রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

অনশন ধর্মঘটে মাহমুদুর রহমানের লক্ষ্য ও সরকারের ঝুকি


শফিক রেহমান

এই মুহূর্তে দুটি সম্ভাব্য এবং একটি চলমান ঘটনার প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ আছে।
এক. ২৭ এপৃল ২০১৩-তে সরকারি প্রেরণায় ঢাকায় সম্ভাব্য নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের মহাসমাবেশ যেখানে তারা হেফাজতে ইসলামের অরিজিনাল তের দফা দাবির (মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিসহ) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবে।
দুই. ৫ মে ২০১৩ তে হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত সম্ভাব্য ঢাকা অবরোধ যেখানে তারা তাদের দাবি আদায়ে অনড় অবস্থানে থাকবে (আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভাষায় এবার তারা “লেঙ্গুর গুটাইয়া পলাইয়া” যাবে না)। তারা প্রমাণ করবে কে বাঘ? কে বিড়াল? হেফাজতে ইসলাম নাকি আওয়ামী সরকার?
তিন. আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বর্তমানে জেলবন্দী মাহমুদুর রহমানের চলমান অনশন ধর্মঘট, তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের সম্ভাবনা এবং তার মৃত্যু হলে সরকারের ঝুকি।
গ্রেফতার ও রিমান্ড
গত ১১ এপৃল ২০১৩-তে সকাল নয়টার দিকে কারওয়ান বাজারে ইস্পাত ভবনের এগারো তলায় মাহমুদুর রহমানের অফিস থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, উসকানিসহ তিনটি অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ মিনিট অপারেশনের পর মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি অফিসে। সেদিন তাকে নিম্ন আদালতে হাজির করে পুলিশ ২৪ দিনের রিমান্ড চায়। মাহমুদুর রহমান আদালতে নিজের পক্ষে শুনানিতে বলেন, “মাননীয় আদালত, আমাকে যেসব অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তা শতভাগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার বিরুদ্ধে সরকার উত্থাপিত অভিযোগ নির্লজ্জ মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। আলোচিত স্কাইপ কেলেংকারির দায় স্বীকার করে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের পদত্যাগের পর আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের কোনো সুযোগ নেই। এ মামলা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও সরকারের সাজানো হওয়ার পরও আপনি আমাকে জামিন দিতে কিংবা সরকারের রিমান্ডের আবেদন বাতিল করতে পারবেন না। কাজেই আপনার কাছে জামিনের প্রার্থনা জানিয়ে শুনানি করা বৃথা চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।”
ব্যক্তিগতভাবে মাহমুদুর রহমান আদালতে তার পক্ষে শুনানির জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেননি। তবে তার পক্ষে আদালতে বহু আইনজীবী হাজির হন।
সরকারপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শেষ হলে অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, মাহমুদুর রহমান নিজেই তার পক্ষে শুনানি করবেন।
আদালতের অনুমতি নিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, “বিচারপতির স্কাইপ সংলাপ নিয়ে সরকার পক্ষের আইনজীবী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সর্বৈব অসত্য ও ভিত্তিহীন। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বেআইনিভাবে তার প্রবাসী বন্ধু ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে স্কাইপের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে যেসব কথা বলেছেন তা বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রিকা দি ইকনমিস্ট প্রকাশ করে। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ইকনমিস্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন, যা এখনও বিচারাধীন রয়েছে। ইকনমিস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনই সাংবাদিকতার সব নিয়মনীতি অনুসরণ করে আমার দেশ প্রকাশ করে। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের বিষয়ে হাই কোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক রুল জারি করেছেন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের ওই আদেশ ও রুল সুপৃম কোর্টের আপিল বিভাগ স্থগিত করে দিয়েছেন। আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ বহাল থাকা এবং ইকনমিস্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রুল বিচারাধীন থাকায় সরকার আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারে না। এ মামলার কোনো কার্যকারিতাও নেই। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম স্কাইপ সংলাপের দায় স্বীকার করে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন। যেহেতু তিনি তার বেআইনি কথোপকথন স্বীকার করে নিয়েছেন, তাই আমার বিরুদ্ধে করা এ মামলা চলতে পারে না।”
দেশটাই আজ সরকারের বৃহত্তর কারাগার
তেজগাও থানায় দায়ের করা অপর দুটি মামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের কারণে সরকার আমার বিরুদ্ধে গত ১৩ ডিসেম্বর মামলা করে। ওইদিন থেকেই আমি অফিসে অবরুদ্ধ জীবন কাটাই। অফিসে অবরুদ্ধ থেকে আমি ফার্মগেট এলাকায় গিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি ভাংচুর করলাম কিভাবে? সরকার তার ফ্যাসিবাদী চরিত্র প্রকাশ করতে গিয়ে এতটা উম্মাদ হয়েছে যে, সব কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছে। এ মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তাছাড়া শুনলাম, এ মামলা দুটির এজাহারেও আমার নাম নেই। আমাকে তড়িঘড়ি করে আটক দেখিয়েই রিমা-ের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। গোটা দেশের মানুষ সরকারের জুলুম নির্যাতনের শিকার। দেশটাই আজ সরকারের বৃহৎ কারাগারে পরিণত হয়েছে।”
আজ্ঞাবহ বিচার বিভাগ
তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ না করার কারণ উল্লেখ করে আদালতে তিনি বলেন, “মাননীয় আদালত, বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও বিচারকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ নেই। সরকার বিচার বিভাগকে তার আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আমি কোনো আইনজীবী নিয়োগ করলে তারা আপনার কাছে আমার জামিনের আবেদন ও রিমান্ড বাতিলের প্রার্থনা করবেন। কিন্তু আপনি তাদের আবেদন মঞ্জুর করে আমাকে জামিন দিতে পারবেন না। আবার রিমান্ডও বাতিল করতে পারবেন না। আপনার হাত-পা বাধা। সরকারের নির্দেশের বাইরে গিয়ে স্বাধীন বিচারিক মানসিকতা থেকে বিচার করার সুযোগ নেই। আমি আইনজীবী নিয়োগ করলে যা হবে, না করলেও একই ফল হবে।”
উভয় পক্ষের শুনানির পর ম্যাজিস্ট্রেট সহিদুল ইসলাম বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ সংক্রান্ত মামলায় সাত দিন এবং গাড়ি ভাংচুর ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়া সংক্রান্ত দুটি মামলায় তিন দিন করে মোট ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডের আরেক নাম টর্চার
প্রকাশ্য স্থানে মাহমুদুর রহমানের এটাই এখন পর্যন্ত শেষ কথা।
ওই দিনই পুলিশ তাকে আবার নিয়ে যায় রমনা থানার কাছাকাছি অবস্থিত ডিবি অফিসে যেখানে এর আগেও মাহমুদুর রহমানের যাবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
শুরু হয় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ। ডিবি অফিসের সামনে সমবেত সাংবাদিকবৃন্দ থেকে শুরু করে আমার দেশ পত্রিকার পাঠক এবং দেশজুড়ে মাহমুদের ভক্তরা উদ্বিগ্ন থাকেন। মাহমুদকে কি শারীরিক নির্যাতন করা হবে? ওয়ান-ইয়েলেভেনের পর রিমান্ড তো টর্চারের আরেক নাম হয়ে দাড়িয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেন, না, এবার মাহমুদকে টর্চার করা হবে না। কারণ? কারণ গতবারের তুলনায় মাহমুদ এখন আরো বিশাল ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হয়েছেন। যে মাহমুদ তার রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদের বিএনপি সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা রূপে এবং ওয়ান-ইলেভেনের পরে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, উভয়েরই মুক্তির দাবিতে জোরালো কলাম লিখেছিলেন দৈনিক নয়া দিগন্তে, পরবর্তীতে তিনি হয়েছিলেন দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তার তৎকালীন ভিত্তি ছিল বিএনপি ও তার সমর্থক দলের মধ্যে।
সাম্প্রতিক কালে এই ভিত্তি প্রসারিত হয়। যারা রাজনীতি করেন না তেমন মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যেও তার প্রভাব ও প্রিয়তা বিস্তৃত হয়। হেফাজতে ইসলাম তাকে ইসলামের অন্যতম নির্ভীক রক্ষক রূপে গ্রহণ করে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে মাহমুদ ফ্যাক্টর
প্রথমে বিএনপি এবং দ্বিতীয়পর্যায়ে ইসলামিদের মধ্যে মাহমুদ ফ্যাক্টর সক্রিয় হয়। কিন্তু তৃতীয়পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাহমুদ ফ্যাক্টর যে এত সক্রিয় হয়ে উঠবে সেটা ছিল আওয়ামী সরকারের ধারণার বাইরে।
এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ না খেয়ে থাকার যন্ত্রণা বোঝে। তাদের অনেকেই দুই বেলা খেতে পায় না। কেউবা একবেলা আধাপেট খেয়ে দিন কাটায়। অনাহারের যন্ত্রণা তারা প্রায় প্রতিদিনই সহ্য করতে বাধ্য হয়। তাই এই উপমহাদেশে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অনশন ধর্মঘট করে খুব সহজে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে তিনি তাদের দৈনন্দিন কষ্টটা বোঝেন। সহমর্মী রূপে তিনি নিজেকে জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তিনি ইনডিয়ার টপ নেতা হয়েছিলেন।
ঠিক একইভাবে রিমান্ডে টর্চারের পর মাহমুদুর রহমান তার অনশন ধর্মঘট শুরু করলে তারও পপুলার বেইস এখন পার্টি ও ধর্মের বাইরে আরো বৃহত্তর পরিধিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে। যদিও এই দেশের সুশীল সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মাহমুদুর রহমানের খবর যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে চাইছে তবুও এটাই সত্য যে জনগণের কাছে এই মুহূর্তে তার সংবাদই প্রধান কৌতূহলের বিষয়। তারা জানে মাহমুদের অনশন ধর্মঘট শাহবাগীদের অভিনীত অনশন ধর্মঘট নয়। এই অনশন ধর্মঘট ঐকান্তিক এবং সরকার যদি একে দূরদর্শীভাবে হ্যান্ডল না করতে পারে তাহলে গোটা দেশই তলিয়ে যেতে পারে এক ভয়ংকর পরিস্থিতিতে।
মাহমুদুর রহমানের আটক অবস্থায় ১১ এপৃল ২০১৩ সন্ধ্যাবেলায় আমার দেশ পত্রিকার প্রেস সিলগালা করে দেয় পুলিশ। একটি বিশেষ ব্যবস্থায় আল ফালাহ পৃন্টিং প্রেস থেকে পরদিন ১২ এপৃলে আমার দেশ-এর সীমিত সংখ্যক কপি প্রকাশিত হলেও পুলিশ সেখানেও অভিযান চালায়। গ্রেফতার করে ১৯ জন প্রেস কর্মীকে। এরপর আর আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। কারণ কোনো প্রেসই সরকারের ভয়ে পত্রিকাটি ছাপতে রাজি হয়নি। আমার দেশ পড়তে হলে এখন পাঠকের কমপিউটার থাকতে হবে। আমার দেশ এখন শুধু অনলাইনে পড়া সম্ভব।
টর্চারের শিকার
মাহমুদ তার অনশন ধর্মঘটে অটল থাকেন। ডিবি হাজতে সাত দিনের পর তার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি ঘটতে থাকলে তাকে ১৭ এপৃল ২০১৩-তে হাজির করা হয়। ছয় দিনের রিমান্ড বাকি থাকলেও আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু সেন্ট্রাল জেলে মাহমুদের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি দেখে ১৮ এপৃলে তাকে পাঠানো হয় পিজি হসপিটালের জেল শাখায়। সেখানে কলামিস্ট ফরহাদ মজহার তাকে দেখার পর জানান যে ডিবি হাজতে মাহমুদুর রহমান টর্চারের শিকার হয়েছিলেন। এই লেখার সময়ে মাহমুদুর রহমানের স্ত্রী ফিরোজা মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও জানান যে তার স্বামী নির্যাতিত হয়েছেন। তার দেহে বিভিন্ন নির্যাতনের সুস্পষ্ট দাগ ফরহাদ মজহার ও ফিরোজা মাহমুদ, উভয়েই দেখেছেন।
মাহমুদুর রহমানের সুচিকিৎসা ও নিরাপত্তার জন্য ইতিমধ্যে ফরহাদ মজহার আবেদন জানিয়েছেন। আর মা মাহমুদা বেগম ও স্ত্রী ফিরোজা, মাহমুদকে অনুরোধ করেছেন তিনি যেন তার অনশন ভাঙেন। কিন্তু এই লেখার সময় পর্যন্ত মাহমুদ তাদের কথায় রাজি হননি।
অতীতে অনশন ধর্মঘট
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর একটি পন্থাস্বরূপ অনশন ধর্মঘট আয়ারল্যান্ডে খৃষ্টধর্ম চালু হবার আগে, অর্থাৎ, দুই হাজার বছর আগেও চালু ছিল। ওই সময়ে অন্যায়কারীর দোর গোড়ায় প্রতিবাদী ব্যক্তি অনশন করতেন। ঐতিহাসিকরা বলেন, তখন সামাজিক জীবনে আতিথেয়তাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো। তাই কারো বাড়ির দরজার সামনে যদি কোনো প্রতিবাদকারীর মৃত্যু হতো তাহলে তাতে গৃহস্বামীর খুব অসম্মান হতো। তবে অনেকে বলেন অনশন ধর্মঘটে সেই সময়ে কারো মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায় না। সুতরাং সম্ভবত তখন অনশন ধর্মঘট হয়তো হতো শুধু এক রাতব্যাপী। তখন সাধারণ কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার জন্য অথবা ঋণের টাকা আদায়ের জন্য অনশন ধর্মঘট হতো।
প্রাচীন ভারতেও ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে পাওনাদার অনশন ধর্মঘট করত। রামায়নে এর উল্লেখ আছে যাতে জানা যায় খৃষ্টজন্মের ৪০০ থেকে ৭৫০ বছর আগে এই প্রথা চালু ছিল। ১৮৬১-তে বৃটিশ সরকার এই প্রথা নিষিদ্ধ করে দেয়।

গান্ধীর প্রতিবাদের পন্থা
কিন্তু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্মা গান্ধী নামে সমধিক পরিচিত, তিনি অনশন ধর্মঘটকে ভারতে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ অন্যতম একটি পন্থা রূপে বেছে নেন। তার প্রতিবাদের বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য অনশন ছিল একটি অহিংস উপায়। গান্ধীকে জেলে যেতে হয়েছিল ১৯২২, ১৯৩০, ১৯৩৩ এবং ১৯৪২-এ। জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘটে গান্ধীর সম্ভাব্য মৃত্যুকে বন্ধ করার জন্য বৃটিশ সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করত। গান্ধীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি খুব বড় ছিল। বন্দি অবস্থায় গান্ধীর মৃত্যু হলে বৃটেনের আন্তর্জাতিক দুর্নাম হবে এই ভয়টা বৃটিশ সরকারের ছিল।
গান্ধী প্রথম অনশন ধর্মঘট করেন ১৯২৪-এ এবং সেটা ছিল তিন সপ্তাহব্যাপী। এরপর সেপ্টেম্বর ১৯৩২-এ ছয় দিনব্যাপী অনশন ধর্মঘট করেন। এরপর ১৯৩৩-এ গান্ধী ২১ দিনব্যাপী অনশন ধর্মঘট করেন। এটাই ছিল তার দীর্ঘতম অনশন ধর্মঘট।
বাসুদেব ফাদকে এবং যতীনের অনশন
ইনডিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধী ছাড়া আরো যারা অনশন ধর্মঘট করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মহারাষ্ট্রের বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে এবং পশ্চিম বঙ্গের যতীন্দ্রনাথ দাশ। এরা দুজনই অনশন ধর্মঘটে মারা যান।
ইনডিয়ার স্বাধীনতার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের জনক ছিলেন বাসুদেব ফাদকে। তার অধীনস্থ বিপ্লবী দল রামোসি ধনী ইংরেজ ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য টাকা জোগাড় করত। এক পর্যায়ে বাসুদেব ফাদকে-র নেতৃত্বে রামোসি অপ্রত্যাশিতভাবে হামলা চালিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করে কয়েক দিনের জন্য পুনে (পুনা) শহর দখল করে নিয়েছিল।
বাসুদেব কয়েকবার ধরা পড়েন এবং কয়েকবার জেল থেকে পালিয়ে যান। ১৯৮০-তে ধরা পড়ার পর তাকে সুদূর এডেন পোর্টের জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই সময়ে তিনি যক্ষ্মায় ভুগছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৩-তে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন এবং মাত্র চার দিন পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৩-তে তিনি মারা যান।
যতীন্দ্রনাথ দাশের জন্ম হয়েছিল কলকাতায় ১৯০৪-এ। খুব অল্প বয়সে তিনি বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতি-তে যোগ দেন। ঢাকায় আর্মানিটোলা মাঠের কোনায় একটি বাড়ির বেইসমেন্টে তাদের গুলিচালনা প্র্যাকটিস হতো। নভেম্বর ১৯২৫-তে তিনি যখন কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশোনা করছিলেন তখন গ্রেফতার হন। তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে রাজবন্দিদের প্রতি যে দুর্ব্যবহার করা হতো তার প্রতিবাদে যতীন দাশ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ২০ দিন পরে জেল সুপারিনটেনডেন্ট ক্ষমা প্রার্থনা করলে যতীন অনশন শেষ করেন। একপর্যায়ে তিনি জেল থেকে মুক্ত হন।
জেলমুক্ত হবার পরে পাঞ্জাবের ভগৎ সিং-এর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। গান্ধী-নেহরুর কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনের বিপরীতে এরা ছিলেন সহিংস বিপ্লবে বিশ্বাসী। এরা বোমা এবং অন্যান্য বিস্ফোরক পদার্থ বানাতে মনোযোগী হন। কিন্তু ১৪ জুন ১৯২৯-এ যতীন ধরা পড়েন এবং তাকে লাহোর জেলে বন্দি করা হয়। সেখানে ১৩ জুলাই ১৯২৯-এ যতীন অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।
যতীন এবং তার সঙ্গে অন্যান্য বিপ্লবী বন্ধুরা জেলে ইনডিয়ান বন্দিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে এই ধর্মঘট করেন। তারা বলেন, তাদের জেল ইউনিফর্ম নিয়মিত ধোয়া হয় না, খাবারে ইদুর ও তেলাপোকা থাকে এবং পড়ার জন্য কোনো বই অথবা সংবাদপত্র দেয়া হয় না। তারা বলেন, তাদের তুলনায় একই জেলে ইংরেজ বন্দিদের প্রতি ভালো আচরণ করা হয় এবং অনেক সুবিধা দেয়া হয়।
কিন্তু এবার জেল কর্তৃপক্ষ অনমনীয় থাকে এবং তাকে ফোর্স ফিডিংয়ের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাকে খাওয়ানোর জন্য প্রহার করে। তবুও যতীন না খেয়ে থাকেন। তখন জেল কমিটি তাকে বিনা শর্তে মুক্তির প্রস্তাব পাঠান। বৃটিশ সরকার সেটা নাকচ করে দিয়ে জামিনে ছেড়ে দিতে রাজি হয়। কিন্তু ততক্ষণে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-এ ৬৩ দিন অনশনের পর ২৮ বছর বয়সে যতীনের মৃত্যু হয়।
লাহোর থেকে কলকাতায় যতীনের মরদেহ ট্রেনে আনার সময়ে প্রতিটি রেলস্টেশনে হাজার হাজার মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য উপস্থিত হয়। কলকাতায় শ্মশানঘাটে তার কফিন নিয়ে যাওয়ার সময়ে দুই মাইল লম্বা মানুষের লাইন হয়। যতীনের মৃত্যুর পরে বৃটিশ আমলে অবৈধভাবে কাউকে আটক রাখার সংখ্যা কমে যায়।
ভগৎ সিংয়ের বিশ্ব রেকর্ড
যতীনের মৃত্যুর পরে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত (বর্ধমান, পশ্চিম বঙ্গের) অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যান। ৫ অক্টোবর ১৯২৯-এ ভগৎ সিং অনশন ভাঙেন। বটুকেশ্বর দত্ত এর আগেই অনশন ভেঙেছিলেন।
ভগৎ সিংয়ের অনশন ধর্মঘট ১১৬ দিন স্থায়ী হয়। এটাই বিশ্ব রেকর্ড। এর আগে জনৈক আইরিশ বিপ্লবী ৯২ দিনব্যাপী অনশন ধর্মঘট করেছিলেন।
কাজী নজরুলের অনশন
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনডিয়ার স্বাধীনতার জন্য বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন ধূমকেতু পত্রিকা। এই পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাসমূহে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। বৃটিশ সরকার ধূমকেতু পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং ১৯২২-এর ২৩ নভেম্বর কাজী নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে। হুগলি জেলখানায় রাজবন্দিদের ওপর জেল কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাজী নজরুল অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সময় জেলে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। এতে তিনি নজরুলকে অনশন ভাঙতে অনুরোধ করে লেখেন Give up hunger strike, our literature claims you. (তোমার অনশন ধর্মঘট ভাঙো। আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়।) কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের এই টেলিগ্রাম নজরুল ইসলামের কাছে না পৌছিয়ে তা রবীন্দ্রনাথের ঠিকানাতেই ফেরত পাঠান। সে সময় নজরুল ইসলামের মা জাহেদা খাতুনও অনশন ভাঙতে জেলে এসেছিলেন কিন্তু নজরুল অনশন ভাঙেননি। টানা ৩৯ দিন অনশনের পর নজরুল অনশন ভাঙতে রাজি হন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে নজরুলের এক বছরের সশ্রম জেলদণ্ড হয়েছিল।
অন্ধ্র প্রদেশের জন্ম
১৯৫২-তে ইনডিয়ান বিপ্লবী পট্টি শ্রীরামুলু অন্ধ্রকে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ঘোষণার দাবিতে ৫৮ দিন অনশন ধর্মঘট করেন। ফলে তার মৃত্যু হয়। তার এই আত্মাহুতির পরিণতিতে ইনডিয়াতে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যের পুনর্গঠন হয় এবং অন্ধ্র প্রদেশের জন্ম হয়।
অনশন ধর্মঘটে আরো একজন ইনডিয়ানের মৃত্যু হয়েছিল। তিনি ছিলেন হিন্দু সাধু নিগাম আনন্দ সরস্বতী। গঙ্গা নদীবক্ষে অবৈধ খনির ফলে পানি দূষিত করণের বিরুদ্ধে তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অনশনের ১১৫-তম দিনে ১৩ জুন ২০১১-তে ৩৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
বিংশ শতাব্দিতে ইনডিয়ার বাইরে বৃটেন ও আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নারী আন্দোলনকারীরা জেলে বন্দি থাকার সময়ে অনশন ধর্মঘট করেন। জেলে মৃত্যু হলে এরা শহীদ হয়ে যাবেন এই দুশ্চিন্তায় কর্তৃপক্ষ তাদের জোর করে খাওয়ান (ফোর্স-ফিডিং)। আন্দোলনকারীরা ফোর্স ফিডিংকে টর্চার রূপে আখ্যায়িত করেন। ফোর্স ফিডিংয়ের ফলে মেরি কার্ক এবং লেডি কন্সটান্স বালওয়েআর-লিটন-এর মৃত্যু হয়।
এই দুজনার মৃত্যুর পর ১৯১৩-তে পৃজনার্স টেম্পরারি ডিসচার্জ অফ ইল হেলথ অ্যাক্ট (Prisoner’s Temporary Discharge of Ill Health Act বা অসুস্থতার কারণে বন্দিদের সাময়িক মুক্তি আইন) পাস হয়। এর পর থেকে বৃটিশ ইনডিয়াতে কোনো জেলবন্দি অনশনের কারণে মারা যায় নি।
দুইজন মুসলিম অনশনকারী
অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাবার সময়ে এখন পর্যন্ত উপরোক্ত ব্যক্তিদেরসহ ৩২ জন রাজনৈতিক প্রতিবাদী মারা গিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুইজন মুসলিম আছেন।
আকবর মোহাম্মদী ছিলেন তেহরান ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ১৯৭৯-এর ইসলামি বিপ্লবের পরে ইরানের গণতন্ত্রের দাবিতে যেসব আন্দোলন হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ১৯৯৯-এর ইরানি ছাত্র আন্দোলন। এতে অংশ নেওয়ায় তাকে কুখ্যাত ইভিন পৃজনে পাঠানো হয়। তিনি সেখানে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। জেলরক্ষীরা তাকে খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন করে। ফলে এক সপ্তাহের কিছু পরে ৩০ জুলাই ২০০-এ জেলখানায় ২৪ বছর বয়সে আকবর মোহাম্মদীর মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পরে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
ইরানি সাংবাদিক হোদা রেজা সাবেরও অনশন ধর্মঘটে মারা যান। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন ২৮ জানুয়ারি ২০০০Ñএ। দেড় মাস পরে জামিনে মুক্ত হন। ১২ এপৃল ২০০৩-এ তাকে দশ বছরের জেলদণ্ড দেওয়া হয় এবং জুন ২০০৩-এ তাকে আবার গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। আপিল আদালতে তার দণ্ড কমিয়ে আট মাস করা হলেও সাবের কে আবার জেলে নেওয়া হয় ২৩ জুলাই ২০১০-এ। বলা হয় তাকে দশ বছর জেলদণ্ড পূর্ণ করতেই হবে। ২ জুন ২০১১ থেকে ইভিন পৃজনে সাবের ও তার সহবন্দি আমির খসরু দালিরসানি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তারা প্রথমে সলিড খাবার এবং পরে পানি খাওয়াও বন্ধ করেন। এর মাত্র আট দিন পরে ৫২ বছর বয়সে ১০ জুন ২০১১-তে হার্ট এটাকে সাবেরের মৃত্যু হয়।
কত দিন?
একটানা অনশন করে ধর্মঘটকারী কত দিন বেচে থাকার আশা করতে পারেন?
এর উত্তর ৬০ দিনে কিছু কম বা কিছু বেশি। এটা নির্ভর করে অনশনকারীর দেহে সঞ্চিত চর্বি এবং তার কৌশলের ওপর।
ফিজিওলজিস্টরা বলেন, কোনো মানুষের দেহের ৪০ শতাংশ যদি কমে যায় তাহলে তার পরে বাচার সম্ভাবনা থাকে না। অনশন শুরুর তিন থেকে পাচ দিনের মধ্যে সেটা বিপজ্জনক হয়। এই সময়ে শক্তি উৎপাদনের জন্য দেহ তার চর্বি ভাঙতে শুরু করে। লিভার যখন চর্বি ভাঙা শুরু করে (সাধারণত লিভার গ্লুকোজ ভাঙে), তখন কিটোন বডিজ (Ketone Bodies) নামে এক ধরনের টক্সিক বাইপ্রডাক্ট সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে আরেকটি বাইপ্রডাক্ট এইসটোন (Acetone) সৃষ্টি করে যেটা মাংস (ফুসফুস) দিয়ে বেরোতে পারে। এইসটোনের গন্ধ অনেকটা নাশপাতির মতো। এই সময়ে ব্রেইন তার প্রয়োজনে কিটোন বডিজ-কে অক্সিডাইজ করতে পারে। এরপর রক্তপ্রবাহে এ বেশি কিটোন বডিজ হতে পারে যে তার ফলে কিটোঅ্যাসিডোসিস হতে পারে। এটা অনশনকারীকে দ্রুত মৃত্যুর মুখে নিয়ে যায় বিশেষত তিনি যদি ডায়াবেটিক হন।
তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকে অথবা অনশনের শুরুতে দেহের ওজনের ১৮ শতাংশ কমলে অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে। দেহ তখন স্টারভেশন মোড (Starvation Mode) বা অনশন অবস্থায় চলে যায় এবং দেহ চেষ্টা করে সব কিছু ব্যালান্স করে চলতে। দেহ তখন আক্ষরিক অর্থে নিজেকে খেয়ে বেচে থাকতে চেষ্টা করে।
যে ৬০ দিনের কথা সাধারণত বলা হয়, তাতে ধরে নেওয়া হয় যে ধর্মঘটকারী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তার দেহে প্রায় ২৪ পাউন্ড বা ১২ কেজি চর্বি আছে। স্টার্টিং পয়েন্টে যার বেশি চর্বি থাকে সে বেশি দিন বাচতে পারে।
অনশন ধর্মঘটকারী কিছু কৌশলে তার প্রতিবাদী দিনের সংখ্যা বাড়াতে পারেন। মার্গারেট থ্যাচারের শাসন আমলে ১৯৮১-তে উত্তর আয়ারল্যান্ডে বেলফাস্টে ববি স্যান্ডসসহ যেসব আইরিশ রিপাবলিকান অনশন ধর্মঘট করেন তারা সলিড খাবার খাননি। কিন্তু তরল বা লিকুইড ডায়েটে তারা ছিলেন। মাঝে মাঝে তারা দু এক চামচ লবণ খেয়েছিলেন। এরা যদি সেটা না করতেন তাহলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে দেহ দ্রুত বঞ্চিত হতো এবং ব্লাড প্রেশার খুব নিচে চলে যেত। ববি স্যান্ডস অনশন ধর্মঘটের ৬৬-তম দিনে মারা গিয়েছিলেন।
কৌশলী অনশন, রিলে অনশন, শাহবাগী অনশন
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবনী অনশন ধর্মঘট করেছেন জেলবন্দি টার্কিশ মার্কসবাদীরা। ডরমিটরি স্টাইল জেলখানাকে পশ্চিমি স্টাইলের জেলখানায় রূপান্তরের প্রতিবাদ তারা করেন অনশন ধর্মঘটের মাধ্যমে। তবে ধর্মঘটকারীরা যেন বেশি দিন বেচে থাকতে পারেন, সেজন্য তারা লবণ, চিনি ও ভিটামিন ক্যাপসুল খান। এর ফলে তাদের ওজন কমে যাওয়াটাকে প্রতিদিন কয়েক আউন্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছিলেন। তারা ৩০০ দিনের বেশি ধর্মঘট করতে পেরেছিলেন।
আমেরিকায় সৎ মেয়েকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত চার্লস রবার্ট ম্যাকনাব স্পোকেন কাউন্টি জেলে ১২৩ দিনের বেশি অনশন ধর্মঘট করেন। তিনি মাঝে মাঝে পানি ও কফি খেয়েছিলেন এবং এই ১২৩ দিনের বেশি অনশন ধর্মঘট করেন। এই ১২৩ দিনের মধ্যে তার মানসিক অবস্থা মূল্যায়নে তিন দিনের জন্য যখন তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছিল তখন তিনি কিছু সলিড খাবার খেয়েছিলেন।
ডিসেম্বর ২০১১-তে আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক সিটিতে একটি ভিন্নধর্মী গ্রুপ অনশন ধর্মঘট করে। ওই সময়ে অকুপাই ওয়াল স্টৃট বা ওয়াল স্টৃট দখল করো এই ব্যানারে তিন ব্যক্তি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা অনশন শেষ করলে নতুন তিন ব্যক্তি অনশনে যোগ দেন। এটা ছিল একধরনের রিলে অনশন ধর্মঘট। তারা কোনো সলিড ফুড খাননি। ১৪ দিন পরে এই ধর্মঘট শেষ হয়।
এসব অনশন ধর্মঘটের পাশাপাশি মঙ্গলবার ২৬ মার্চ ২০১৩-তে আওয়ামী সরকার পৃষ্ঠপোষিত শাহবাগ মঞ্চে অভিনীত ‘আমরণ অনশন’ -এর ঘটনাটি স্মরণ করা যেতে পারে। ‘শহীদ রুমী স্কোয়াড’ নামে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ একটি দল রাত পৌনে এগারোটা থেকে ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মেইন গেইটের সামনে অনশনে বসেন। কিন্তু সাত দিন পরে সোমবার ১ এপৃল ২০১৩-তে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী (এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী) এ কে খন্দকারের সঙ্গে আলোচনার পরে রাত নয়টার দিকে আমরণ অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেন নব্য মুক্তিযোদ্ধারা। এই অনশনকারীরা সাত দিনের কোন সময়ে কত ঘণ্টা অনশন করেন এবং তারা সলিড ও লিকুইড, উভয় ধরনের খাবারই বর্জন করেছিলেন কি না সেটা জানা যায়নি।
মাহমুদুর রহমান সলিড বা লিকুইড কিছুই খাচ্ছেন না। বলা যায়, পূর্ণ অনশন ধর্মঘট তিনি করছেন।
কিন্তু এর পরিণতি কোথায়?
যতীন দাশের মতো ৬৩ দিন পরে মৃত্যু?
অথবা ভগৎ সিংয়ের মতো ১১৬ দিন পরে অনশন ভঙ্গ?
মাহমুদুর রহমানের লক্ষ্য
ইতিমধ্যে মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন তিনি আমরণ অনশন ধর্মঘট করছেন তিনটি দাবি আদায়ে। এক. তার মা মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আবুল আসাদের অপরাধ তিনি যে প্রেস থেকে সংগ্রাম ছাপান, সেই একই আল ফালাহ পৃন্টিং প্রেস থেকে ১১ এপৃলের আমার দেশ ছাপা হয়েছিল। দুই. আল ফালাহ প্রেসের ১৯ জন কর্মচারীকে মুক্তি দিতে হবে। এবং তিন, আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা খুলে দিতে হবে।
অনেকেই মনে করেন মাহমুদের এই তিনটি দাবিই ন্যায় ও যৌক্তিক। বিশেষত তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যখন স্বীকার করেছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
কিন্তু এখন পর্যন্ত মাহমুদের দাবি সরকার মেনে নেয়নি।
এখানে মনে রাখতে হবে অনশনের সূচনায় যতীন দাশ ও ভগৎ সিংয়ের স্বাস্থ্য ভালো ছিল এবং তারা যুবক ছিলেন। মাহমুদুর রহমান মধ্য বয়সী এবং বছরখানেক আগে লন্ডনে তার চোয়ালে একটি জটিল সার্জারি হয়েছিল। তা ছাড়া রিমান্ডে থাকার সময়ে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
এসব ফ্যাক্টর বিবেচনা করলে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে মাহমুদুর রহমানের পক্ষে ৬০ দিন অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং মাহমুদুর রহমানকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে তিনি কি করবেন?
তার শুভকামী এবং দৈনিক আমার দেশ পাঠকদের অনেকেই মনে করেন মাহমুদ অনেক আগেই তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখন যদি তিনি অনশন ভাঙেন তাহলে কেউই তাকে শাহবাগী অভিনেতা বলবে না। কেউই তাকে ভণ্ড বলবে না। তাই নিজে বেচে থাকার জন্য এবং আমার দেশ পত্রিকাটিকে বাচিয়ে রাখার জন্য তিনি অনশন ভাঙতে পারেন।
 সরকারের ঝুকি : পশুত্ব বনাম মনুষ্যত্ব
ঘড়ির কাটা ঘুরছে।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।
মাহমুদুর রহমান মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
আওয়ামী সরকারের ঝুকি বাড়ছে।
ফিরোজা মাহমুদ জানিয়েছেন ডিবি হাজতে নেয়ার প্রথম দিকে অর্থাৎ ১১ এপৃলে তার স্বামীর ওজন ছিল ৭১ কেজি। এই লেখার দিনে তার ওজন হয়েছে ৫৪ কেজি। অর্থাৎ, তার ওজন প্রায় ২৪ শতাংশ কমে গিয়েছে। তিনি এখন স্টারভেশন মোডে আছেন। এটা খুবই বিপজ্জনক। শুধু দৈহিক নয়, কোনো মানসিক বৈকল্যেরও শিকার হতে পারেন মাহমুদ।
আজ থেকে বহু যুগ আগে বৃটিশ সরকার এই ধরনের ঝুকি না নিয়ে গান্ধীকে জেলমুক্তি দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারও এখন সেটা করতে পারে।
মাহমুদকে চোখ বাধা অবস্থায় টর্চার করা হয়েছিল। কারা চোখ বেধেছিল, কারা টর্চার করেছিল এসব নামই এখন অনুমিত এবং আলোচিত হচ্ছে। এরা ভবিষ্যতে মারাত্মক বিপদে পড়বে।
কোনো বাহিনীর কর্মচারি, কোনো মন্ত্রী বা উপদেষ্টা যদি বলেন তারা “ওপরের নির্দেশে” টর্চার করেছেন তাহলেও তাদের বিপদ হবে। একটা সময় আসে যখন মানুষকে তার বিবেক দ্বারা চালিত হতে হয়। তখনই তার মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়Ñ পশুত্ব দূর হয়। ভবিষ্যতে মাহমুদকে যদি আবার টর্চার করতে বলা হয় তাহলে নির্দেশদাতার বিরুদ্ধে অবশ্যই বিদ্রোহ করতে হবে। ঠিক তেমনই, মাহমুদের চিকিৎসায় যদি বিন্দুমাত্র অবহেলা অথবা গাফিলতি হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে বিপদে পড়বেন। বিশেষত এই লেখাটি পড়ার পর তারা জানবেন অনশন ধর্মঘটে মানুষের আকস্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে।
সুতরাং এই লেখাটিকে আইন বিভাগ, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী এবং মন্ত্রী-উপদেষ্টারা যদি অতি সময়োচিত সতর্কবাণীরূপে গ্রহণ করেন তাহলে সবার মঙ্গল হবে। আশা করা যায় সরকার অবিলম্বে তৎপর হবে।
ঘড়ির কাটা ঘুরছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads