বিশিষ্টজনরা স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ। পাশাপাশি আমজনতা শঙ্কিত আতঙ্কিত। প্রবাদ আছে, অন্যায় যে করে এবং অন্যায় যে সহ্য করে উভয়ই সমদোষে দোষী-অপরাধী। বিলম্বে হলেও কথিত বিশিষ্টজনরা স্তম্ভিত হতে শুরু করেছেন। সাথে ক্ষুব্ধ মনোভঙ্গির প্রকাশও। সমাজের সুস্থতা এবং কল্যাণের জন্যে একটি শুভলক্ষণ এটি। দীর্ঘ সময় এরা নীরব ছিলেন। দেশের বিশিষ্টজন এবং শিক্ষিত সমাজ যখন অন্যায়-অবিচারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, লালন-পালন করে তখন শান্তি তিরোহিত হয়। অকল্যাণ সমাজকে গ্রাস করে। দেশের সাম্প্রতিক উত্তপ্ত অবস্থা এমন একটা পরিস্থিতিকেই যেন উপস্থিত করছে। বিশেষ করে শাসকশ্রেণীর অগণতান্ত্রিক আচরণ স্বৈরমনোভঙ্গি পরিবার-সংসারের প্রতিটি অংশকেই যখন বিবশ করে তুলছিল তখন এসব বিশিষ্টজনরা ছিলেন শীতল। এই শীতলতা আশ্রয়-প্রশ্রয়কেই ইঙ্গিত করে। পক্ষপাতদুষ্ট এবং পক্ষপাতপুষ্ট বিশিষ্টজনরাও এখন ক্ষুব্ধ। দেশ এবং সমাজের সুস্থতার জন্য শুভ তো বটেই এই ক্ষুব্ধতা।
বাংলাদেশের যা হ-য-ব-র-ল অবস্থা তাতে করে কেবল বিশিষ্টজনরাই নয় বাইরের সভ্য দুনিয়াও স্তম্ভিত-ক্ষুব্ধ। এই ক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশ-দেশের নিরীহ মানুষ। বিপরীতে শাসকশ্রেণীর লোকেরা-মন্ত্রী-এমপিরা ঘোষণা করছে ‘অল-কোয়াইট’। এদের বক্তৃতা ভাষণ শুনলে মনে হয় দেশময় কেবল শান্তির সুবাতাস। আসলে অবস্থা মোটেও স্বস্তির নয়। অস্থিরতা প্রতিটি অঙ্গনে। খুন, অপহরণ, গুম প্রতিদিনকার দৃশ্য এখন বাংলাদেশের। আতঙ্কের দেশ, দুর্ভাবনার দেশ হয়েও উঠে আসছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে সাথে সামাজিক অস্থিরতাও যুক্ত হয়েছে। অপরাধের সংখ্যা এবং অপরাধের ধরন দেখে বিশ্বাস করতে মন চায় না থানা-পুলিশের অস্তিত্ব এ দেশে আছে। অবশ্য একথা সত্য যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে এসব বাহিনীর শৌর্যবীর্যের অভাব থাকে না। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের বেলায় এদের আচরণ প্রশ্নবোধকই থেকে যাচ্ছে প্রায়শই। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এমনটা কথা থাকলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করতে কোনো কোনো সময় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। ব্যতিক্রম তো থাকতেই পারে, আছেও। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাটি দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। এ থেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা যে কতটা নাজুক তা সহজেই অনুমেয়। দিনে-দুপুরে মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে, আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আইনের লোকেরা কিছুই জানে না, বুঝে না। তাহলে এদের কাজ কি-কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজনদের প্রতি নজরদারি করা! নারায়ণগঞ্জ বর্তমানে একটি আতঙ্কের শহরে পরিণত হতে যাচ্ছে। যে শহরে এর আগেও ত্বকি নামের একটি বালক খুন হয়েছিল। সে খুনেরও কোনো সুষ্ঠু বিচার বা তদন্ত হয়নি। হলে হয়তো সাম্প্রতিক সাত খুনে এর প্রভাব পড়তো। কিন্তু পড়েনি। অপরাধীরা আরো দ্বিগুণ সাহসের কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করেছে। যে জন্যে এমন বীভৎসতা। কোনো খুনেরই কূল-কিনারা হয় না, অপরাধী পাকরাও হয় না। এটি অবাক করা বিষয়। এই বিষয় আরো প্রশস্ত হয় যখন ক্ষমতাসীন দলের উচ্চের ব্যক্তিটি থেকে পুচ্ছের ব্যক্তিটি পর্যন্ত ঘোষণা করতে শুরু করে সব খুনাখুনি এবং গুম-অপহরণের জন্য বিরোধীপক্ষ দায়ী। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ বলতে থাকে খুনখারাবীর জন্য ক্ষমতাসীনরাই দায়ী। এই দোষ চাপাচাপির চাপে চিড়াচেপ্টা হচ্ছে নিরীহ জনগণ। নিরাপদ দূরত্বে থাকছে মূল অপরাধী। এই সুযোগে এরা বিপুল উৎসাহে অপরাধ সংঘটিত করতে দ্বিধা করছে না। তাই এরা দ্বিধাহীনচিত্ত। শক্ত খুঁটির কারণেই এরা কোনো কিছুকেই ভ্রƒকুটি করে না। দায়-দায়িত্ব যদি কারো থেকেই থাকে তাদেরকে পাকরাও করা হোক, জনসম্মুখে উপস্থিত করা হোক। একাজটি তো ক্ষমতাসীনরাই পারে। কিন্তু এর কোনো উদ্যোগ-আয়োজনের ব্যবস্থা থাকছে না। কেবলি দোষাদোষির খেলা। যে জন্যে বেশিরভাগ অপরাধ অপরাধী ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর আচরণও থাকছে রহস্যঘেরা। একাকার হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন লোকজনদের মনোভঙ্গির সাথে। এ পরিস্থিতিতে নিরীহ দেশবাসী নিপতিত হচ্ছে হতাশায়, হতবিহ্বল অবস্থায়।
অভিযান চলছে, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, ঘুম ভেঙেছে প্রশাসনের। যদিও ফল শূন্য, কিছু আলামত উদ্ধার ব্যতীত। এই কর্মযজ্ঞ শুরুর দিকে করলে অসুবিধাটা কোথায় ছিল? এখন তো সব শেষ। কবি নজরুলের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় ‘অবসান, নিশাবসান’। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী প্রাথমিক পর্যায়ে তৎপর হলে হয়তো সাতটি প্রাণকে অকালে অপঘাত জীবন দিতে হতো না। সন্তান ফিরে পেতো তার পিতাকে, স্ত্রী তার স্বামীকে পেত জীবিত, মা ফিরে পেত তার প্রিয় সন্তান। কিন্তু এমনটি ঘটেনি। তাছাড়া মূল আসামীও নাকি দেশত্যাগ করেছে ইতোমধ্যে। প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে এর কি সদুত্তর আছে কে জানে? অপরাধমুক্ত থাকবে সমাজ এমনটা কখনো হয় না। প্রত্যাশা সহনীয় পর্যায়। কিন্তু চারপাশের যা পরিবেশ তাতে মনে হচ্ছে এই ‘সহনীয়’ শব্দটি এখন লোপাট হয়ে গেছে। অসহনীয়ও নয় বিষয়টি, বর্তমানে অসহ্যের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এ জন্যে দায়ী আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সার্বিক ব্যর্থতা, এমনটাই সচেতন জনগণের ধারণা। হয়তো এ কারণেই কোনো কোনো বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশে-বিদেশে। দাবি উঠছে বিলুপ্তির, এমন প্রশ্ন উদ্বেগ জাতির জন্য লজ্জার বৈ কি। পত্রিকায়-মিডিয়ায় প্রতিদিন অপরাধের ফিরিস্তি আসে, যা দেশবাসীকে দুর্ভাবনায় ফেলে। আতঙ্কিত করে তুলে। এই আতঙ্কই যেন তামাম দেশকে, জাতিকে গ্রাস করে তুলছে। এই আতঙ্কই যেন তামাম দেশকে জাতিকে গ্রাস করতে উদ্ধত।
অপরাধ হবে না এমন দিব্যি কেউ দিতে পারবে না। সমাজ থাকলে সমাজে অপরাধও থাকবে। বিচার-বিবেচনাও থাকবে। তবে বিচার-বিবেচনা থাকতে হবে ন্যায়ানুগ এবং সুষ্ঠু-সুচিন্তা প্রসূত। এর ব্যত্যয় ঘটলেই বিপদ। যে বিপদের মুখোমুখি এই দেশ এই জাতি। কারণ সুবিবেচনার অভাব সুচিন্তার অভাব। অপরাধ ঘটলেই পত্রিকায় আসে, মিডিয়ায় দৃশ্যমান হয়। অপরাধীর প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ উচ্চারিত হয়। যা স্বাভাবিক কর্মকা-ের মধ্যে পড়ে। শুরু হয় অপরাধী চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া। কোনো কোনো সময় এসব প্রক্রিয়া শুরুতেই হোঁচট খায়, আটকে যায়, আটকে দেয়া হয়। ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়। এরকমটা হয় গোষ্ঠীস্বার্থে, ব্যক্তিস্বার্থে। তাতে করে মূল অপরাধী উৎসাহিত হয়। বৃদ্ধি পায় অপরাধ। তামাম দেশে এরই ধারাবাহিকতা। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন এই ধারাবাহিকতার বাইরে নয়। এ জন্য দায়ী যেমন প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী সর্বোপরি ক্ষমতাসীনদের নীতি-গর্হিত আচরণ। পত্র-পত্রিকা এবং মিডিয়ার লোকেরাও এ ব্যাপারে নিজেদের তফাতে রাখতে পারে না। এসব সংবাদকর্মীর অসত্য এবং বিভ্রান্তকর তথ্য পরিবেশন, উপস্থাপন বিষয়টিকে জটিল করে তুলে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অপরাধসমূহের ব্যাপারে। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলা যায় ‘ যা কিছু হারায় গিন্নী বলে কেষ্টা বেটাই চোর।’ পরবর্তী সময় সত্য যখন প্রকাশ পায় তখন দেখা যায় এখানে কেষ্টার কোন ভূমিকাই ছিল না বিষয়টি ‘সেইমসাইড’। কিন্তু এরই মধ্যে মিথ্যা অপবাদে কেষ্টা বেটার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার একশেষ। কোনো কোনো সংবাদকর্মী এবং মিডিয়ার এ ধরনের আচরণ পীড়াদায়ক তো বটেই। সংবাদ পরিবেশনে এমন জালিয়াতি গোটা সংবাদমাধ্যমটিকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলে। গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিও নি¤œগামী হতে থাকে। ঘৃণা থাকতে পারে, বিদ্বেষ থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সত্য প্রকাশে অনীহা একজন সংবাদকর্মী এবং সংবাদমাধ্যমকে অগ্রহণযোগ্য এবং অপ্রিয়ের তালিকায় নিয়ে ঠেকায়। তাই সমাজে অপরাধ বৃদ্ধি এবং অপরাধমুক্ত রাখতে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে মিডিয়া এবং মিডিয়াকর্মীর ভূমিকাও অস্পষ্ট নয়। এরপরও এদের ভূমিকা নিয়ে অস্পষ্টতার জন্ম দেয় প্রায়শই। বিশেষ করে এদের সততা এবং সুবিবেচনার ব্যাপারে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন নিয়ে কথিত বিশিষ্টজনেরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন, বিলম্বে হলেও। পত্রিকায় বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে। যদিও স্বশরীরে এদেরকে প্রত্যক্ষ করেনি কেউ কোনো প্রকাশ্য প্রাঙ্গণে। এরপরও এদেরকে সাধুবাদ। বরফ গলতে শুরু করেছে তাহলে। আর একশ্রেণীর বিশিষ্ট নাগরিক, যারা দেশ এবং জনগণের ভাল-মন্দে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেন সারাবছর তারাও পথে নেমেছেন, দেশের এই অরাজক পরিস্থিতিকে ধিক্কার জানিয়ে সাত খুনের প্রতিবাদ জানিয়ে। পত্রিকায় বিবৃতির মধ্যে এই প্রতিবাদকে সীমায়িত না রেখে সংসদ ভবনের প্রবেশমুখে এরা মানববন্ধন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তা করতে দেয়নি। হয়তো তাদের দৃষ্টিতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটে থাকবে এ জন্য তাদের এই রুদ্রমূর্তি। প্রকৃত অপরাধীর ব্যাপারে যদি পুলিশের এমন রুদ্রমূর্তি প্রত্যক্ষ করতো দেশবাসী তাহলে কতই না প্রীত হতো জনগণ। তাছাড়া বিশিষ্ট নাগরিকদের এই প্রতিবাদ তো অন্যায়ের বিপক্ষে, অবিচারের বিপক্ষে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তো ন্যায় এবং সত্য-নিষ্ঠাকেই সমুন্নত রাখতে নিয়োজিত। এরপরও এমন অভব্য আচরণের কারণ কী? তারা হয়তো বলতে পারেন এটি প্রশাসনের আদেশ, সরকারের হুকুম। এই হুকুমতো তামিল করতেই হয়। তামাম দেশব্যাপী এমন হুকুমই তামিল করছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যগণ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন