দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বোধহয় আরো কিছুদিন নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ও ফেনীর একরামুল হক হত্যার ঘটনা নিয়ে সরব থাকবে। একই দলের নেতা-কর্মীরা কী করে এতদিনের সঙ্গী-সাথীদের এমন নির্মমভাবে হত্যা করে, তা ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। হত্যার আগে তো ভাবতে হয়, পরিকল্পনা করতে হয়, উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করতে হয় এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কি মানুষের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটতে পারে না? আবারো বিস্ময়মিশ্রিত কণ্ঠে উচ্চারণ করতে হয়, এরাও মানুষ? পরিতাপের সাথে বলতে হয়, আমাদের সমাজে এখন এরা শুধু মানুষ নয়, প্রতাপশালী মানুষ! কারণ এরা রাজনীতি করেন এবং সমাজ ও দেশ পরিচালনা করেন। জনমনে আজ তাই প্রশ্ন, এমন রাজনীতি ও রাজনীতিকদের দেশ ও জাতির কোনো প্রয়োজন আছে কী? কাক্সিক্ষত রাজনীতি ও রাজনীতিকদের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে এ জনপদ। কারণ ভাল লাগার মতো রাজনীতি ও রাজনীতিকরা তো এক সময় ছিলেন আমাদের এই প্রিয় জনপদে।
দেশের মানুষ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সঠিক বিচার চায়, বিচার চায় ফেনীর একরামুল হক হত্যাকা-েরও। কারণ নির্মম ও নিষ্ঠুর এইসব হত্যাকা-ের উপযুক্ত বিচার না হলে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করা যাবে না। দেশের সাধারণ মানুষ আপন অভিজ্ঞতায় ইতোমধ্যে এই বিষয়টি বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, তাদের দুঃখ ও সর্বনাশের প্রধান কারণ হলো দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি উন্মূল করার ব্যাপারে জাতি হিসেবে আমরা কতটা প্রস্তুত? প্রস্তুতির প্রসঙ্গ এলে প্রধান দায়টা বর্তায় সরকার ও প্রশাসনের ওপর। এরপর দায় বর্তায় রাজনীতিবিদ, সমাজ-নেতা ও নাগরিক সমাজের ওপর। নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের কে কতটা দায়িত্ব পালন করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
প্রথম আলোর ২৭ মে সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘পরিকল্পনাকারীরা আড়ালে, অপহরণকারীরা চিহ্নিত।’ এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নারায়ণগঞ্জে ৭ জনকে অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও খুন এবং লাশ গুমের সঙ্গে কারা সরাসরি যুক্ত ছিল, সে জায়গায় এসে আটকে আছে তদন্ত কাজ। একইভাবে নৃশংস এই হত্যাকা-ের নেপথ্যে ও পরিকল্পনায় কে বা কারা জড়িত, তাও সাক্ষ্য-প্রমাণসহ চিহ্নিত করা যায়নি। ফলে এখন পর্যন্ত তারা কার্যত আড়ালেই রয়ে গেল। এই মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগের পক্ষেও শক্ত তথ্য-প্রমাণ জোগাড় হয়নি বলে জানিয়েছে তদন্ত সূত্র। নূর হোসেন গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি নিয়েও শঙ্কায় আছেন তদন্তকারীরা। এদিকে ২৭ মে প্রথম আলোতে মুদ্রিত অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হককে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী কে বা কারা, তা এখনও বের করতে পারেনি পুলিশ। তবে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ফেনীর আলোচিত- সমালোচিত দুই হাজারীকেই সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। এ দুজন হলে ফেনী-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারী ও সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী। নিজাম জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আর জয়নাল সাবেক সাধারণ সম্পাদক। লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্যান্য ঘটনার মতো নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর ঘটনায়ও পদাতিকদের নাম জানা গেলেও মূল হোতা ও পরিকল্পনাকারীরা এখনও আড়ালেই রয়ে গেছেন। অথচ এদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা না হলে সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দেশ থেকে দূর হবার নয়।
দেশে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের পদস্খলনের কারণে সময়ের আবর্তনে দুর্বৃত্তায়নের শিকড় রাজনীতির গভীরে প্রোথিত হয়েছে। দেশে আইনের শাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা ফেনীর ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা যায়। দৈনিক নয়া দিগন্তের ২৬ মে সংখ্যায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একরাম হত্যার ষড়যন্ত্র আগে থেকেই জানতো পুলিশ ও গোয়েন্দা শাখার কিছু সদস্য। সালাম কমিউনিটি সেন্টারে সর্বশেষ চক্রান্তেও এক পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হত্যাকা-ের সময় মাত্র ৩০০ গজ দূরে পুলিশের একটি গাড়ি থাকলেও তারা একরামকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। একরামের গাড়ির ড্রাইভার ফিরোজ ওই পুলিশ সদস্যদের পায়ে ধরেছেন। বলেছেন, একরাম চেয়ারম্যানকে বাঁচান, কিন্তু তারা অন্যত্র চলে যায়। এছাড়া হত্যাকা-ের আগে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা ওই এলাকা ঘুরে যান। আবার হত্যাকা-ের পরে তিনিই সর্বপ্রথম ওই এলাকায় যান। এসব কারণে পুলিশের ওইসব সদস্যদের ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এমন বাতাবরণে কীভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে কিংবা বন্ধ হবে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির সিংহদ্বার?
আমাদের রাজনীতির বর্তমান দুরবস্থার জন্য নিশ্চয়ই ভীন গ্রহের কেউ দায়ী নন। এদেশের রাজনীতির ভালো-মন্দের জন্য এদেশের রাজনীতিকরাই দায়ী। তাই রাজনীতিকদের পদ-পদবি, অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার চাইতেও দেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের আমলনামা। এই প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলায় এজাহারভুক্ত দ্বিতীয় আসামী ইয়াছিন মিয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইয়াছিন মিয়া ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অবশ্য সাত খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় তাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এমন একজন ব্যক্তি আওয়ামী লীগের মতো একটি সংগঠনের নেতা হলেন কিসের ভিত্তিতে? তার আমলনামা বিবেচনা করে যোগ্যতার ভিত্তিতেই কি তাকে নেতা নির্বাচন করা হয়েছিল? প্রথম আলোর ২৬ মে সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়, ইয়াছিন মিয়া ছিলেন ‘ডাকাত দলের সদস্য।’ জনশ্রুতি আছে, নিজের গ্রাম ও মহাসড়কে যানবাহনে ডাকাতি করতেন তিনি। এক পর্যায়ে রাজনীতিতে আসেন। আয়ের মূল উৎস হয়ে ওঠে ঠিকাদারির কমিশন আর চাঁদাবাজি। কিন্তু বরাবরই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিহত নজরুলের পরিবারের দাবি, কোটিপতি ইয়াছিন সপরিবারে সিঙ্গাপুরে পালিয়েছেন। আর নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের ভাই আব্দুস সালামের অভিযোগ, ইয়াছিন গত ৫ বছরে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এমন উদাহরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, দেশে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি কতটা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের প্রশ্রয় কিংবা সহযোগিতা ছাড়া তো ইয়াছিন এত বিপুল অঙ্কের টাকার মালিক হতে পারেননি?
দেশের রাজনীতিতে যে অশনিসঙ্কেত দেখা দিয়েছে তার গভীরতা আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা কতটা উপলব্ধি করছেন, তা আমরা জানি না। অর্থ-সম্পদ, পদ-পদবি ও দাপট জনকল্যাণমূলক রাজনীতির মূল বিষয় হতে পারে না। জনকল্যাণমূলক রাজনীতির জন্য প্রয়োজন জনকল্যাণে পারঙ্গম, ত্যাগী ও নৈতিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মননশীল রাজনীতিবিদ। এ কারণে এখন রাজনীতিবিদদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাল্টানো প্রয়োজন। আর শুধু সরকারি দলেরই নয়, সব দলেরই নেতা-নেত্রীদের আমলনামা পর্যালোচনা করে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা এখন দেশ ও জনগণের স্বার্থে জাতীয় জরুরি বিষয় হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দায়িত্ব পালিত না হলে শুধু কথামালার গুণে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিষয়টি আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা কতটা উপলব্ধি করেন ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে আন্তরিকতার পরিচয় দেনÑসেটাই এখন দেখার বিষয়। নয়তো জনগণের অন্তরের ক্ষোভ ঘনীভূত হয়ে যখন বিস্ফোরণে রূপ নেবে, তখন হয়তো চাইলেও সংশোধনের আর সময় পাবেন না দায়িত্বহীন মহল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন