বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার একপেশে পরিস্থিতির মূল্যায়ন


সিরাজুর রহমান

 মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশী জনমতকে প্রভাবিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়েছে আমাকে। দেড় শ’র বেশি ফ্যাক্টশিট লিখেছি সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের অবগতির জন্য। দিনে একবার করে (কোনো কোনো দিন দু’বারও) লন্ডনে কর্মরত সাংবাদিকদের ব্রিফ দিয়েছি। ইউরোপ ও আমেরিকায় থাকা সাংবাদিকদের টেলিফোন করে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। সব প্রয়াসের লক্ষ্য ছিল জনমতকে সহানুভূতিশীল করে সেসব দেশের সরকারকে প্রভাবিত করা, যাতে তারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষই সমর্থন করে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে এ আশাও অন্তর্নিহিত ছিল, ভবিষ্যতে এরা স্বাধীন বাংলাদেশের বিকাশে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা দেবে।
সে লক্ষ্যে আমরা অপ্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করেছিলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একশ্রেণীর মিডিয়া ও জনসাধারণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য, সে দেশের সরকার সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধে সাহায্য না দিতে ভারতকেও তারা সক্রিয়ভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র তখন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে যখন দুর্ভিক্ষের প্রলয় নেমে আসে, ওয়াশিংটন তখনো খাদ্য সাহায্য দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালের ৫ মার্চ ধামরাইয়ের বিশাল জনসভায়ও সে কথা বলেছিলেন।
আধুনিক বিশ্বের একটা মহাদুর্ভাগ্য, একমাত্র পরাশক্তি দেশ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বপরিস্থিতির ন্যায়ান্যায় নির্ধারণ করে নিজের সাময়িক স্বার্থের দুরবিন দিয়ে। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ও কূটনীতিক প্রভাবকে অবরুদ্ধ করতে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা সিটো ও সেন্টো সামরিক চুক্তিতে ওয়াশিংটনের মিত্র ছিল।
চীনের সাথে পাকিস্তানের তখন দৃঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নিক্সনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার পিকিংয়ের (তখনকার নাম) সাথে দূতিয়ালি করতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে বেছে নিলেন। আপনাদেরও মনে থাকার কথা, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। শুধু মানুষই তাতে মারা গিয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ। তার দুই দিন পর ইয়াহিয়া খান ঢাকা হয়ে পিকিং যান। পথে কয়েক ঘণ্টা ঢাকায় থেমেছিলেন তিনি। কিন্তু ঘূর্ণির ক্ষয়ক্ষতি দেখার কথা একবারও তার মনে হয়নি। একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রতি ওয়াশিংটনের বিরোধিতার সেটাই ছিল কারণ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন খসে পড়েছে প্রায় ২৪ বছর হলো। ওয়াশিংটনের শঙ্কা এখন চীনকে নিয়ে। পরাশক্তি হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে এখন ধরি ধরি করছে। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাও এখন স্বীকার করছেন, সামরিক ও অর্থনৈতিকÑ উভয় দিক থেকেই অদূর ভবিষ্যতে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনকে ঘিরে ব্যূহ তৈরির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সে জন্য। পঞ্চাশের যুগে ভারত ছিল মস্কোর মিত্র, সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু। এখন ওয়াশিংটনের মতো নয়াদিল্লিও বেইজিংয়ের শত্রু। বিগত কয়েক বছরে সে জন্যই অতীতের শত ‘অন্যায়’ ক্ষমা করে দিয়ে ভারতের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে ওয়াশিংটন। বাংলাদেশের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করতে হবে এই পটভূমিতে।
খালেদা জিয়ার সর্বশেষ সরকারের শেষ ভাগে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় বেশ কিছু ‘উদ্বেগ’ দেখা দিয়েছিল। তার কিন্তু সত্যিকারের কোনো কারণ ছিল না। সরকারের মেয়াদ শেষ হবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। সে তারিখে তারা পদত্যাগ করবে এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় নির্বাচনের আয়োজন করবে। মনে রাখতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলস। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা বুঝে গিয়েছিলেন যে, সে সরকারের অধীনে যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তবুও তারা বিজয় পাবেন না।
খালেদা সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই ভারতের হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস রাজনৈতিক মহল এবং সচিবপাড়ায় ছোটাছুটি শুরু করে দেন। বীণা সিক্রি তো শেখ পরিবারের সদস্যের মতোই যখন তখন সুধা সদনে যাতায়াত শুরু করেন। তাদের উত্তরসূরি পিনাক চক্রবর্তী ও হ্যারি কে টমাস একই ধারা বজায় রাখেন। যে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতির জন্য ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত বহু হরতাল করেছিল, বহু রক্তারক্তি করেছিল, লগি-লাঠি-বৈঠার ঘায়ে বহু প্রাণহানি এবং লাগাতার হরতালের ধ্বংসলীলার মাধ্যমে দেশ অচল করে দিয়েছিল, সেই পদ্ধতি আওয়ামী লীগ আর মানতে রাজি হলো না। একটা খুদে সেনা-অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ভেঙে দিতে বাধ্য করে একটা বর্ণচোরা সামরিক সরকার গঠিত হয়। এ সরকারকেই শেখ হাসিনা তার আন্দোলনের ফসল বলে ঘোষণা করেছিলেন ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল বিদেশযাত্রার শুরুতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
সে সরকার বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। তার প্রতিরোধের মুখে অবশেষে তারা তাকে কারারুদ্ধ করে। অন্য দিকে চিকিৎসার নামে শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ড সফরের সুযোগ দেয়া হয়। ওই দিকে খালেদা জিয়া কারাযন্ত্রণা ভোগ করেই গেলেন। বর্ণচোরা সামরিক সরকার বিএনপিকে ভেঙে ফেলার অনেক চেষ্টা করেছিল। এ টি এম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশনার বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করার চেষ্টা করেছিল। রাষ্ট্রদূতেরা তার কোনো প্রতিবাদ করেননি; বরং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভারত ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সহযোগিতায় একটা মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল বলেই সার্বজনীন বিশ্বাস।
 এরা মুখ খুললে দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়
এসব কারণেই রাষ্ট্রদূতেরা যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মন্তব্য করেন, দেশের মানুষের বুক তখন ভয়ে কাঁপতে থাকে। গত কয়দিন জার্মান, জাপানি ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাপানের রাষ্ট্রদূত সিরো সিদোসিমা বলেছেনÑ ‘মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানোর অধিকারকে সম্মান জানানো উচিত, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলেরই নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের জীবন ও জীবিকার ওপর হামলার যৌক্তিকতা খোঁজা উচিত নয়।
কূটনৈতিক সৌকর্যের মধ্যেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বর্তমান বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশ (মিডিয়াসহ) এবং শান্তিপূর্ণ পন্থায় প্রতিবাদ জানানোর অধিকারকে সম্মান জানানো হচ্ছে না। প্রধান বিরোধী দল (যারা ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে চারবার এ দেশে ক্ষমতায় ছিল) বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয় না, কালেভদ্রে হলেও সরকারের নানা বাহিনী সভার ওপর হামলা করে এবং পুলিশ জনতার পরিবর্তে এসব বাহিনীকেই সহায়তা করে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করলেও ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর পুলিশ একযোগে তাদের বাধা দেয়, তাদের ওপর লাঠি আর গ্যাসের আক্রমণ হয় এবং পুলিশ প্রায়ই গুলি চালায়। মিডিয়ার প্রায় ৯০ শতাংশই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। বিরোধী দলের বক্তব্য এরা প্রচার করে না, বরং করলে অসত্য ও বিকৃত করে প্রচার করে। এই যেখানে অবস্থা সেখানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুযোগ কোথায়?
মনে হচ্ছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারেননি। অথবা এ-ও হতে পারে যে, তাকে প্রকৃত পরিস্থিতি অবগত করানোর দায়িত্ব মার্কিন দূতাবাসে যাদের ওপর, তারা সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করছেন না। তৃতীয় যে সম্ভাবনাটা মনে আসে, আমরা আশা করব সেটা সত্যি নয়। সেটা এই যে, ভারতের সাথে বন্ধুত্বের কথা বিবেচনা করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ভারতের স্নেহভাজন শেখ হাসিনা এবং দিল্লি সরকারের প্রিয় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছেন।
সে যা-ই হোক, রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা তার সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে বলেছেন যে সহিংসতা প্রতিবাদ করার কিংবা ভিন্নমত প্রকাশের পন্থা নয়। সরকার কথায় কথায় বলে থাকে যে বিরোধীরাই সহিংসতা করছে। কিন্তু সহিংসতা কী কারণে ঘটছে রাষ্ট্রদূত মজিনা সেটা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয় না। সুতরাং তার উক্তিতে বিরোধী দলগুলোর অবস্থানের কোনো প্রতিফলন থাকছে না, সরকারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রকটভাবে চোখে পড়ছে।
 হেফাজতের সমাবেশ যে কারণে শান্তিপূর্ণ ছিল
রাষ্ট্রদূত ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের ‘ম্যামথ’ (অতিকায়) সমাবেশের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করলেই নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। হেফাজত শুরু থেকেই বলে আসছিল যে তাদের সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে। শান্তিপূর্ণ পন্থায় এরা দেশের সাম্প্রতিক কিছু ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ ও প্রবণতার প্রতিবাদ করতে এবং সেসব ব্যাপারে নিজেদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে চায়। অনেক ইতস্তত করার পর সরকার অবশেষে শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি দেয়। কিন্তু এ সরকার কাটা-জিহ্বা, তারা মুখে বলে এক আর কাজে করে অন্য কিছু। হেফাজতের লংমার্চে বাধা দেয়ার জন্য এরা শাহবাগীদের দিয়ে বেনামে একটা রাষ্ট্রীয় হরতাল ডাকে। ঢাকার আগমনের সব পথ ও উপায় এরা বন্ধ করে দেয়।
ঢাকামুখী সব দূরপাল্লার বাস ও কোচ সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশে অচল করে রাখা হয়, ঢাকামুখী মোটরলঞ্চগুলোকে ঘাটে বেঁধে রাখা হয়, বহু স্থানে নদী পারাপারের পথও বন্ধ করে দেয়া হয়। শেষতক সরকার রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের অভ্যন্তর অঞ্চলের রেল যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়। এসব সত্ত্বেও দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে লাখ লাখ মানুষ হেঁটে সমাবেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের বহু স্থানে পুলিশ এসব পথচারীর পথ রুদ্ধ করে, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ তাদের ওপর হামলা করে। শত শত লোক সেদিন আহত হয়, গুলিবিদ্ধ হয়েছে কেউ কেউ।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রকৃত কারণ এখানেই পাওয়া যাবে। শাপলা চত্বরে ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ লোকের জনসমুদ্রের ওপর হামলা করার সাহস পুলিশ কিংবা ছাত্রলীগের ছিল না। তাই শাপলা চত্বরের সমাবেশ ছিল সম্পূর্ণ শান্ত। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সে জন্য হেফাজতে ইসলামকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কিন্তু যেখানে বাধা দেয়া হয়েছে, লংমার্চের ওপর হামলা হয়েছে; অশান্তি ঘটেছে শুধু সেখানেই। এই হচ্ছে প্রকৃত পরিস্থিতি। বিরোধী দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবেই প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু দলীয়কৃত পুলিশ সরকারের নির্দেশে অন্যায়ভাবে তাদের ওপর চড়াও হয়, লাঠি-গ্যাস-রাইফেল ব্যবহার করে। শাসক দলের ক্যাডার ও গুণ্ডারা লাঠিসোঁটা, রামদা এবং বোমা হামলা চালায় তাদের ওপর। আত্মরক্ষার জন্যও প্রতিবাদীদের কিছু না কিছু করতেই হয়। রাষ্ট্রদূত মজিনার উপদেষ্টারা এ বিষয়গুলো তাকে বুঝিয়ে বললে ভালো করবেন।
বাংলাদেশে বর্তমান এমন আরো অনেক কিছু ঘটছে; হিটলারের জার্মানি ও স্ট্যালিনের রাশিয়ার পর সেসব ন্যক্কারজনক কাজ অন্য কোথাও ঘটেছে বলে কি ড্যান মজিনা শুনেছেন? পুলিশ মাঝে মধ্যেই প্রধান বিরোধী দলের সদর কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখছে, সে অফিসে তালা মেরে রাখছে, এমনকি গত মাসে দরজা-জানালা ভেঙে পুলিশ সে অফিসে ঢুকে সব কিছু তছনছ করেছে, দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে গেছে এবং বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীকেও ধরে নিয়ে গেছে। এই যেখানে অবস্থা সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো ভব্য-সভ্য আর শান্তিপূর্ণ রাজনীতি চলবে বলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কী করে আশা করতে পারেন?
 ইতিহাস কী বলে আর এরা কী করে
বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কত রাজবন্দী আছে এখন? অথবা যুক্তরাজ্যে? ড্যান মজিনা লক্ষ না করেই পারেন না যে নানা সাজানো অভিযোগে এবং হুকুমের আসামি নামক এক তিন-পেয়ে অভিযোগে বিএনপির প্রায় গোটা নেতৃত্বকে এখন ভেঙে জেলে পুরেছে সরকার। এরা আশা করছে, নেতারা জেলে থাকলে জনতার আন্দোলনস্পৃহা শিগগিরই স্তিমিত হয়ে আসবে।
বর্তমান সরকারের নেতারা ইতিহাস পড়েননি, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে জানেন না। অখণ্ড ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার যুদ্ধে হাজারের হিসাবে নয়, লাখের হিসাবে কংগ্রেসের নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছিলেন। গান্ধী-নেহরু কেউ ময়দানে ছিলেন না। কিন্তু জনতা ঘরে ফিরে যায়নি, নেতাদের আরব্ধ কাজ তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাও তিনি দিয়ে যেতে পারেননি।’ কিন্তু আপামর জনতা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। পাকিস্তানিরা ৯৩ হাজার সুশিক্ষিত সৈন্য দিয়ে তাদের দাবিয়ে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশেও এখন ছাত্র-কৃষক-জনতা এবং ধর্মীয় নেতারা শেখ হাসিনার সরকারকে ঠেলে ফেলতে এবং টেনে নামাতে পথে নেমেছেন, আন্দোলনে জয় না হওয়া পর্যন্ত এরা আর পথ ছাড়বেন না। তবে একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে; নেতারা ময়দানে উপস্থিত থাকলে আন্দোলনকে এরা সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণ রাখতে পারতেন। নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে আন্দোলন উচ্ছৃঙ্খল ও সহিংস হওয়ার আশঙ্কা বাদ দেয়া যায় না। ড্যান মজিনা এবং তার ভারতীয় সহযোগী যদি ২০০৮ সালের মতো কোনো মাস্টারপ্ল্যান করেন, শেখ হাসিনা যদি আবার পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসেন, বাংলাদেশে তাহলে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে সেটা তীব্রতায় ১৮৬০ সালের মার্কিন গৃহযুদ্ধকেও ছাড়িয়ে যাবে। এবং সম্ভবত উপমহাদেশের গোটা পূর্বাংশে সে গৃহযুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়বে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads