বাংলাদেশে বর্তমানে যারা ক্ষমতাসীন
তারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন ২০০৮ সালে, তৎকালের সেনাসমর্থিত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের
সরকারের সাথে আঁতাত করে। সে আঁতাতের মূল উদ্দেশ্যই ছিল দেশ থেকে জাতীয়তাবাদী ধারার
রাজনীতি সম্পূর্ণ নির্মূল করা। সেই সাথে রাজনীতিও। এর পেছনে ছিল ইন্দোমার্কিন প্রভাব
বলয়। এ এজেন্ডা বাস্তবায়ন শুরু করেছিল মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার। ২০০৭ সালের ১১
জানুয়ারি সম্পূর্ণ অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন জেনারেল মইন। আর ক্ষমতা
দখল করেই তিনি বিএনপিকে নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালান। প্রথমে বিএনপির
শীর্ষস্থানীয় সব নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করেন। এরপর তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে তার
ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেন, যার চিকিৎসা এখনো তিনি লন্ডনে করছেন। এরপর গ্রেফতার করেন বিএনপির চেয়ারপারসন
বেগম খালেদা জিয়াকে। যদিও লোক দেখাতে তিনি অল্প কিছ ুদিনের জন্য অন্তরীণ করেছিলেন শেখ
হাসিনাকে। তারপর তাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশ থেকে সক্রিয় রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। কিন্তু
বিএনপি নেতারা কারাগারে আটকই থাকেন।
জেনারেল
মইনের সরকার দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়। বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের ডেকে নিয়ে জোর করে তাদের পদত্যাগ করানো হয়। নতুবা
সামরিক শাসকদের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়। সেটা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর দুঃসহ
পরিস্থিতি। সে সময় সরাসরি সামরিক আইন জারি করা হয়নি বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে মনোনীত প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীনের মাধ্যমে
জেনারেল মইন এসব অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন। এক সময় তিনি সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের
পরিকল্পনাও করতে শুরু করেন। সে অনুযায়ী ফখরুদ্দীনকে দিয়ে মাঝে মধ্যে সরকার পরিচালনার
বিভিন্ন ফর্মুলাও প্রণয়ন করে যেতে থাকেন, যার কোনো কিছুই এ দেশের সাধারণ
মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ওই সরকার বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে
পাঠিয়েছিল, যাতে এরা কোনো প্রতিবাদ করতে না পারে। এগুলো যে সুফলদায়ী হয়েছিল, এমন নয়। এদের পেছনে ছিল সুশীলসমাজ নামে একটি পরজীবী শ্রেণী। এরা সেনাশাসকদের
অবিরাম উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকায় রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে
ধারাবাহিকভাবে কুৎসা রচনা করেছেন। লক্ষ্য ছিল একটাই। দেশকে রাজনীতিশূন্য করা।
জেনারেল
মইনের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। সারা দেশে যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে ব্যাপক লুটপাট ও নির্যাতনের
রাজত্ব কায়েম হয়। ফলে মইন-ফখরের সরকারের প্রতি মানুষের আস্থায় মারাত্মক ধস নামে। ধীরে
ধীরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে।
সে রকম এক পরিস্থিতিতে ইন্দোমার্কিন প্রভুদের পরামর্শেই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে সরে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখন আওয়ামী লীগ, সুশীল ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো
বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় যে, তারা ইসলামি জঙ্গিবাদীর তোষণকারী।
তাদের প্রশ্রয়েই বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবতা
হলো, যে উত্থান ঘটতে যাচ্ছিল, সূচনালগ্নেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন
জোট সরকার তাদের কঠোরভাবে দমন করে। এবং আজ পর্যন্ত সে রকম জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে মাথা
তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ, সুশীল ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া, ভারতের তৎকালীন সরকার ও মিডিয়া একযোগে বিএনপি-জামায়াত জোটকে জঙ্গিবাদী বলে
অভিহিত করতে থাকে। এখন মনে হয়, সে প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত
হয়েছিল। কারণ সুশীল সৃষ্টিতে ও বিকাশে তাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
জেনারেল
মইনের সমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার অথর্ব ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার। ক্ষমতা তাহলে কাদের কাছে
দিয়ে যাবে? বিএনপির ওপর এরা যে পরিমাণ অত্যাচার চালিয়েছে এবং যে অপপ্রচার
হয়েছে, তাতে তাদের মধ্যে শঙ্কা দানা বাঁধা খুব স্বাভাবিক যে, বিএনপি যদি আবার কোনোভাবে ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই সেনাশাসকদের জবাবদিহিতা
ও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তাতে কৃত অপরাধের জন্য চরম দণ্ড হয়তো অপেক্ষমাণ। অপর দিকে
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই অবৈধ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ঘোষণ দেন, জেনারেল মইনের সামরিক সরকার তাদের আন্দোলনেরই ফসল। তা ছাড়া শেখ হাসিনাকে যখন
মুক্তি দিয়ে মইনের সরকার বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে তখন শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, সামরিক সরকার যেভাবে চলছে, অর্থাৎ বিএনপিকে ধ্বংসের চক্রান্তে
মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে, সেভাবেই যেন চালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে
তাদের এসব অপকর্মের শতভাগ বৈধতা দেয়া হবে। মইন চালিয়েও গিয়েছিলেন। ফলে ইন্দোমার্কিন
এক্সিস জেনারেল মইন ও আওয়ামী লীগ মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে পারলেই জেনারেল মইনের সরকার বৈধতা পাবে এবং একটি
নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে জেনারেল মইনকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া
হবে।
আমরা শুনেছিলাম, জেনারেল মইনের সরকার, আওয়ামী লীগ নেত্রী যখন অন্তরীণ ছিলেন, তখন তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এ কথা শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন। কিন্তু
তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি এবং দলের কাউকে খুব একটা উচ্চবাচ্যও করতে দেননি।
যদিও জেনারেল মইনের হাতে তার দলের অনেক নেতাকর্মীও মারাত্মকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের
সে সময়কার সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, পরে একে ‘আঁতাতের নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যেখানে কোনো রক্তপাত হয়নি
বটে, কিন্তু ১০০-১১০/১২০ ভাগ ভোট পেয়ে তখন সরকার গঠন করেন আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা করা হয়েছিল ওই বছরই। এর কোনো
কিছু নিয়েই কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেয়নি মইনের পদলেহী নির্বাচন কমিশন।
ক্ষমতায়
আসীন হয়ে আওয়ামী সরকার বিরোধী দলের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে শুরু করে। হত্যা, লুটপাট, দখল যেন এক উৎসবে পরিণত হয়। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী
নতুন করে ঘরবাড়ি ছাড়া হন। যে, যাকে, যেখানে, যখন খুশি খুন করতে শুরু করে। সারা দেশ এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়। ক্ষমতাসীন
হওয়ার প্রায় দুই মাসের মাথায়ই পিলখানায় ঘটানো হয় বিডিআর বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহে শীর্ষস্থানীয়
৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে খুন করার সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ আছে। জননিরাপত্তা বিষয়ে যে
অরাজক পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা বরং পাল্টা
প্রশ্ন করেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তারা যা করেছিল, সে তুলনায় তার সরকারের আমলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড খুবই নগণ্য। সাংবাদিকেরা কেন
তার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছেন না। তখন এমনও প্রশ্ন উঠেছিল যে, ঠিক আছে, বিএনপি জোট খারাপ সরকার ছিল। জনগণ তাদের বিদায় করে দিয়েছে। আপনারা
ভালো। আপনাদের কাছ থেকে তো জনগণ উন্নততর শাসনই আশা করবে। তারও শ্লেষাত্মক জবাব দিয়েছেন
শেখ হাসিনা। এই ‘আঁতাতের নির্বাচন’ দিয়ে বাংলাদেশে শুরু হলো ত্রাসের
যুগ। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের যেখানেই পাওয়া যাচ্ছিল, সেখানেই হত্যা করা হচ্ছিল। গুম, মারধর এবং ঘরবাড়ি, অফিসে অগ্নিসংযোগ হয়ে উঠেছিল নিত্যকার ঘটনা। সে ধারায় কখনো ছন্দপতন ঘটেনি।
বরং দিনকে দিন তার মাত্রা বেড়েই গেছে। এসব হামলার পাশাপাশি মামলাও দায়ের করা হয়েছে
হাজারে হাজারে। বিএনপির অশীতিপর নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাঙ্চুর ও গাড়ি পোড়ানোর মামলা
করা হয়। তাদের গ্রেফতার করে রিমান্ডের নামে নির্যাতন চালানো হয়। এখনো হচ্ছে।
নিজ দলের
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমায় মুক্ত করে এনে সার্কিট হাউজে
মন্ত্রীরা ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছেন। ফখরুদ্দীনের সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে
যেসব দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছিল, সেগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। তার
দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার হত্যা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু
বেগম খালেদা জিয়া বা বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে পুরনো মামলার সাথে যোগ হয়েছে নতুন নতুন
মামলা। তার মাধ্যমে চলছে অব্যাহত হয়রানি।
আমরা বারবার
সতর্ক করার চেষ্টা করছিলাম, এক সময় এই ঘাতকেরা স্বার্থের সঙ্ঘাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে
জীবনঘাতী হানাহানিতে জড়িয়ে পড়বে। বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই। গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে
প্যানেল মেয়র কমিশনার নজরুল ইসলামসহ সাতজন খুন হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে
এটুকু স্পষ্ট খুন যারা হয়েছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগার। খুন
যারা করিয়েছেন, তারাও আওয়ামী লীগার। প্রধান আসামিকে পালিয়ে যেতে যিনি সাহায্য
করেছেন, তিনিও আওয়ামী লীগের এমপি। এদেরকে যারা ‘ছয় কোটি টাকা উৎকোচের বিনিময়ে’ অপহরণ করে তুলে নিয়ে গেছে, সেই র্যাবের কমান্ডিং অফিসার আওয়ামী লীগের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী
মায়ার জামাতা লে. ক. তারেক সাঈদ। এখন আরো তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে।
এই ঘটনার
রেশ তখনো ফুরায়নি। গত ২০ মে ফেনীতে খুন হন ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী
লীগ সভাপতি একরামুল হক একরাম। তাকে গুলি করে, কুপিয়ে এবং শেষে পুড়িয়ে হত্যা
করা হয়। হত্যায় অংশ নেয়া সবাই ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের ক্যাডার। উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী
মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেন নিজাম হাজারী। কিন্তু
আওয়ামী লীগের আর এক সাবেক এমপি জয়নাল হাজারী দাবি করেন, স্বার্থের সঙ্ঘাত আর নেতৃত্বের কোন্দলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড করিয়েছেন আওয়ামী
লীগের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী নিজেই। নিজাম হাজারীকে গ্রেফতারের জন্য প্রতিদিন ফেনীতে
বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু এখানেও মনে হচ্ছে সরকার আড়াল করতে চাইছে প্রকৃত খুনিদের।
গত ২৯
মে কুমিল্লায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন এক এমপির ভাতিজা। মতিঝিলে
খুন হয়েছেন এক ঠিকাদার। সেখানে সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে আছেন আর এক প্রতিমন্ত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র।
ওই ঠিকাদারের কাছে প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা তিন কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এই একই দাবিতে
২০১১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঠিকাদার সুলতান আহমেদকে অপহরণ করেছিল একই দুর্বৃত্তরা। জিম্মি
করে তার কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকার একটি চেক এবং আর কিছু ব্ল্যাংক চেকে স্বাক্ষর করিয়ে
নিয়েছিল। যদি অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগকে আরো মাশুল
গুনতে হবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন