবের গুলীতে আহত হওয়ার পর থেকে পা হারিয়ে বিছানায় পড়ে থেকেছে। তার মা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করতে থানায় গেছেন। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। লিমনের মা শেষ পর্যন্ত আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। পুলিশ প্রথমে আদালতকেও পাত্তা দেয়নি। আদালতের দ্বিতীয়বারের আদেশে ২৪ দিন পর পুলিশ অনেকাংশে অনুগ্রহ করে লিমনের মায়ের মামলা নিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে লিমনকেও ফাঁসিয়ে ছেড়েছে। পুলিশ লিমনের বিরুদ্ধে র্যাবের দায়ের করা এমন দুটি মামলায় চার্জশিট দিয়েছে, যেখানে বেচারা লিমনকেই উল্টো সন্ত্রাসী বানানো হয়েছে। কোনো রকম তদন্ত না করেই পুলিশ লিমনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দুটিকে আদালতে দাখিল করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, লিমন নাকি দায়িত্ব পালনে র্যাবকে বাধা দিয়েছিল! ঘটনাটি এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এত তড়িঘড়ি করে চার্জশিট দাখিল করার কারণ জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে থানার একজন এসআই বলেছিলেন, ‘ওপরের নির্দেশে’ চার্জশিট দাখিল করতে হয়েছে।
কলেজ ছাত্র লিমনকে নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন ওঠার কারণ, লিমন জানিয়েছে, তাকে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলী করেছিল র্যাব। অবস্থা বেশি খারাপ হচ্ছিল বলে পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার গুলীবিদ্ধ পা কেটে ফেলেছেন। হৈ চৈ শুরু হলে ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল র্যাবের মহাপরিচালক বলেছিলেন, লিমন সন্ত্রাসী নয়, ঘটনাস্থলে ছিল বলে সে হয়তো গুলীবিদ্ধ হয়েছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে সে লিমনকেই দুই দুটি মামলায় আসামী করেছে র্যাব। একটিতে সাতজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে, অন্যটিতে এককভাবে। উল্লেখ্য, ঘটনাপ্রবাহে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছিল লিমনের মা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাওয়ার পর। ঠিক এ সময়ই লিমনকে সন্ত্রাসী বানিয়ে দুটি পৃথক মামলা ঠুকে বসেছিল র্যাব। পুলিশও নৃত্য করতে নেমে পড়েছিল। তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘ওপরের নির্দেশ’ রয়েছে। এই ‘ওপর’ কতটা ‘ওপরে’ ঢাকায় সাংবাদিকরা সে কথা জানার চেষ্টা করেছিলেন। উত্তরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, লিমনের বিষয়ে সরকারের কিছুই করার নেই। যা কিছু করার সব আদালত করবে। লিমন সম্পর্কে র্যাবের মহাপরিচালক যে বক্তব্য দিয়েছেন তার দায়দায়িত্ব নিতেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অস্বীকার করেছিলেন। অন্যদিকে পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, র্যাবের পক্ষে দায়মুক্তি পাওয়ার সুযোগ ছিল না। থানা-পুলিশের কাজ-কারবারও সন্দেহকে প্রবলতর করেছিল। লিমনের মায়ের মামলা না নেয়ার পাশাপাশি আদালতের প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েই পুলিশ থেমে যায়নি, র্যাবের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা মাত্র লিমনকে উল্টো দুই দুটি মামলায় ফাঁসিয়েও পুলিশ প্রমাণ করেছিল, ডালমে আসলেও কুছ কালা হ্যায়। একই এসআইকে লিমনের মায়ের এবং র্যাবের দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বানানোর বিষয়টিও ছিল রহস্যজনক।
ঝালকাঠির কলেজ ছাত্র লিমনকে নিয়ে হৈ চৈ ও প্রতিবাদ না থামতেই র্যাবের বিরুদ্ধে আবারও হত্যা প্রচেষ্টার গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। এবার র্যাবের শিকার হয়েছিল ভৈরবের এক নারী। প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, ২০১১ সালের মে মাসের প্রথম শুক্রবার বিকেলে সাদা পোশাকে আসা ১৫/১৬ জনের একটি দল ভৈরব শহরের পঞ্চবটি পুকুরপাড় এলাকায় ফারুক নামের এক যুবককে ধরে এনে মারধর শুরু করে। প্রতিবেশী রহিমা বেগম বাধা দিতে গেলে ওই দলটির একজন তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলী চালায়। রহিমা মাটিতে লুুটিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে মানুষের সমাগম বাড়তে থাকলে দলটি নিজেদের র্যাব-১১-এর সদস্য হিসেবে পরিচয় দেয় এবং গুলীবিদ্ধ রহিমা বেগমকে গাড়িতে উঠিয়ে চলে যায়। আটক যুবককেও তারা চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল। র্যাব-১১-এর অধিনায়ক জানিয়েছিলেন, রহিমা বেগম নাকি একজন ‘মাদক সম্রাজ্ঞী’। মাদকের আস্তানা হিসেবে পরিচিত পঞ্চবটি এলাকায় মাদকের বড় ধরনের চালানের খবর পেয়েই নাকি র্যাব অভিযান চালিয়েছিল। উদ্ধার করেছিল ৪১ বোতল ফেন্সিডিল। আটক মাদক ব্যবসায়ী ফারুককে ছাড়াতে গিয়ে রহিমা বেগম নাকি একজন র্যাব সদস্যের পিস্তল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে পিস্তল থেকে হঠাৎ গুলী বেরিয়ে রহিমা বেগমের মাথায় লেগেছে। এতে র্যাবের কোনো দোষ নেই।
বলা বাহুল্য, র্যাবের এই ভাষ্য মোটেও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনি। বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ার একটি কারণ হলো, ভৈরবে র্যাব-৯ থাকা সত্ত্বেও নারয়ণগঞ্জ থেকে র্যাব-১১-এর সদস্যরা সেখানে অভিযান চালাতে গিয়েছিল। র্যাব-৯-এর অধিনায়ক বলেছিলেন, তাদের জানিয়েই নাকি অভিযান চালানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছিল, অন্য অঞ্চল থেকে এসেই যদি অভিযান চালাতে হবে তাহলে র্যাব-৯ ভৈরবে রয়েছে কেন? পরিচয় লুকিয়ে সাদা পোশাকে যাওয়ার কারণেও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হয়েছে, র্যাব সত্য এড়িয়ে গেছে। মাদক উদ্ধার করতে নয়, র্যাব-১১ গিয়েছিল অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। কারণ, মাত্র ৪১ বোতল ফেন্সিডিল ‘বড় ধরনের’ চালান হতে পারে না, যা র্যাব-১১-এর সদস্যরা উদ্ধার করে এনেছিল। পর্যালোচনায় বরং দেখা গেছে, র্যাব-১১ অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পঞ্চবটিতে হানা দিয়েছিল। জানাজানি হওয়ার পর, বিশেষ করে একজন নারী গুলীবিদ্ধ হওয়ায় র্যাবকে আবারও কাহিনী তৈরি করতে হয়েছিলÑ যেমনটি করা হয়েছিল ঝালকাঠির কলেজ ছাত্র লিমনের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলী করার পর। অর্থাৎ ঝালকাঠির মতো পঞ্চবটিতেও অস্ত্র ঠেকিয়েই গুলী করেছিল র্যাব। পার্থক্য হলো, লিমনের বেলায় গুলী পায়ে করা হয়েছিল আর রহিমা বেগমকে করা হয়েছিল মাথায়। সুতরাং র্যাবের পক্ষে দায়মুক্তি পাওয়ার সুযোগ থাকতে পারে না। সুযোগ ছিলও না। একজন নারীকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলীবিদ্ধ করার ঘটনা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল আসলে র্যাবকে নিয়ে। কারণ, সেই সময় থেকে দেখে-শুনে মনে হচ্ছে যেন দু-একদিন পরপর কাউকে না কাউকে গুলী করতে না পারলে র্যাবের ভাতই হজম হচ্ছে না! অথচ র্যাবই আইনশৃংখলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত একমাত্র সশস্ত্র বাহিনী নয়।
সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে, র্যাব এখন যদি প্রকৃত কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয় তাহলেও মানুষ বিশ্বাস করবে না। ওই অপরাধীই বরং নির্দোষ হিসেবে মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি পাবে এবং আদালতে পার পেয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, এমন অবস্থা শুধু ক্ষতিকর নয়, অত্যন্ত ভীতিকরও। গুমের পাশাপাশি নির্যাতন ও হত্যার কারণেও র্যাবের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বেগ ও আপত্তির কারণ হলো, র্যাব গঠিত হয়েছিল একটি এলিট বাহিনী হিসেবে। অন্যদিকে অবস্থা এমন হয়েছে যা দেখে-শুনে মনে হচ্ছে যেন দু-একদিন পরপর ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার ধরনের বাহারী নামে হত্যা করাটাই র্যাবের প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে! বলা বাহুল্য, সামনে র্যাবকে রাখা হলেও পেছনে আসলে রয়েছে সরকার। সরকারই র্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যার কাজে ব্যবহার করছে। এর ফলে মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলে র্যাব এক ভয়ংকর বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
শুধু দেশের ভেতরে নয়, বিদেশেও র্যাবকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। এর একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া থেকে। ক্রমাগত মানবাধিকার লংঘন এবং গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন বেআইনি কর্মকা্ে- জড়িত থাকার অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব-এর সদস্যদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়ার ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চলতি বছর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মার্কিন অর্থে পরিচালিত কোনো প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে বাংলাদেশ সরকার যেন র্যাব-এর কোনো সদস্যকে মনোনয়ন না দেয়। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, র্যাব গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের কর্মকা- বন্ধ করেছে এবং বাংলাদেশ সরকার র্যাব-এর মানবাধিকার লংঘনকারী সদস্যদের বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেÑ এই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই যুক্তরাষ্ট্র এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশেরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংস্থার জরিপ ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব-এর ব্যাপারে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কথার মারপ্যাঁচে নানা ব্যাখ্যা দেয়া হলেও বাস্তবে গুম ও গুপ্তহত্যা তথা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয়টি কত ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তারই একটি বড় প্রমাণ। এমন অবস্থা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশংকাজনক। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অভিযোগ করেছে, সরকার বেছে বেছে এবং তালিকা করে দলের নেতা-কর্মীদের গুম ও খুন করছে। এভাবে দলের প্রায় সাড়ে তিনশ জন নেতা-কর্মীকে সম্প্রতি হত্যা করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বিভিন্ন সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। প্রতিটি হত্যাকা-েই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে র্যাব-এর সদস্যরা। যে যৌথবাহিনীর নামে এসব হত্যাকা-ের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হচ্ছে, সে বাহিনীতেও র্যাব-এরই প্রাধান্য রয়েছে। অথচ র্যাব পরিকল্পিত হয়েছিল একটি অভিজাত বাহিনী হিসেবে। র্যাবকে দিয়ে তাই এমন কোনো কাজ করানো উচিত নয় যার ফলে অভিজাত এ বাহিনীটি ঘাতক বাহিনীর কুখ্যাতি পেয়ে যায়। র্যাব কেন একের পর এক হত্যাকা- সংঘটিত করছে, সর্বশেষ ঘটনায় র্যাব কেন সাত-সাতজন মানুষকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে এবং কাউকে আদালতে সোপর্দ না করে গুলী করার অধিকার র্যাবের রয়েছে কি না এসব বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করা এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে দোষীদের শাস্তি দেয়া দরকার।
সবশেষে বলবো, হত্যা ও গুমের পন্থা কেবল এমন কোনো সরকারই নিয়ে থাকে, যে সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই সরকারকে হত্যা ও গুমের মতো ভয়ংকর পদক্ষেপের মাধ্যমে ভীতি-আতংক ছড়িয়ে দিতে হয়। এ যে কেবলই আমাদের কথা বা অভিযোগ নয় তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায়। আপত্তির কারণ হলো, র্যাব পরিকল্পিত হয়েছিল একটি এলিট ফোর্স হিসেবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার র্যাবকে দলীয় ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীতে পরিণত করেছে। আমরা মনে করি, সদিচ্ছা থাকলে এখনও র্যাবকে তার মূল অবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে দরকার র্যাবের সুনাম ফিরিয়ে আনাও। আমরা বেশি উদ্বিগ্ন আসলে অন্য একটি বিশেষ কারণে। তথাকথিত বিদ্রোহের অভিযোগে সেনাবাহিনীর প্রায় ৬০জন কৃতী অফিসারকে হত্যার পাশাপাশি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ভিত্তিতে বিডিআরকে ধ্বংস করা হয়েছে। একই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান পর্যায়ে র্যাবকেও ধ্বংস করার কর্মকা- চালানো হচ্ছে কি না সে প্রশ্ন কিন্তু সঙ্গত কারণেই উঠেছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন