বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৩

দাসত্বের কেবলা পরিবর্তনের জন্য আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করিনি



দেশে এখন যা চলছে তাতো জনগণের কাম্য নয়। দেশে এখন যা চলছে তাতো স্বাধীনতার স্বপ্ন নয় দেশে এখন যা চলছে তা শুধু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয় শুধু হিংসা-বিদ্বেষ নয়, তার চাইতেও বেশি কিছু। এ অবস্থায় জনগণ পাথরে মাথা ঠুকলেও কারো যেন কিছু আসে যায় না। একের পর এক জুলুম-নির্যাতন, হত্যা ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটলেও এসবের নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিবিধানে যেন কার্যকর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়, জনগণ বিচার পায় না। হলমার্কের কেলেঙ্কারি হয় তারও কোনো কিনারা হয় না। রেলমন্ত্রী কালো বিড়াল হয়, সেও আর সাদা হয় না। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে জাতির মাথা নত হয়, কিন্তু জাতির মাথা উন্নত করার ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এতসব অবিচারের মধ্যেও জাতি অন্তরে সুবিচারের আকাক্সক্ষা লালন করতে চায়, কিন্তু তাতেও বাধার দেয়াল নির্মাণে এগিয়ে আসে ক্ষমতাপাগল রাজনীতি। এমন অবস্থায় স্বপ্ন দেখার প্রাণশক্তি জনমনে আর কতটা অবশিষ্ট থাকবে, তেমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে দেশে ঐক্য-সংহতি ও কর্মসংস্কৃতির বদলে হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণার সংস্কৃতিকে উস্কে দেয়া হচ্ছে গণতান্ত্রিক চেতনার বদলে হামলা-মামলা ও ছল-চাতুরির কৌশলে প্রতিপক্ষকে দমনের প্রহসন লক্ষ্য করছে জনগণ যুদ্ধাপরাধের বিচার তো চলছিলোই, একের পর এক ঘোষিত হচ্ছিল। কিন্তু এমন অবস্থায় শাহবাগে নির্মিত হলো এক মঞ্চ। ঐ মঞ্চ থেকে বিচারকে ডিক্টেড দুঃসাহস দেখানো হলো। বিচার নয় শুধুই ফাঁসি চাওয়া হলো, আর সাথে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হলো সমগ্র দেশে। কিছু মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী ঘৃণ্য ঐ বার্তাকে উস্কে দিলো। এর পরিণতি যে কি হতে পারে তা বিবেচনা করলো না অপরিণামদর্শী শাহবাগ মঞ্চের মন্ত্রণাদাতারা। শাহবাগ মঞ্চের আস্ফালনের প্রতিক্রিয়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা দিল গণবিক্ষোভ ও গণমিছিল। এরপর গুলী হলো, গণহত্যা হলো, দেশের পরিস্থিতি আরো জটিল হলো। তবুও শাহবাগিদের আস্ফাালন বন্ধ হলো না। সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তাদের নিত্য-নতুন ফরমান জারি অব্যাহত রইলো। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়ার কল্যাণে এই বিষয়টিও স্পষ্ট হলো যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের আড়ালে শাহবাগ মঞ্চের ব্লগার নেতৃবৃন্দের আসল উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামী শক্তিকে বিভিন্ন কুৎসায় জর্জরিত করে দেশে নাস্তিক্যবাদের প্রসার ঘটানো। বহুদিন ধরে তারা আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলো। এমন অবস্থায় দেশের আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ তাওহিদী জনতা হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। যার বিস্ফোরণ লক্ষ্য করা যায় ৬ এপ্রিলের লংমার্চ ও শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশে। নাস্তিক ব্লগার, ঘাদানিক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও শাহবাগিদের হরতাল প্রতিরোধ এবং সরকারের নানা বাধার কৌশল ডিঙিয়ে হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে লাখ লাখ মানুষের ঐতিহাসিক সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে প্রমাণ করে যে, শাহবাগ চত্বরের ক্ষুদ্র মঞ্চটাই বাংলাদেশ নয়, এর বাইরে রয়েছে এক বিশাল বাংলা। শাপলা চত্বরের বিশাল সমাবেশ তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। সেই দাবি নিয়ে এখন পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ঐসব দাবি কখন কিভাবে কতটা বাস্তবায়ন হবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু ৬ এপ্রিল খামার বাংলার আলেম-ওলামা ও কৃষক-শ্রমিকের সন্তানরা যেভাবে নিজেদের ঈমান-আকিদা ও আশা-আকাক্সক্ষার বার্তা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে প্রতিধ্বনিত করেছে তাতে এই জনপদের প্রকৃত পরিচিতি আরেকবার উন্মোচিত হয়েছে। তারা স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে আল্লাহ-রাসূল ও ইসলাম অবমাননা চলবে না, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপরও কোনো রকম হামলা বরদাশত করা হবে না।
ধর্ম ও স্বাধীনতার এ আন্দোলন এই জনপদে নতুন কোনো বিষয় নয়। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে আমরা যেমন এ আন্দোলন লক্ষ্য করেছি, তেমনি সে আন্দোলন এখন আমরা লক্ষ্য করছি স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা এ বিষয়টিও লক্ষ্য করেছি যে, খামার বাংলা জনগণের ধর্ম চেতনা ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে বৈরি আচরণ করেছে বর্গীরা, আগ্রাসী শাসন === যখনই খামার বাংলার শাসক-প্রশাসকরা সুশাসনে ব্যর্থ হয়েছে, জনগণ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভক্ত হয়েছে তখনই খামার বাংলার স্বাধীনতা ও প্রগতিকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করেছে ষড়যন্ত্রকারী দেশী-বিদ্বেষী শক্তি। তেমনি এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্তে প্রায় প্রতিদিন বিএসএফ গুলী করে মানুষ মারে। ফেলানিরা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকে। বাংলাদেশের নাগরিকদের ইচ্ছে হলে ধরে নিয়ে যায় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী। সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশী নাগরিকদের জান-মাল ও ইজ্জত এখন আর নিরাপদ নয়। প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এখন হুমকির মুখে, স্বাধীন পতাকার মর্যাদা এখন প্রশ্নের মুখে। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গত ভূমিকা লক্ষ্য করছে না জনগণ। জয়বাংলা ও স্বাধীনতা শ্লোগানে পঞ্চমুখ যে শাহবাগ মঞ্চ, তারাও এ ব্যাপারে বিস্ময়করভাবে নীরব! বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এ ব্যাপারে আশানুরূপ ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়নি। এমন অবস্থায় সুযোগ সন্ধানীরা অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে বেরিয়ে আসে। যেমনটি বেরিয়ে এসেছেন ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দি নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, গত ৭ এপ্রিল এক আলোচনা সভায় বিচারপতি কাটজু বলেন, ‘সত্যিই এক জাল রাষ্ট্র পাকিস্তান। এ কারণে এই পাকিস্তান, ভারত আর বাংলাদেশ মিলে এক রাষ্ট্র হবে আবার। হয়তো  ১৫-২০ বছর লাগতে পারে। তবে যারা আমাদের ঐক্য ভেঙ্গেছে, তারা সহজে ফের এক হতে দেবে না। তারা এখনও চায় আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাই। তবে নিশ্চয়ই আধুনিক মন-মানসিকতা নিয়ে আমরা ফের ১৫-২০ বছরের মধ্যে এক হব’। ভারতীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক লক্ষ্য কি তা আমরা কম-বেশি জানি। ভারতীয় রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণবান্ধব তার সমালোচনামূলক বর্ণনা আমরা ভারতীয় গণমাধ্যমে দেখতে পাই। প্রায়ই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তে ভারতের বর্ণাঢ্য পতাকা যে কলঙ্কিত হয় তাও পৃথিবীর মানুষ জানে। এখন সেই ভারতেরই একজন প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব ও বিচারপতি প্রতিবেশী দুইটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আগ্রাসন চালালেন। আমরা ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের কথা হয়তো ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু বিচারপতি মহোদয় ভোলেননি। তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখ--ভারতে লীন হয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করলেন। তিনি পাকিস্তানকে একটি জাল রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলেন। পাকিস্তান একটি জাল রাষ্ট্র কি না সে কথার জবাব পাকিস্তানিরাই ভালো দিতে পারবেন। তবে বাংলাদেশ যে, পি-ির গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে দিল্লীর দাসত্ব বরণের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ করেনি, সেকথা নানাভাবে বহুবার উচ্চারণ করেছে এদেশের নেতা-নেত্রী আর জনগণ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিকে মজবুত এবং জাতির মর্যাদাকে মহীয়ান ও গরীয়ান করে তুলতে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। সেই চেতনা এখনও বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রয়েছে। শুধু এক টুকরো জমিনের জন্য কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধ করেনি। স্বাধীন ভূ-খ-ে জনগণের বোধ-বিশ্বাস, আশা-আকাক্সক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জীবন লালনের মাধ্যমে উন্নত জীবন অর্জনের লক্ষ্যই হলো মূলকথা। এমন স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তার বোধ থেকেই আমাদের পূর্ব-পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত থেকে আলাদা হয়েছিল, স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল পাকিস্তানি শাসকদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এমন চেতনায় লালিত বাংলাদেশের জনগণ কী করে আবার ভারতের অধীনতার নাগপাশে বন্দী হবে? তাই বলতে হয়, বিচারপতি কাটজুর অখ- ভারতের স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। আপাতত তার বোধোদয়ের জন্য কবিতার ভাষায় বলতে পারি ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়, দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়’?
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান সংকটকে ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনগণ আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ ও রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির ব্যাপারে উদার মনে সৎ ভাবনার পথে হাঁটা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি এপথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জনপদের মানুষ সবসময় ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। এ দু’টি চেতনা এই জনপদের মানুষকে সবসময় প্রাণবন্ত রেখেছে। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের গণমানুষের মানস-জগতে এ দু’টি উপাদানকে অনেকেই অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে। তবে যারাই অগ্রাহ্য করেছে তারাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সেই ভুল পথে এখন হাঁটছে শাহবাগ মঞ্চের পথিকরা এবং ব্যতিক্রম নন ভারতের বিচারপতি কাটজুও। আমরা আশা করবো, বাংলাদেশ সরকারে এখন যারা প্রতিষ্ঠিত আছেন তারা এবং এদেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার নেতা-কর্মীরা বিষয়টি উপলব্ধি করবেন। নিজ নিজ জায়গায় সবাই দায়িত্ব সচেতন হবেন। তাহলে আশা করা যায়, বর্তমান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট থেকে দেশ মুক্তি পাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads