বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৩

লাশ ও ভীতির রাজনীতি


স্বাধীনতার পর কলকাতা যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সফরে বিএসএস থেকে ফয়েজ আহমেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের দলে ছিলেন জওয়াদুল করিম ও আমি। সর্ব কনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে আমাকে বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছিল। সেদিন গড়ের মাঠের বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধু সোজা রাজ্য ভবনে গেলেন আর আমরা পিটিআইর মাধ্যমে ঢাকায় খবর পাঠিয়ে রাজ্য ভবনে গেলাম। ফয়েজ ভাই এত দ্রুত ঢুকে গেলেন যে আমি খেই হারিয়ে ফেললাম। লিফটে তিনতলায় পৌঁছে দেখি লাল কার্পেটটা সামনে গিয়ে দুই দিকে চলে গেছে। আমি ডান দিকে মোড় নিয়ে পর্দা ঠেলে ঢুকতে গিয়েই দেখি মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। অপ্রস্তুত হয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললাম, আমি বাংলাদেশের সাংবাদিক। শেখ সাহেবের সাথে এসেছি। তিনি বঙ্গবন্ধুর রুমটা দেখিয়ে দিলেন। ব্রিফিং শেষে নিচে নেমে এসে দেখি, ডিপি ধর ভারতীয় সাংবাদিকদের ব্রিফিং করছেন। আমিও গেলাম। কাছে যেতেই শুনলাম সবার পরিচিত স্টেটসম্যানের সাংবাদিক ধরকে জিজ্ঞেস করছে, ‘এই দেশটাকে (বাংলাদেশ) আমরা স্বাধীন করে দিলাম। এখন এর প্রশাসন পরিচালনার জন্য কবে আইপিএস (ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস) ও আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) অফিসারদের পাঠানো হবে?’ ধর বললেন, ‘সুকুমার (পরে জানলাম তিনি ইন্ডিয়ান প্লানিং কমিশনের সদস্য) তোমাদের এগোইস্ট (অহংবাদী) বন্ধুদের বাংলায় জবাব দাও। তুমি জানো আমি বাংলা জানি (ধর নাকি শান্তিনিকেতনে কিছুকাল ছিলেন) সুকুমার বললেন, ‘দেশটা সদ্য স্বাধীন হয়েছে। একে এখনই আমাদের শত্রু বানাবেন না। এদের যে প্রশাসন আছে তা আপনাদের পশ্চিম বাংলার চেয়ে অনেক দক্ষ। তারা সম্ভবত দিল্লির চাইতে কম নয়। শুধু তারা একজন নেতার অপেক্ষায় আছে। আমাদের তার ওপর লক্ষ রাখতে হবে।’ আমি অবাক হলাম ডিপি ধরের বাংলাদেশের প্রশাসনের ব্যাপারে এমন গভীর উপলব্ধি। তবে তার ‘লক্ষ রাখার’ ইঙ্গিতটাতে কেন যেন খটকা লাগল। বন্ধুদের সাথে, ফয়েজ ভাইয়ের সাথে আমার ভাবনা আদান-প্রদান করলাম। তারা বললেন, এটা স্বাভাবিক। ভারত ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্ভব হতো না এবং এটাকে তারা নিজের বেবি ভাববে এবং সেভাবে আগলে রাখবে এতে আশ্চর্য কী!

অনেক দিন পরে এই লক্ষ রাখার কথাটি আবার শুনলাম। রাষ্ট্রপতি জিয়া দিল্লি গেছেন। সেখানে ভারতীয় সেনারা তাকে স্যালুট দিচ্ছে। ডায়াসে বসেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাদের সারির পেছনে বসেছিলেন, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্সটারনাল পাবলিসিটির ডিজি। ডিজি সাহেব গল্প প্রসঙ্গে আমায় বললেন, ‘যখন জিয়া স্যালুট নিচ্ছিলেন, তখন প্রেসিডেন্ট রেড্ডিকে মিসেস গান্ধীকে বলতে শুনলাম, ‘হি ইজ ভেরি স্মার্ট।’ ইন্দিরা জবাব দিলেন, ‘ইয়েস, অ্যান্ড অলসো ভেরি ইনটেলিজেন্ট। উই হ্যাভ টু ওয়াচ হিম কেয়ারফুলি।’ অর্থাৎ ভারতীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ এবং তার নেতৃত্বের প্রতি কড়া নজর রেখেছে। শুধু কি ভারত? একবার এক সিনিয়র পশ্চিমা ডিপ্লোম্যাট আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন বিভিন্ন কথাচ্ছলে। ‘তোমাদের দেশে পাকিস্তানি আইএসআইয়ের সংখ্যা কি ‘র’-এর চেয়ে বেশি না কম?’ আমি সোজা জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের পাশের দেশ মেক্সিকোর মানুষ তোমাদের দেশে সহজে ঢুকতে পারবে, না অস্ট্রেলিয়ার মানুষেরা বেশি আসবে? তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি’। তার সাথে কথা প্রসঙ্গে আলোচনা হলো বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। বৃহৎ, মাঝারি এবং ইমারজিং রাষ্ট্রগুলো কেমনভাবে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। তিনি নিজের দেশের কথা না বলে এশিয়ার মাঝারি শক্তি এবং ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদপ্রবণ শক্তিগুলো কিভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরে গোলমাল লাগিয়ে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে তার কাহিনী বলছিলেন। ইরানের শাহকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কেমনভাবে অশান্তি সৃষ্টি করে নির্বাচিত মুসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটানো হয় তারও একটা বর্ণনা দিলেন। মাত্র এক লাখ ডলার দিয়ে কর্মকাণ্ডটি শুরু করা হয় এবং ক্রমাগত অশান্তি সৃষ্টির মাঝ দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়। তার একটি বক্তব্য ছিল বেশ প্রণিধানযোগ্য। তা হলো বাইরের শক্তি সবসময় স্বৈরাচারী নির্বাচিত ব্যক্তিকে পছন্দ করে। এতে জনগণকে একটি ঘোরের মাঝে রাখা সহজ হয়। সব অনাচার-অবিচার জনগণ মেনে নেয়। ক্ষমতাবান স্বৈরাচার যে কথা বলবে তা মেনে নেবে। অবশ্য এ জন্য ক্রমান্বয়ে আবেগি বিষয়গুলোর চর্চা করতে হবে এবং প্রতিপক্ষকে সত্য বলার কোনো সুযোগ দেয়া চলবে না। প্রয়োজনে অবিরাম অশান্তি সৃষ্টি করতে হবে সমাজে। এমনকি প্রতিপক্ষ যেন শান্তিপূর্ণ কোনো বক্তব্য দিতে না পারে অথবা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল না করতে পারে। সে জন্য প্রচার-প্রচারণাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমি বলেছিলাম, তারপরেও তো এসব স্বৈরাচারের পতন তোমরাই ঘটাও। তিনি বললেন, ‘এটা সত্য, কারণ স্বৈরাচারের প্রয়োজন মিটে গেলে এমনটি হয়। জনগণকে তখন তাদের যন্ত্রণাটুকু বোঝার সুযোগ দেয়া হয় যাতে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারের স্বরূপ প্রকাশ করে তাকে সরিয়ে দেয়া যায়। তখন বিরাজ করতে থাকে এক অসম্ভব অবস্থা। কারণ স্বৈরাচার নিজের স্বরূপ ঢাকতে গিয়ে আরো অবান্তর কর্মকাণ্ডের অবতারণা করে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে চায়।’
বাংলাদেশে ঠিক এমনি একটি অবস্থা এখন বিরাজমান। রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে অবিশ্বাস্য অভাবনীয় যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা বিরাজ করছে। অসহায় মানুষের আর্তি আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়লেও তা নিরসনের চেষ্টা নেই; এমনকি ক্ষমতাবান কোনো মানুষও নেই তা শোনার। বরং ক্ষমতাবান এবং তাদের অনুবর্তিরা বক্তৃতা-লেখায় মিথ্যার ফুলঝুরি উড়াচ্ছেন। সেই সাথে চলছে জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করে অশান্তি জিইয়ে রাখার চেষ্টা। এই দু’ভাগে ভাগ করার চেষ্টা স্বাধীনতার পরপরই ঠিক আজকের মতো শুরু হয়েছিল। তখন সাংবাদিক এনায়েতউল্লাহ খান তার বিখ্যাত প্রতিবাদমূলক প্রবন্ধ Ò60 Million CollaboratorsÓ লিখে সে কর্মকাণ্ডে একটু গতি থামাতে সক্ষম হন। এখন তেমন কোনো সাহসী লেখনী নেই সত্য বলার। আর তাদের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ যারা বিচারের অলীক আশায় ছোটাছুটি করছে। দুর্নীতি-ঘুষ-খুন-গুম যেন স্বাভাবিক সামাজিক ব্যবস্থা। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ এবং আলোচনা করলে তখনই সে রাষ্ট্রীয় চাপের সম্মুখীন হচ্ছে।
এ দেশে অনাচার-অন্যায় অতীতেও হয়েছে। তবে এমন তুলনীয় দৃশ্য কখনো দেখা যায়নি। যেমন গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে রাষ্ট্রযন্ত্রই কেড়ে নিল ২০০-এর বেশি সাধারণ মানুষের প্রাণ। আর অবাক কাণ্ড, ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখর থেকে সর্ব নিম্নপর্যায়ের রাষ্ট্রশক্তির ব্যক্তিরা এই হতভাগাদের দায়ী করল তাদের নিজেদের মৃত্যুর জন্য। কখনো কোনো বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অপবাদ দিয়ে, আবার নিছক তাদের জঙ্গি হিসেবে দাঁড় করিয়ে। এ ছাড়া রাস্তায় রাস্তায় ক্ষমতাবানেরা তাদের ক্যাডার-সমর্থকদের দিয়ে বিভিন্ন দিন-রাত্রির নাটক বিশাল পুলিশ পাহারায় মঞ্চস্থ করল। তাদের দাবি একজনের মৃত্যু। এই একজনের মৃত্যু দাবি কায়েম করতে এর মাঝেই দু’শ বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর কত যাবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এ উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর এত হত্যা রাষ্ট্রযন্ত্র গত সাড়ে ছ’ দশকে এক দিনে করেনি, যা গত ২৮ ফেব্রুয়ারিতে করল। অবশ্য রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখপাত্ররা বলেছে এ মৃত্যুর জন্য মৃতব্যক্তিরাই দায়ী।
একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি টেলিভিশনে টকশোতে বললেন, সেদিনের ৭০ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী প্রতিবাদকারীরাই। তারাই গুলি করেছে। অথচ খবরের কাগজে যে ছবি এবং বর্ণনা বেরিয়েছে তার সাথে এ বক্তব্যের কোনো মিল নেই। সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রকে হুকুম দিয়েছিলেন প্রতিবাদ দেখলেই গুলি করতেÑ তারপরে বলেছিলেন এরা কি শুধু আঙ্গুল চুষবে? এর আগে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে এ দেশে যদি রাষ্ট্রযন্ত্র বা ক্ষমতাসীনেরা প্রতিবাদকে শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ না করে তাহলে প্রতিবাদ সব সময়ই শান্তিপূর্ণ হয়। খবরের কাগজে প্রায়ই ছবি ছাপা হয় ক্ষমতাসীনদের কর্মীবাহিনী প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে এবং প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছে এবং তার ফলে মৃত্যুও ঘটছে। এসব ঘটনার পর কোনো ব্যবস্থা সরকারকে নিতে দেখা যায়নি।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, কেন এই নিষ্ঠুরতা? কেন বহুল আলোচিত গণতন্ত্রের মূল বিষয় ‘গণতান্ত্রিক সহনশীলতাকে’ ক্ষমতাবানেরা এড়িয়ে চলে? কেন এত মিথ্যাচার? নৈতিকতার পরাজয় এত প্রকট কেন? অবশ্য এর জবাব আছে এবং অনেক। তবে এ দেশের বিজ্ঞ আলোচকরা প্রায় একটি জবাবের ওপর জোর দেন। তা হলো ক্ষমতাবানেরা নিজেদের জনগণের সেবক ভাবেন না। তারা নিজেদের শাসক ভাবতে ভালোবাসেন এবং সে জন্য ক্ষমতাকে চিরকালের জন্য আঁকড়ে থাকতে চান। এ জন্যই তারা প্রতিবাদ দলনের চর্চা করে থাকেন। আর এই প্রতিবাদ দলনের জন্য ভীতি এবং লাশের রাজনীতি তাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এটা খানিকটা বিশ্বজনীন। খানিকটা ‘পাজল গেমের’ মতো। তবে এর চর্চা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকারের। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে এই চর্চা অতি অমার্জিত এবং নিষ্ঠুর। বাংলাদেশে এই রাজনীতি চূড়ান্তপর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, বলা মুশকিল। তবে ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে এ উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন হয় না যে, রাষ্ট্রযন্ত্র লাশের জন্য তার ক্রিয়াকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ-সমালোচনার মুখোমুখি হতে তারা আলোচনা নয়, ভীতির সৃষ্টি করে। অথচ সবকিছুই হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে। যে গণতন্ত্র বক্তব্যের ও প্রতিবাদের অধিকার দিয়েছে। আর রাষ্ট্র সবার নিরাপত্তার জন্য দায়ী। ক্ষমতাধরদের প্রায়ই বলতে শোনা যায় ‘তারা অনেক ধৈর্য ধরেছেন, আর নয়।’ এ বক্তব্য এলো রাষ্ট্রযন্ত্রের বহু লাশ সৃষ্টির পরপরই। জনগণ সত্যিই ভীত এখন।
অবশ্য অনেক লেখক রাষ্ট্রযন্ত্রের এই অমার্জিত শক্তি ব্যবহারকে ক্ষমতাসীনদের ভয়ের প্রকাশ বলেও মত দিয়েছেন। স্বৈরাচারী শাসকেরা প্রায়ই তাদের মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে এমনটি করতে থাকেন। যখন তাদের উপলব্ধি হয় যে ন্যায়, আইন ও জনসমর্থনের সাহায্যে তারা ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না তখন তারা সমাজ ও রাষ্ট্রকে অশান্ত করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে শক্তির সাহায্যে নির্মূল করতে চায়। অশান্তি সৃষ্টির নানা উপাদান তারাই প্রস্তুত করে যেমন পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি এবং অশান্তির দায়ভার প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেয়। যেহেতু সত্য কোনো না-কোনোভাবে প্রকাশ পায়, সে জন্য অশান্তির রাজ্য তারা প্রলম্বিত করার প্রয়াস পায়। তাই সবাই প্রশ্ন করতে থাকে, এরপর কী হবে? যেমনটি এখন এ বাংলাদেশে প্রশ্ন করা হচ্ছে। শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা সবাইকে আপ্লুত করে ফেলেছে। শুধু ক্ষমতাসীনদের একাংশ এ প্রশ্নের জবাব জানলেও তারাও উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত। তবে অনেকেই বলেছেন, এমন ভীতির রাজনীতি নির্বাচনতক চলবে এবং হয়তো বা আরও কঠোরতর হবে।
এর একটি কারণ বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভাগ্য প্রায়ই সে দেশগুলোর জনগণ নির্ধারণ করে না। এ দেশগুলোর ক্ষমতাবানেরা প্রায়ই এক অদৃশ্য শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। অবশ্যই এ শক্তি বাইরের। এখানকার ক্ষমতাবানেরা এই অদৃশ্য শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ছিটেফোঁটা স্বার্থের ভাগ পায়, এর ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই অদৃশ্য শক্তি তাদের সুপরিকল্পিত কর্মধারা বাস্তবায়ন করতে জনগণের ইচ্ছাশক্তিকেও পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এ কাজটি তারা মিডিয়া, সুশীলসমাজ বা বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত গোষ্ঠীদের দ্বারা সম্পন্ন করে থাকে। এরা ক্ষমতাবানদের সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা ও স্বার্থের ভাগবাটোয়ারা করে অদৃশ্য শক্তির কর্মকাণ্ডগুলোর বাস্তবায়ন ঘটায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের শোষকেরা ক্ষমতা দখল করে দেশের বাইরের জনগণকে শোষণ করার জন্য। আর তৃতীয় বিশ্বের শোষকেরা ক্ষমতা দখল করে নিজেদের জনগণকে অদৃশ্য শক্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে শোষণ করার জন্য।
একটি উদাহরণই যথেষ্ট হবে চিত্রটি পরিষ্কার করার জন্য। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের এই ক্ষমতাবানেরা তাদের অবৈধ সম্পদ ক্রমাগত তাদের অদৃশ্য শক্তির প্রভুদের দেশে স্থানান্তরিত করে ভবিষ্যৎ সংস্থানের আশায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সম্পদ তারা ভোগ করতে পারে না। কারণ হয় অদৃশ্য প্রভুরা এ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, নতুবা একপর্যায়ে ভাগবাটোয়ারার কোন্দলে এরা নিজেদের সমর্থকদের হাতেই নির্মূল হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও ল্যাটিন আমেরিকাসহ তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাবানদের এমন কাহিনী সবার জানা। তবুও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। হয়তো বা যাকে বলে ‘হিউম্যান ফ্রেইলটি’, সে জন্য। একই ভুল করতে ভালোবাসে ক্ষমতার ফেরিওয়ালারা। সুইজারল্যান্ডের মুদ্রার মান খুব উঁচু, যদিও তাদের তেমন উল্লেখযোগ্য রফতানি নেই। কারণ এসব ক্ষমতাবানদের অবৈধ সম্পদের পাহাড়ের ওপর সুইসরা বসে আছে। সে সম্পদ দাবি করার জন্য কেউ নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সম্পদ লুণ্ঠনের বিভিন্ন কাহিনী বের হলো। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কাহিনী। এক সময়ে মনে হয়েছিল ক্ষমতাবানেরা লজ্জা পাবে এবং জনগণ বিচারের মুখ দেখবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড। একজন ক্ষমতাবান (যিনি এসব রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে) হুংকার দিলেন, চার হাজার কোটি টাকা আবার টাকা নাকি! এর পর মনে হচ্ছে লুটেরা হালে পানি পেয়েছে এবং লুণ্ঠনের কথা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। খানিকটা বিখ্যাত কবি ডাবলু এইচ অডেনের বর্ণনার মতো। চার দিকে কী ভয়াবহ অবস্থা। কাউকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছে তখন শিশুরা স্কেট করছে। জাহাজ চলছে আর মানুষ ধীরেসুস্থে সর্বনাশ অবলোকন করছে (Horror is always elsewhere while someone is tortured, children are skating, ships sailing, dogs go on with their doggy life… How everthing turns away/ quite leisurely from disaster). তবে নাউমি উলফ (Naomi Wolf) সম্প্রতি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেছেন সর্বকালেই শুধু একদল দেশপ্রেমিক সব স্বৈরাচারের জুলুমের জোয়ারকে ঠেকানোর চেষ্টা করে (Only a handful of patriots try to hold back tide of tyranny for rest of us)। তাদের চেষ্টা আবার সারা জাতিকে জাগিয়ে তোলে। ঠিক এমনটিই দেখা গেল ৬ এপ্রিলে। বাংলাদেশে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হতাশ হয়ে হত্যা-জুলুমের রাজত্ব ধীরেসুস্থে আত্মস্থ করছিল একজন মানুষ তার জোরালো প্রতিবাদ জানাল। তখন লাখ লাখ মানুষ সমর্থন দিলো। এরা ধার্মিক বলে পরিচিত। এই ধার্মিকদের অপরাংশের ওপর নির্মম অত্যাচারের স্টিমরোলার চলছে। ক্ষমতাবানেরা এদের প্রতিবাদের সুযোগ দিয়ে আবার তা গুটিয়ে নিলো। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, সরকারি সমর্থকদের দিয়ে হরতাল করাল এবং তাও ছুটির রাতে! সাথে সাথে বন্ধ করে দেয়া হলো যাতায়াতের সব ব্যবস্থা। সবাই বিস্মিত হলো। এত বাধা-বিপত্তিÑপ্রতিরোধের মধ্যে জনগণ একত্রিত হয়ে জানিয়ে গেল জুলুমের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা, বিশ্বাসে আঘাতকারীদের প্রতি তাদের ঘৃণা। এতবড় সমাবেশ এ দেশে কখনোই আর হয়নি। ক্ষমতাবানদের ধন্যবাদ দিতে হয় এ জন্য যে, তারা রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে এসব মানুষের কোনো জীবন কেড়ে নেয়নি।
ধর্ম এবং ধার্মিক মানুষদের ‘আধুনিক প্রগতিবাদী ক্ষমতাবানেরা’ কেন প্রতিরোধ করে, জুলুম করে নিশ্চিহ্ন করতে চায়? এর চমৎকার জবাব দিয়েছেন এক নাস্তিক। রাশিয়ান লেখক ডিমিট্রি ওরলভ (Dmitry Orlov) তার ‘ধ্বংসের পাঁচ পাদ’ (Five Stages of Collapse) বইতে বলেছেন, সাংস্কৃতিক ধ্বংস (Cultural Collapse) হয় তখন যখন মানবতার কল্যাণকে অবহেলা করা হয়। বিশ্বাস হারিয়ে যায়। তিনি পাঁচ পদের শেষ দু’টি পদকে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ধ্বংস বলে বর্ণনা করেছেন। এখানে বলা হয় অনাচার ও অবিচার কেমন করে মানবিক গুণাবলিকে ধ্বংস করে। কথাগুলোকে ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখা হলে এটা স্পষ্ট হবে যে, ক্ষমতাবানেরা যা প্রিয় মনে করে তা ধর্ম এবং ধার্মিকেরা অগ্রহণীয় বলে বর্ণনা করে। তা হলো অনাচার এবং অবিচার। অরলভ বলেছেন, অবিচার ও অনাচার সমাজ ধ্বংস করে (Social Collapse)। বাংলাদেশে এখন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ধ্বংসের সব চিহ্ন স্পষ্ট। ওরলভের সতর্কবাণী হলো, এখনই এর প্রতিরোধ না হলে আইনের শাসন অকার্যকর হবে এবং সর্বনাশা আধিপত্যের জোয়ার রোধ সম্ভব হবে না এর জন্য দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা এবং কর্মকাণ্ড প্রয়োজন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads