গতকালের পর: ৭ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার ৯০ নং জালকুড়ি পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণীর ছাত্র রমজান শিকদার মাত্র ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণের জন্য খুন হয়। ২৩ নভেম্বর শহরের মাসদাইর আদর্শ স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র সিয়াম আহমেদকে প্রতিবেশী ফারুক মন্ডলের ছেলে মেহেদী হত্যার পর লাশ মুন্সিগঞ্জে নিয়ে ফেলে দেয়। ৮ নভেম্বর গভীর রাতে বন্দরের মদনগঞ্জ শান্তিনগর এলাকায় ডাকাতদের গুলীতে স্কুল ছাত্র সালমান ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।
২১ জানুয়ারী ২০১৪ সোনারগাঁও উপজেলার কাঁচপুর এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় দুই স্কুল ছাত্র জাহিদুল ইসলাম ও সাকিন আলম। ২২ জানুয়ারী একই এলাকার সাদিপুর ইউপির ভারগাঁও বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে অপহৃত স্কুল ছাত্র জাহিদুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৬ জানুয়ারী কাঁচপুর ইউপির বেহাকৈর মোল্লা বাড়ির বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে অপহৃত অপর স্কুল ছাত্র সাকিন আলমের গলাকাটা বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়।
অপহরণের ৩৫ দিন পর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মালিভিটা এলাকার একটি ডোবা থেকে স্কুল ছাত্র রাকিবুল ইসলাম ইমনের (১৪) বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ। ২৯ জানুয়ারি বন্দরে মুক্তিপণ হিসেবে ২ লাখ টাকা আদায়ের জন্য ইমনের আপন চাচাতো ভাই আল আমিনের পরিকল্পনায় অপহৃত হয় ইমন। ওই রাতেই তাকে হত্যার পর লাশ বস্তাবন্দী করে ডোবার পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তরুণ ব্যবসায়ী দেওভোগ মাদ্রাসা এলাকায় রকিকে মাদক ব্যবসায়ীরা কুপিয়ে হত্যা করে।
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রূপগঞ্জের সদর ইউনিয়নের ভিংরাব এলাকা থেকে নাঈম মিয়া (১৪) নামে অপর এক স্কুল ছাত্রের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার ফতুল্লার পিঠালীপুল এলাকায় একটি মোবাইল ফোন নিয়ে মোস্তফা মিয়া (১২) নামে এক স্কুল ছাত্র তারই বয়সী খেলার সঙ্গীদের হাতে খুন হয়। সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুরের একটি দোকান ঘর থেকে অর্ধগলিত অজ্ঞাত (৩০) এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই দিনে মাহফুজ নামের ২ বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। সে ৩ দিন নিখোঁজ ছিল।
৭ ফেব্রুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সোনারগাঁয়ের আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাঈলকে তুলে নিয়ে যায়। ৪ মার্চ ২০১৪ ফতুল্লার একটি ডোবা থেকে মিনা বেগম নামে নিখোঁজ এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৬ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর একটি খাল থেকে সাব্বির নামে নিখোঁজ এক স্কুল ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২২ মার্চ ফতুল্লার কাশীপুর এলাকার একটি ডোবা থেকে শোয়েব হোসেন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৩ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয় ২ ব্যক্তির পচন ধরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসব ঘটনা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে অসংখ্য অজ্ঞাত পরিচয় লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
২৮ মার্চ সোনারগাঁয় সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেনকে এবং একই দিন রূপগঞ্জে স্কুল শিক্ষক মেহেদী হাসানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর ৭ দিন পর ৪ এপ্রিল রূপগঞ্জের বালু নদী থেকে নিখোঁজ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার শিক্ষক রাজীব আহাম্মদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
৩ এপ্রিল দেওভোগ নাগবাড়ী এলাকার একটি ডোবা থেকে শিপলু বেপারী (২৮) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে দুই দিন ধরে নিখোঁজ ছিল। এর আগে ফতুল্লার দেওভোগ মাদ্রাসা রোডের নূর মসজিদ এলাকায় রকিবুল হাসান রনি (২৬) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কাশীপুর ইউনিয়নের আল হোসাইনী মার্কেট সংলগ্ন একটি ডোবা থেকে শোয়েব (২২) নামের এক হোসিয়ারি ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যবসা কেন্দ্র নিতাইগঞ্জের নায়না ফ্লাওয়ার মিলের ভেতর থেকে জবাই করা অবস্থায় নৈশ প্রহরী আবদুল আজিজ এবং হেলপার হোসেন মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই জোড়া খুনের সন্দেহভাজন শ্রমিক আবু তাহেরকে এখনো গ্রেফতারই করতে পারেনি পুলিশ।
৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ কাশীপুরের মধ্য চর নরসিংপুর এলাকার একটি ডোবা থেকে এক অজ্ঞাত নারীর (২০) অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে স্থানীয় সামছুল আলম (৬০) নামে এক মাতব্বরকে হত্যা করে। ১৪ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশ থেকে গলাকাটা যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
১৪ এপ্রিল রাতে ফতুল্লার নবীনগর এলাকার বাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে ইউসুফকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি কড়ইতলা এলাকাতে হাত-পা বাঁধা হাদিস আলী নামে এক ব্যক্তির গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ জানায়, অন্য কোন স্থানে হত্যার পর লাশ লিংক রোডের পাশে ফেলে দেয়া হয়।
১৬ এপ্রিল পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক এই নারায়ণগঞ্জ থেকেই কয়েক দিন আগে গুম হন। সেই গুমের ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে ৩৫ ঘণ্টা পর অপহরণকারীরা তাঁকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু পুলিশ এখনো কোনো অপরাধীকে ধরতে পারেনি অথবা ধরতে চায়নি।
আবু বকর সিদ্দিক উদ্ধার হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জবাসী কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। কিন্তু তাদের সেই স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ২৭ এপ্রিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে নাসিক সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য নজরুলের সঙ্গে অপহৃত হয়েছিলেন তার গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহ-সভাপতি তাজুল ইসলাম, ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ কর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন, লিটন ও তার গাড়ির চালক। ওই দিন বেলা আড়াইটায় নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা শেষে সাদা রঙের এক্স করোলা (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৯১৩৬) গাড়িতে সিদ্ধিরগঞ্জ ফিরে যাওয়ার পথে শিবুমার্কেট এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
একই দিন আদালতপাড়া থেকে আইনজীবী চন্দন সরকারসহ দুজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নজরুলের গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর থেকে এবং আইনজীবীর গাড়ি রাজধানীর নিকেতন থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে তাদের কোনো সন্ধান মিলছিল না।
সবার মনে ক্ষীণতম আশা ছিল যে এতগুলো মানুষকে হয়তো দুর্বৃত্তরা প্রাণে মেরে ফেলবে না। কেউ না কেউ আবু বকর সিদ্দিকের মতো অক্ষত দেহে ফিরে আসবেন। কিন্তু ৩০ এপ্রিল অপরাহ্নে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জের শান্তিনগর ও চর ধলেশ্বরী এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নজরুল, স্বপন, চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমসহ ৭টি ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্গন্ধ সত্ত্বেও নদীপাড়ে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। দুর্গন্ধের উৎস খুঁজে এলাকাবাসী ওই লাশের সন্ধান দেয়। একে একে উদ্ধার করা হয় লাশও।
সংবাদ পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে শত শত লোক বন্দর থানার শীতলক্ষ্যা তীরে যান। স্বজনদের আহাজারিতে শীতলক্ষ্যার তীরে শোকের ছায়া নেমে আসে। সবার কণ্ঠে একই দাবি, নারায়ণগঞ্জবাসী আর কত লাশ দেখবে? আমরা এর প্রতিকার চাই। চাই খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক ১ মে ২০১৪)
কী নির্মম, কী পৈশাচিক! কোনো মানুষকে দিয়ে এমন বীভৎস কাজ হতে পারে, বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু তা-ই হয়েছে। তাদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা জানা না গেলেও মৃতদেহ গুম করার জন্য দুর্বৃত্তরা যে পৈশাচিকতা অবলম্বন করেছে, সেটি দেখা গেল। এক কিলোমিটারের মধ্যে ৭টি লাশের সঙ্গে ২৪টি করে ইট বোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ছিল লাশগুলো। ইটগুলোতে লেখা ‘এমবিবি’। সবার মুখমন্ডল পলিথিন দিয়ে বাঁধা ছিল। পা ছিল দড়ি দিয়ে বাঁধা। হাতও পেছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা। একটি পলিথিন দিয়ে মুখম-ল বেঁধেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, দুটি পলিথিন দিয়ে গলার কাছে শক্ত করে বাঁধা। এতসব করেও হয়তো নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না পিশাচরা। পেট ফুলে যাতে লাশ ভেসে না ওঠে, সেই আশঙ্কায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট সোজাসুজি ফেড়ে ফেলে। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১ মে ২০১৪)
প্রতিটি লাশই ফুলে উঠেছে। পরনের কাপড়, বিশেষ চিহ্ন আর শরীরের গড়ন দেখে স্বজনেরা লাশ শনাক্ত করেন। লাশ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তাঁরা।
সাত সাতটি মানুষ শহর থেকে হারিয়ে গেছেন অথবা হারিয়ে ফেলা হয়েছে। সবার জিজ্ঞাসা-এরপর কে? এভাবেই কি নারায়ণগঞ্জ শহর চলবে? একদা সন্ত্রাসের জনপদ বলে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ কি ফের গুম, খুন আর অপহরণের চারণভূমিতে পরিণত হবে? খুনির সর্বনাশা ছোবল শুধু নজরুলগং খুন করেনি, হৃদয় ঝাঁঝরা করে দিয়েছে তাঁদের স্ত্রী-পুত্রদের। একে একে লাশ ভেসে উঠছে। একে একে তাঁদের পরিচয় মিলছে। পরিচয় বলছে, এঁরা সেই মানুষ, যাঁদের চার দিন আগে অপহরণ করা হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। এঁরা বাংলাদেশের নাগরিক। রাষ্ট্র যাঁদের চার দিনেও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
গুম হওয়া নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের লাশ শীতলক্ষ্যা থেকে আনা হয় ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। পিতৃহারা দুই সন্তান তরিকুল (বাঁয়ে) ও জাহিদুল আর তাঁদের মা স্বামীহারা সেলিনা ইসলাম হাসপাতালে মৃতদেহ সনাক্ত করেন।
শীতলক্ষ্যা নদীতে সেই সাতজনের মধ্যে ছয়জনের লাশ পাওয়ার খবরে বিক্ষুব্ধ হয়েছে এলাকাবাসী। নদীর তীরে স্বজনদের আহাজারি আর বুকফাটা কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে আসে। শত শত নারী-পুরুষ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষমাণ ছিলেন। জীবিত মানুষ নয়, লাশের অপেক্ষা। নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বারবার একজন সংসদ সদস্যের নাম ধরে সবার কাছে প্রশ্ন রাখেন, কেন তিনি তাঁর স্বামীকে এভাবে মেরে ফেললেন?
নজরুলের স্ত্রী স্বামী অপহরণের পরপরই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেন এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ ইয়াসিনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। নজরুলের পরিবারের করা মামলায় তাদের আসামীও করা হয়েছে। এরা সবাই শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। (সূত্র : দৈনিক সমকাল ১ মে ২০১৪)
সেলিনা বলছিলেন, ‘আগের দিন গিয়া শামীম ওসমানরে কইয়া আইছে, ভাই, আমার কোর্টে হাজিরা আছে, আপনি দেইখেন, সেভ কইরেন। এমন দেখা দেখল। এমনভাবে মারল...।’ তিনি বলেন, ‘তিন দিন ধরে আমার স্বামী নিখোঁজ ছিল। পুলিশ তাঁদের উদ্ধারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা বারবার বলেছি, নূর হোসেনকে গ্রেপ্তার করলেই আমার স্বামী ও তাঁর বন্ধুদের ফিরে পাওয়া যাবে। কিন্তু পুলিশ আমাদের কথায় কোনো কর্ণপাত না করে সময়ক্ষেপণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, ঘটনার পর মামলা করতে গেলে পুলিশ ধৈর্য ধরার কথা বলেও মামলা নিতে গড়িমসি করে। এ সুযোগে নূর হোসেনসহ অন্য আসামীরা পালানোর সুযোগ পায়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার বিচার চাই।’
বেসরকারি টিভি সাংবাদিকদের কাছে বিলাপ করতে করতে তিনি তার স্বামীকে হত্যার জন্য শামীম ওসমানকে দায়ী করে বলেন, ‘শামীম ওসমান তুই কেমনে মারলি আমার স্বামীকে, তুই কোনদিন কবরে যাবি না।’ সেলিনা শামীম ওসমানকে উদ্দেশ করে বলেন, তুই আমার স্বামীকে এমনই সেফ রাখলি যে একেবারে কবরে পাঠিয়ে দিলি।’ (সূত্র : দৈনিক আমার দেশ ১ মে ২০১৪)
নিহত নজরুল ছিলেন সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা। আবার তাঁর হত্যার দায়ে যার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে, সেই নুর হোসেনও একজন কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগের নেতা। নুর হোসেন ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হলেও এখনও সিদ্ধিরগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষ তাকে ‘হোসেন চেয়ারম্যান’ হিসেবেই চেনে। নূর হোসেনের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, দখল, অবৈধ বালু ও পাথর ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ইজিবাইকের চালকদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আছে। এমনকি তার লোকজন লঞ্চ থেকেও চাঁদা আদায় করে।
শিমরাইল টেকপাড়া এলাকার মৃত হাজি বদরউদ্দিনের ছেলে নূর হোসেন। ১৯৮৬ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার হিসেবে কর্মজীবন। ১৯৮৮ সালের দিকে শিমরাইলে আন্তঃজেলা ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রম চালু করেন দাইমুদ্দিন নামের এক ট্রাকচালক। ১৯৮৯ সালের দিকে শ্রমিক ইউনিয়নের দখল নেন নূর হোসেন। যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে হয়ে যান বিএনপি নেতা। ১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেনসহ ১৩ জন। শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলামকে পরাজিত করতে মাঠে নামেন সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন।
দুই-আড়াইশ’ ভোটের ব্যবধানে নূর হোসেন জয়ী হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি প্রার্থী হিসেবে পরবর্তী ইউপি নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেন। আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমান প্রার্থী দেন নজরুল ইসলামকে। ওই সময়ে গিয়াসউদ্দিন জোরেশোরে নূর হোসেনের পক্ষে মাঠে নামলেও জয়ী হয়ে হাত মেলান শামীম ওসমানের সঙ্গে। হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা।
মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ৩০ এপ্রিল ঢাকায় গিয়েছিলেন একটি মামলার ব্যাপারে। তিনি যাতে ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করতে না পারেন, সে জন্য তাঁর ভাইসহ পাঁচজনকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মিথ্যা মামলা দিয়ে। সেলিনা হায়াৎ আইভী বললেন, ত্বকী হত্যার বিচার হলে নারায়ণগঞ্জ থেকে এতগুলো মানুষ লাশ হয়ে ফিরতেন না। (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ১ মে ২০১৪)
নির্মম হত্যাকা-ের রহস্য উদঘানে বেশীর ভাগ সময়ে পুলিশ প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বড়ায় এলাকায়। খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক লাশ পড়তো না। নারায়ণগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটছিল অনেক দিন আগে থেকেই। অথচ নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন ও পুলিশ নির্বিকার।
জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়ালের সময়ে নারায়ণগঞ্জে যে একের পর এক খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, কোনো প্রতিকার হয়নি, আসামী ধরা পড়েনি, এসবকেও তিনি ব্যর্থতা বলে মনে করেন না। জেলা প্রশাসক নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, তিনি কখনোই কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি, করবেন না। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকের দাবি, তিনি পদে পদেই প্রভাবশালীদের সঙ্গে আপস করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের বিদায়ী এসপি সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেছেন, এটি অপহরণ কি না, তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। কেননা, এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি।
সাতজনের হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকা থেকে আবারও অপহৃত হয়েছেন সাইফুল ইসলাম (৪০) নামে এক ব্যবসায়ী। ১ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনার পর সকালে অপহৃতের স্ত্রী আফরীন সুলতানা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেছেন। তিনি জানান, সাইফুলের সঙ্গে কারো কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। রাত সাড়ে ৯টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড থেকে তিনি নিখোঁজ হন। পরে দোকানের ম্যানেজার আবদুল হান্নানের কাছে অপহরণকারীরা ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। শেষ পর্যন্ত ২ মে সাইফুল সাভার থেকে উদ্ধার হয়েছেন।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড এখন এলাকাবাসীর কাছে আতঙ্কের রাজপথে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাড়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাঁচ কিলোমিটার সড়কের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এখানে ঘটছে ছিনতাই, অপহরণ ও হত্যাকা-ুু। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত অপহরণ দুটিও ঘটেছে এই সড়কে। এরপরও এই সড়কটিতে প্রশাসনের নেই কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। (সমাপ্ত)
জিবলু রহমান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন