সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৩

গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসুন



দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার এবং দীর্ঘ ১৩ দিনের জন্য রিমান্ডে নেয়ার পর থেকেই দেশের সকল মহলে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন ও ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শুধু নন, পেশাজীবী ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও তার মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল সারাদেশে অনশন করেছেন সাংবাদিকরা। অন্যদিকে ১৩ এপ্রিল ৩৩টি ইসলামী সংগঠনের নেতারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকার প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক-মুরতাদ ব্লগারদের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। কারণ, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র আল-কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কে অশালীন ভাষায় কটূক্তি করাসহ ভয়ংকর অপপ্রচার চালাচ্ছিল বলেই মাহমুদুর রহমান ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন অবস্থায় ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশের ‘নির্বাচিত’ সরকার হিসেবে দায়িত্ব যেখানে ছিল ব্লগারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া, ক্ষমতাসীনরা সেখানে উল্টো মাহমুদুর রহমানকেই জেলের ভাত খাওয়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। নিয়েছেনও রীতিমতো কমান্ডো স্টাইলে। ১১ এপ্রিল আমার দেশ অফিস থেকে গ্রেফতার করার এবং সেদিনই তিনটি মামলায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়ার পর রাতের বেলায় আমার দেশ-এর ছাপাখানায় তল্লাশি চালানোর পর তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ। গণমাধ্যম বিরোধী ফ্যাসিস্ট এই অভিযানে মাহমুদুর রহমানের বৃদ্ধা মা এবং দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকেও মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। পুলিশ এমনকি প্রেসের গরিব ১৯ জন বাইন্ডারকে পর্যন্ত গ্রেফতার করে জেলখানায় ঢুকিয়েছে। এভাবে অভিযান চালানোর মাধ্যমে সাংবাদিকদের মধ্যে শুধু ভীতি-আতংকই ছড়িয়ে দেয়া হয়নি, একই সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণেরও পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর ফলে আক্রান্ত হয়েছে বিশেষ করে আমার দেশ। সরকার দৈনিকটির প্রেসে তালা লাগিয়ে দেয়ায় এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে সরকারের কৌশল লক্ষ্য করা দরকার। সরকার কিন্তু আমার দেশকে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করেনি। এই না করার কারণ অবশ্য ক্ষমতাসীনদের মহানুভবতা বা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নয়। আসল কারণ হলো, এ ব্যাপারে সংবিধানে নিষেধ রয়েছে। এজন্যই বাঁকা পথে হাঁটতে শুরু করেছেন ক্ষমতাসীনরা। তা সত্ত্বেও তাদের উদ্দেশ্য ও কৌশল কিন্তু গোপন থাকেনি। ক্ষমতাসীনদের সকল পদক্ষেপের প্রধান কারণ হিসেবে এসেছে হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক লংমার্চ, মহাসমাবেশ ও ১৩ দফা দাবিনামা এবং এসব বিষয়ে দৈনিক আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকা। স্মরণ করা দরকার, হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ভ-ুল করার জন্য সরকারের মদদে সর্বাত্মক তৎপরতা চালানো হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ নামসর্বস্ব কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ৫ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে লংমার্চের দিন ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নজীরবিহীন এক হরতালের ডাক দেয়া হয়েছিল। লাফিয়ে এসেছিল শাহবাগের নাস্তিক ব্লগাররাও। তারা দিয়েছিল অবরোধের ঘোষণা। সবারই উদ্দেশ্য ছিল লংমার্চকে বাধাগ্রস্ত করা এবং ঢাকায় আয়োজিত মহাসমাবেশকে ভ-ুল করে দেয়া। সরকারের উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি। সব বাধা ও হামলা প্রতিহত করেই লংমার্চ ও মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। এজন্যই লংমার্চের পরপর শুরু হয়েছিল দমনের নিষ্ঠুর অভিযান। এই অভিযানে প্রথমে আক্রান্ত হয়েছেন মাহমুদুর রহমান। কথাটা বলার কারণ, তেজগাঁও থানার যে মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর। অন্যদিকে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল। মাঝখানে দীর্ঘ চারটি মাস কেটে গেছে। কোনো মামলার ব্যাপারে অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ করার জন্য নিশ্চয়ই এত বেশিদিন সময় লাগার কথা নয়। সবশেষে ধর্মীয় বিষয়ে উস্কানি দেয়ার মতো অভিযোগ উত্থাপনের মধ্য দিয়েও সরকার প্রমাণ করেছে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পেছনে আসল কারণ হেফাজতে ইসলামের সমর্থনে পালিত তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। অন্য কিছু পদক্ষেপের কারণেও সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় ঘনীভূত হয়েছে। যেমন নিতান্ত লোক দেখানোর জন্য জনা পাঁচেক মাত্র নাস্তিক ব্লগারকে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশকে বেশি তৎপর দেখা গেছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরসহ বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। হাজারের অংকে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, এখনো গ্রেফতার করা হচ্ছে। পুলিশ মামলাও ঠুকেছে লাখ পাঁচেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। সে পুলিশই আবার সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ব্লগারদের ব্যাপারে নামকাওয়াস্তে নড়াচড়া করেছে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘স্পর্ধা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার ঔদ্ধত্য দেখানোর পরও শাহবাগী নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বলাবহুল্য, এর ফলে সাহস বেড়ে গেছে শাহবাগের ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের। ঘাদানিকের মতো নামসর্বস্ব সংগঠনগুলোও ইসলাম ও মুসলমানবিরোধী তৎপরতাকে জোরদার করার সাহস পেয়েছে। উদ্বেগের কারণ শুধু এটুকুই নয়। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যও যথেষ্ট আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। যেমন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১১ এপ্রিল বলে বসেছেন, হেফাজতে ইসলাম নাকি বেড়ালের মতো ‘লেঙ্গুর গুটিয়ে’ পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছে! হেফাজতের ১৩ দফার কোনো একটিও নাকি গ্রহণযোগ্য নয়। সৈয়দ আশরাফের পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার ধমকই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাদের অর্থাৎ সরকারের ধৈর্যের নাকি সীমা আছে! প্রতিবাদ উঠেছে এজন্য যে, ‘লেঙ্গুর’ ধরনের অশ্লীল শব্দ কোনো ক্ষমতাসীন নেতার কাছে আশা করা যায় না। শক্তি ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সরকারের উস্কানির মুখেও হেফাজত অবশ্য ধৈর্য ও সংযমের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। না হলে ৬ এপ্রিলই সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজতে পারতো। কিন্তু হেফাজতের দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নেতারা সরকারের উস্কানি সত্ত্বেও ফাঁদে পা দেননি। অন্যদিকে সে দায়িত্বশীলতাকেই দুর্বলতা ও অক্ষমতা হিসেবে ব্যঙ্গ করেছেন সৈয়দ আশরাফ। প্রধানমন্ত্রীও ধৈর্যের কথা বলে প্রকারান্তরে ধমক দিয়েছেন। একযোগে সরকারের দিক থেকে শুরু হয়েছে দমন ও গ্রেফতারের অভিযান, যার প্রথম শিকার হয়েছেন মাহমুদুর রহমান। এভাবে ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ৩৩টি ইসলামী সংগঠনের নেতারা যথার্থই অভিযোগ তুলেছেন, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকার আসলেও নাস্তিকদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। আমরা মনে করি, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়ার পরিণতি শুভ হতে পারে না। এজন্যই সরকারের উচিত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসা, মাহমুদুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া, প্রেসের তালা খুলে দিয়ে আমার দেশ-এর প্রকাশনা শুরু করতে দেয়া এবং হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করা। অন্য সবাইকেও মুক্তি দিতে হবে, প্রত্যাহার করতে হবে সব মামলাও।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads