মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০১৪

বাজেটে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিন


লাফিয়ে বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের চাপে মানুষের জিহ্বা বেরিয়ে এলেও সরকার এবারও যথারীতি বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার আগেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। বাড়ছেও বেশ কিছুদিন ধরেই। ব্যবসায়ীদের অবশ্য যুক্তি ও অজুহাতের কোনো শেষ নেই। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ-খবর বিষয়ক সেই প্রবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই তারা এমনভাবে দিচ্ছেন যা শুনে মনে হচ্ছে, আওয়ামী ‘ডিজিটাল’ যুগে দুনিয়ার সব খবর শুধু তারাই রাখেন! দামও হাঁকাচ্ছেন তারা ইচ্ছামতো। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে ঢাকার মৌলভীবাজার ও কারওয়ানবাজার পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিটি কেন্দ্রস্থলে একই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী প্রথমে সংসদে প্রস্তাব আকারে বাজেট পেশ করবেন। সে প্রস্তাবের নানাদিক নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন। সবশেষে ৩০ জুন বাজেট প্রস্তাব পাশ হবে। যদি বাড়ানো হয় তাহলে পণ্যের দাম বাড়বে ১ জুলাই থেকে। কোনো কোনো পণ্যের এমনকি দাম কমারও সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে আমাদের দেশের ব্যবসায়ী-মহাজনরা শুধু একটা কথাই জানেন ও মানেন। বাজেট আসার সময় ঘনিয়ে আসা মাত্রই তারা দাম বাড়ানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। এ নিয়ম চলে আসছে বহুদিন ধরে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ কারণে সেটা আরো দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে। কারণটি হলো, একদিকে ব্যবসায়ী-মহাজনদের বিরাট অংশই অওয়ামী লীগ করেন, অন্যদিকে অওয়ামী লীগ যারা প্রকাশ্যে করেন না তাদেরও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে লেনদেনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একই কারণে সরকার চোখ বুঁজে থাকে, অন্যদিকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ব্যবসায়ী-মহাজনরা। মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যায়, তাদের জিহ্বা বেরিয়ে আসে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্যের নাম বলা যাবে না, যার দাম লাফিয়ে না বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে মূল্য স্থিতিশীল হবে সে সম্পর্কে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ, একে তো বাজেট আসছে, তার ওপর জুন মাসেই আবার শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজানও।
কিন্তু খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জনগণের এই কঠিন দুর্দশার মধ্যেও ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের চেহারায় বা কথাবার্তায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তিনি বরং ষষ্ঠবারের মতো বাজেট পেশ করার সাফল্যে উল্লসিত অবস্থায় আছেন। বাংলাদেশের মতো গরিব একটি দেশে এবার তিনি আড়াই লক্ষ হাজার কোটি টাকার সুবিশাল বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন! এত অর্থ তিনি ঠিক কোন ধরনের কতগুলো খাত থেকে যোগাড় করবেন সে প্রশ্ন তো রয়েছেই, বিরাট অংকের ঘাটতি রাখার মধ্য দিয়েও তিনি গভীর সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন। বিনিয়োগে প্রচ- খরা এবং রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স তথা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির মতো অনিবার্য কিছু বিষয়ও রয়েছে, যেসব বিষয়ে সত্য এড়িয়ে যাওয়ার এবং মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার ব্যাপারে মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিকট অতীতেও রেকর্ড যথেষ্টই করে রেখেছেন। মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে সেখানে অর্থমন্ত্রী শুনিয়েছেন ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশের কথা। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কোন খাতে ঠিক কতটুকু অর্জন করা গেছে, কেন অর্থবছরের শেষ মাসে এসেই হাজার কোটি টাকার অংকে টাকা ছাড় করানোর মহোৎসব শুরু হয়ে যায়Ñ এসব বিষয়ে কোনোবারই অর্থমন্ত্রীকে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। কেন তাকে মাঝে-মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতা দেশগুলোর কাছে গিয়ে ধর্না দিতে হয় এবং কেন প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থ শেষ পর্যন্ত যোগাড় করা সম্ভব হয় নাÑ এসব প্রশ্নেও জাতিকে কিছুই জানতে দেন না তিনি। এর কারণ, মুখে অনেক লম্বা কথা শোনালেও এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর মতো ক্ষেত্রে ‘বিপ্লব’ ঘটানোর আয়োজন করলেও বাস্তবে কোনো একটি বিষয়েই পারঙ্গমতা দেখানোর সাধ্য নেই । সাধ্য নেই সরকারেরও। তারা বুঝতেই চান না যে, মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি আয়ের পরিমাণও যখন কমতে থাকে মানুষ তখন কিভাবে বেশি-বেশি টাকা কর দেবে এবং করের পরিমাণ না বাড়লে সরকারই বা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ব্যয় মেটানোর অর্থ কোথায় পাবে। আরো অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নেরও জবাব দিচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেন্ডার বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা পর্যন্ত কেলেংকারী অপ্রতিহতভাবে বেড়ে চলেছেÑ যার ফলে বহু প্রকল্পই অবাস্তবায়িত রয়ে যাচ্ছে। গত অর্থবছরের অনেক প্রকল্পও এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কিন্তু এসব বিষয়ে ঠোটে আঙুল দিয়ে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। তাছাড়া অনেক আশ্বাস শুনিয়ে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ সরকার এখনো গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ জ্বালানির সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর ফলে পণ্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কথা শুধু এটুকুই নয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারলেও সরকার দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোল, অকটেন ও সিএনজিসহ জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় তো বটেই, পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে যথেষ্ট পরিমাণে। সব কিছুর জন্যই শেষ পর্যন্ত বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অর্থাৎ বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও সরকার ক্ষতিকর ব্যর্থতা দেখিয়ে এসেছে। এজন্যই বলা হচ্ছে, চারদিকে শুধু নেই আর নেই-এর মধ্যেও এত বিশাল আকারের বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী চমক সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন সত্য কিন্তু যাদের দোহাই দিয়ে আড়াই লক্ষ হাজার কোটি টাকার বাজেট, সে জনগণ এরই মধ্যে ভীষণভাবে ভীত ও হতাশ হয়ে পড়েছে। আমরা তাই মনে করি, অর্থের চমক দেখানোর পরিবর্তে বাজেটে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিলেই অর্থমন্ত্রী ভালো করবেন। সেটাই তার কর্তব্যও বটে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads