সোমবার, ২৬ মে, ২০১৪

স্বৈরশাসকদের পতন


দেশে অপহরণ, গুম, হত্যা এবং দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি নিয়ে আমরা এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, বাইরের দিকে দৃষ্টি দেয়ার তেমন অবকাশ পাচ্ছি না। আমরা অবকাশ না পেলে কি হবে, বাইরের পৃথিবীতেও রাজনীতি চলছে, অপরাজনীতিও চলছে, চলছে স্বৈরাচারী শাসকদের বিকৃত প্রতাপও। মহাবিশ্বের ছোট্ট গ্রহ পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে আমরা বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর থাকতে পারি না। কারণ একই পৃথিবীর মানুষ হিসেবে অন্য দেশের ঘটনাপ্রবাহও আমাদের জন্য বার্তাবহন করতে পারে। প্রসঙ্গত এখানে মিসরের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইয়েমেনের নারী তাওয়াক্কুল কারমান সম্প্রতি রাজধানী সানায় এক আলোচনা সভায় বলেন, আরব বসন্তের দেশ মিসরে নির্বাচন নয় বরং সৈন্যদের গণতন্ত্র হত্যার নকশা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণ প্রতারিত হতে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যারা গণতন্ত্র রক্ষার পরিবর্তে জাতিকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। উল্লেখ্য যে, মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসিকে অবৈধভাবে অপসারণ করে রাবেয়া স্কয়ারে সমর্থকদের ওপর গণহত্যা চালানোর সময় কায়রো সফরে এসেছিলেন এই নোবেল বিজয়ী। তবে সেনা সরকার তাকে কায়রো বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী কারমান উক্ত আলোচনা সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মুবারকের পতন হলেও জাতি বর্বরতা থেকে মুক্তি পায়নি। তাছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি জাতীয় মোনাফিক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। কেননা তিনি মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বলেছিলেন, সেনাপ্রধান বা সেনাবাহিনী কখনও নির্বাচন করবে না। অথচ তিনি সেই ওয়াদা ভঙ্গ করে নিজেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এক পুতুল নেতাকে দাঁড় করানো হয়েছে, যিনি গণতন্ত্র হত্যায় ব্রাদারহুড কর্মীদের হত্যাকা-কে সমর্থন করে যাচ্ছেন। আর ক্ষমতায় গেলে দলীয় রাজনীতি তুলে দেবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
মিসরের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তাওয়াক্কুল কারমান যে বক্তব্য রেখেছেন তা আমাদের কাছে বস্তুনিষ্ঠ ও যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে। মিসরের বর্তমান স্বৈরশাসক গোষ্ঠী নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করার জন্য নির্বাচনের নামে জনগণকে প্রতারিত করার কৌশল অবলম্বন করেছে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার কাজে বেশ মনোযোগী হলেও জনগণের সমস্যা সমাধান ও আশা-আকাঙ্খা পূরণের ব্যাপারে তাদের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে মিসর দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হচ্ছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটছে মানুষের। এ ব্যাপারে যাতে কেউ কথা বলতে না পারে সে জন্য গ্রহণ করা হয়েছে দমন-পীড়নের নীতি। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের লাগাতার গ্রেফতার করে কারাগার পূর্ণ করছে সরকার। তাই পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, যেখানে গণতান্ত্রিক কোনো পরিবেশ নেই সেখানে গণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন হতে পারে না। জোরপূর্বক হয়তো নির্বাচন করা যায় কিন্তু তাতে জনসমর্থন পাওয়া যায় না।
দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন মিসরের সম্ভাবনাকে যৌক্তিক পর্যায়ে উন্নীত হতে দেয়নি। স্বৈরশাসনের অধীনে জনগণের উন্নতি হয় না, হয় না আশা-আকাক্সক্ষা পূরণও। স্বৈরশাসনে স্বৈরশাসক ও তার পদলেহিরা জাতির সম্পদ লুটেপুটে খায়। এখন আবার সাবেক সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের পদাঙ্কই অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এই পথ যে মিসরের জনগণের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার্স ফোরামের চেয়ারম্যান ও কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ড. ইউসুফ আল কারজাবিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দেড় শতাধিক মুসলিম স্কলার ২৬ মে’র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেয়া পৃথক পৃথক বিবৃতিতে বলেন, গণতন্ত্র হত্যায় মিসরের সেনা অভ্যুত্থান ও পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হারাম। বিবৃতিতে তাঁরা আরও বলেন, সেনাদের ক্ষমতা দখলের অপকৌশলমূলক এই নির্বাচনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ করা আত্মহত্যার সামিল। আমরা মিসরে একদিকে লক্ষ্য করছি, সেনা শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার অপকৌশল, অন্যদিকে লক্ষ্য করছি, মুক্তিকামী জনগণের রক্তঝরা সংগ্রাম। এমন পরিস্থিতিতে মিসরের জনগণ দমন-পীড়নের এক দুর্বিষহ পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে ইতিহাস এ কথার সাক্ষ্য বহন করে যে, দমন-পীড়নের মাধ্যমে জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে দীর্ঘকাল দাবিয়ে রাখা যায় না। অবশেষে স্বৈরশাসকদের পতন হয় এবং জয়ী হয় জনগণের মুক্তি-সংগ্রাম। মিসরের জনগণ ইতিহাসের এই সত্য জানে বলেই স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে অব্যাহত রেখেছে তাদের মুক্তির সংগ্রাম।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads