শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

ধর্মদ্রোহী ও বিদ্বেষীদের শাস্তির দাবি


যারা ধর্মদ্রোহী, আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর অবমাননাকারী তাদের এক কথায় বলা হচ্ছে নাস্তিক। তবে অভিধানে যে ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্বে ও পরকালের সত্যতায় বিশ্বাস করে না তাকেই বলা হয় নাস্তিক। আরবিতে কাফের। আবার আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেও যারা পরকালে বা হজরত মুহাম্মদ সা:-কে আল্লাহর নবী হিসেবে বিশ্বাস করে না, মানে না আর আল্লাহর হুকুম মানতে প্রকাশ্যে অস্বীকৃতি জানায়, তারাও কাফের। কাফেরের আরেকটি যুগল পরিভাষা মুশরিক। বাংলায় অংশীবাদী পৌত্তলিক। যারা দেব-দেবী, মূর্তি, মানুষ বা জড়-অজড় কোনো বস্তুকে আল্লাহর সমকক্ষ বা আল্লাহর ক্ষমতায় অংশীদার বলে বিশ্বাস করে বা পূজা করে তারা মুশরিক নামে পরিচিত।

ইদানীং বাংলাদেশে যে অর্থে নাস্তিক শব্দের ব্যবহার হচ্ছে, তাতে সাধারণ কাফের বা মুশরিক বুঝানো হচ্ছে না; বরং ধর্মদ্রোহী, আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর অবমাননাকারী কিংবা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগারকারীদেরই নাস্তিক আখ্যায়িত করে তাদের শাস্তি দাবি করা হচ্ছে। একে আমরা শাব্দিক নয়, পারিভাষিক অর্থ বলতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন কাউকে বলি ‘ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করো’ তখন এ কথা বুঝানো হয় না যে, মাথাটা বরফের পানিতে ভিজিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে; বরং শান্ত মেজাজে কাজ করার পরামর্শ বুঝানো হয়। অনুরূপ ‘লোকটার মাথা গরম’ বললে তার মাথায় হাত দিয়ে উষ্ণতার মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে না। কারণ, কথায় কাজে উত্তেজিত হয়ে যায় এমনটি বুঝাতেই বলা হয় ‘মাথা গরম’। অনুরূপ আল্লাহদ্রোহী ও ইসলামের অবমাননাকারী অর্থে নাস্তিক শব্দটির প্রয়োগ পারিভাষিক, আক্ষরিক নয়। নচেৎ যেকোনো সমাজে নাস্তিক থাকতে পারে, যেমন কাফের, মুশরিক বা অন্য ধর্মাবলম্বীও থাকে। এরা যতক্ষণ ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর সীমালঙ্ঘন না করে বা আক্রমণ না চালায় ততক্ষণ তাদের সাথে সঙ্ঘাতে বা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিধান ইসলামে নেই।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে কিছু ব্লগার রাসূল সা: ও ইসলামের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কুৎসিত ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ চালিয়েছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে আজ প্রতিটি মুসলমান ক্ষুব্ধ ও তাদের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার। ব্লগারদের মুখপাত্র প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যদিও বলেছেন যে ‘কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নাই’ বা তিনি কি না ব্যক্তিগতভাবে মুসলমান; কিন্তু তার সতীর্থরা যে ব্লগে এমন সব কুৎসিত কথা লিখে ছড়াল, সে সম্পর্কে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি বা তাদের গর্হিত কাজটির নিন্দা করেননি। অথচ সরকারি তদন্ত কমিটিও ফাঁস করে দিয়েছে, অন্তত ৮৪ জন ব্লগার ইসলামবিরোধী প্রচারণায় জড়িত। এরাই এখন সারা দেশে চরম বিশৃঙ্খলা ডেকে এনেছে। এই নাস্তিক মুরতাদদের বিরুদ্ধেই আজ হেফাজতে ইসলামের ডাকে মুসলমানরা বিক্ষোভে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে।
যারা বলে, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামের বিরুদ্ধে কেউ মন্দ বললেও তা সহ্য করে যেতে হবে, ইসলামের হেফাজত আল্লাহ করবেন, তাদের ভেবে দেখার জন্য বলব যে, আমাদের প্রিয়নবী সা: প্রচলিত অর্থে কোনো নিরীহ মহাপুরুষ ছিলেন না। কিংবা অনেক পীর বুজুর্গের মতো সংসারবিরাগী তাপস ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন সংসারী সংযমী মানুষ। মানবীয় গুণাবলির বিকাশসাধন ও সুন্দর জীবনযাপনের সর্বোত্তম আদর্শ ছিল তার জীবন। তিনি ধর্মপ্রচারক ছিলেন, সাথে রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। বিচারপতি ছিলেন, আবার সেনাপ্রধানও ছিলেন। মাত্র ১০ বছরের মাদানী জীবনে ৭০-এর অধিক অভিযান পরিচালনা করেছেন আর ২৭টি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেসব যুদ্ধ ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর আক্রমণ-উদ্যত কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে যেসব পাপীষ্ঠ নবীজীর নিন্দা করেছিল, মদিনার জীবনে তাদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। কা’ব ইবনে আশরাফ ও আসমা বিনতে মারওয়ান ছিল এসব পাপীষ্ঠর অন্যতম।
আমাদের দেশের কতক বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবী বলছেন যে, কুরআনে নাস্তিক প্রসঙ্গ নেই। হ্যাঁ, বাংলা নাস্তিক শব্দটি কুরআন মাজিদে পাওয়া যাবে না। কুরআন তো আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। তবে কাফের-মুশরিক-মুরতাদদের কথা কুরআন মাজিদে অবশ্যই আছে এবং তা সর্বত্র বিদ্যমান। বাংলায় নাস্তিক বলতে তাদেরই বুঝানো হয়। কাজেই কুরআন মাজিদে যদি নাস্তিকদের প্রসঙ্গ না থাকে, আর শুধু মার খেয়ে যাওয়াই ইসলামের বিধান হয়, তাহলে নবী করিম সা: যে মদিনার জীবনে এতগুলো যুদ্ধ করলেন, কার বিরুদ্ধে? ওই সব যুদ্ধের ব্যাপারে কুরআন মাজিদের এত আয়াত, পর্যালোচনা, নির্দেশনা কিসের জন্য? কারো মাথা খারাপ হলেই তো এমন কথা বলতে পারে।
রাতে কোন এক টিভি চ্যানেলে টকশোতে একটি কাগজে কুরআন মাজিদের দু-তিনটি আয়াতের অর্থ দেখিয়ে একজন বুঝাতে চাইলেন, কেউ আল্লাহকে গালি দিলে বা ইসলামের প্রতি কটাক্ষ করলে আল্লাহর নির্দেশ হলো, ভদ্রভাবে এড়িয়ে যাওয়া বা ঝগড়া না করা। কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় তার স্পর্ধা দেখে অবাক হলাম।
মরহুম সৈয়দ আলী আহসানের মুখে অন্তত দুইবার শুনেছি, একজন ঊর্ধ্বতন প্রটোকল অফিসার তার কাছে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন : একজন বিচারপতি দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের পদে আসীন হওয়ার পর তিনি অনেকটা বাধ্য হয়ে বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজে শরিক হবেন। তখন পুলিশ অফিসারের কাছে জানতে চাইলেন, নামাজ কিভাবে পড়তে হয়। অফিসার কয়েকবার উঠবোস করে দেখিয়ে অভয় দিলেন, স্যার! নামাজে আমি আপনার পাশে থাকব। বস্তুত এই শ্রেণীর লোকেরা যখন কুরআন মজিদ থেকে উদ্ধৃতি দেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তিনি কি কুরআন মাজিদের সংশ্লিষ্ট আরো আয়াত পড়ে দেখেছেন?
‘তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না, যে অবস্থায় তোমরা নেশাগ্রস্ত থাকো’। কুরআন মাজিদের এ আয়াতের প্রথমাংশ বা পুরো ভাষ্য সামনে নিয়ে যদি তিনি ব্যাখ্যা দেন যে, আমাকে নামাজের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করা হয়েছে; কিংবা আমরা প্রায় নেশাগ্রস্ত থাকি বিধায় নামাজ পড়তে আমাকে বারণ করা হয়েছে, তাহলে তাদের মনোবৈকল্যের নিন্দা কী ভাষায় করা যাবে?
যা-ই হোক, সব দিক বিবেচনা করে আমার মতে, তাদের নাস্তিক না বলে মুরতাদ বলাই উত্তম ও যথার্থ হবে। মুরতাদ মানে যারা ইসলাম ত্যাগ করেছে। যে মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর মুসলমান ছিল; এরপরে ইসলাম ত্যাগ করেছে কিংবা যে অন্য ধর্ম থেকে এসে ইসলাম গ্রহণ করার পর আবার ইসলাম ত্যাগ করেছে, সে মুরতাদ এবং তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ধরুন, দেশের কোনো নাগরিক বা বাইরের লোক এসে নাগরিকত্ব নেয়ার পর যদি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে, দেশের সীমানা তুলে দেয়ার কথা বলে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, সে নিশ্চয়ই যেকোনো বিবেচনায় রাষ্ট্রদ্রোহী ও প্রাণদণ্ডযোগ্য। ইসলামকে গ্রহণ ও বর্জন করার বিষয়টিও নাগরিকত্ব গ্রহণ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাথে তুলনীয় এবং তা ইসলামি সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ। এর জন্য কঠিন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে পুরো ইসলামি সমাজ খেলনার বস্তুতে পরিণত হবে।
মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরিয়তের বিধান ফিকাহ শাস্ত্রের কিতাবগুলোতে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। সংক্ষিপ্ত কথা হলো, মুরতাদ যদি তওবা করে আবার ইসলামে ফিরে না আসে, তাহলে পুরুষদের বেলায় মৃত্যুদণ্ড ও নারীর বেলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রযোজ্য। মুরতাদ আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর কী রকম দুশমন এবং দেশ ও জাতির জন্য কত ভয়ঙ্কর আর তাদের পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে কত শোচনীয় হবে তার বিবরণ রয়েছে কুরআন মজিদে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন : ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ স্বীয় দ্বীন (ইসলাম) হতে ফিরে যায় এবং কাফের রূপে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের কর্মসমূহ নিষ্ফল হয়ে যায়। তারাই দোজখবাসী এবং সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’। সূরা বাকারা (২),আয়াত-২১৭।
‘যারা নিজেদের নিকট হেদায়তের পথ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর তা পরিত্যাগ করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশায় প্রলুব্ধ করে’।
সূরা মুহাম্মদ (৪৭),আয়াত ২৫।
‘আল্লাহ কী রূপে সৎপথে পরিচালিত করবেন সেই সম্প্রদায়কে, যারা ঈমান আনয়নের পর ও রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দান করার পর এবং তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসবার পর কুফরি করে। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না’।
সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত-৮৬।
কুরআন মজিদে মুরতাদ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি আয়াতে আলোচনা রয়েছে। যেমন, সূরা বাকারা (২), আয়াত ১০৮; সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৪৯ ও ১৭৭; সূরা মায়েদা (৫), আয়াত ৫৪; সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৬৫-৬৬ ও ৭৪; সূরা নাহল (১৬),আয়াত ৫৫।
সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্, সব মাজহাব ও ফিকাহ শাস্ত্রের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর যদি মুরতাদ কথায় কাজে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে, সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগায়, তাহলে তো দেশদ্রোহীর মতোই চরম শত্রু হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে কেউ মুরতাদ হয়ে গেছে কি না তা আদালত দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া ছাড়া কাউকে মুরতাদ নামে আখ্যায়িত করা যাবে না। তওবার আহ্বান জানানো এবং মুরতাদের পক্ষ থেকে আবার ইসলাম গ্রহণ বা বর্জনের ব্যাপারে আদালতের ফায়সালা ব্যতীত কেউ শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করতে পারবে না। এ জন্যই আমাদের দেশের মুরতাদ ব্লগারদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে সংসদে আইন পাস ও আদালতের আওতায় সে শাস্তি প্রয়োগের জন্য হেফাজতে ইসলাম সমগ্র জাতির হয়ে জোর দাবি জানিয়েছে। সে দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে আমরা এখন বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads