শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

লংমার্চ : এক অবিস্মরণীয় প্রেরণা


একটা কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ কয়েকটি ব্যাপারে অনড় অবস্থানে পৌঁছে গেছে। যেমন আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখরা সামাজিক শক্তি। তারা যে সত্যিকার অর্থেই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ঈমানের হেফাজত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার অতন্দ্র পাহারাদারÑ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারেও একটা উপসংহারে পৌঁছে গেছে। তারা চেতনা বোঝে না, যা বোঝে সেটার নাম প্রেরণা। এ ব্যাপারে তারা আর কোনো ছাড় দিতে চায় না। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও নৃ-গোষ্ঠী নিয়ে আমরা যে বাংলাদেশী, তাতেও একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। জাতীয় নেতাদের ব্যাপারেও মানুষ নিজেদের মতো করে উপসংহার টানার পক্ষে। তারা মনে করে, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী যেমন জাতীয় নেতা, তেমনি তাদের মতো সব সীমাবদ্ধতা নিয়েও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক, বঙ্গবীর ওসমানী সিপাহশালার।

সামাজিক শক্তি হিসেবে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখরা দলনিরপেক্ষ অবস্থানে কতটা মাটি-মানুষের কাছের মানুষ সেটা উপলব্ধি করা সবার জন্য কল্যাণকর। আরো কল্যাণকর হবে আমাদের জাতিসত্তার সাথে ইসলামি চেতনা লেপ্টে থাকার চিরায়ত বিষয়টি মর্যাদার সাথে বুঝে নেয়ার মাধ্যমে। গতকালকের লংমার্চ যদি সরকার ও বিরোধী দলের চোখ খুলে দেয় তাহলে জাতির মর্যাদা বাড়বে। জাতি দিশা খুঁজে পাবে।
হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। তাদের কর্মসূচি সার্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করেছে। সমর্থন পেয়েছে দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও নৈতিক সমর্থন দেয়া হয়েছে। দেশের সব ইসলামপন্থী দল এই কর্মসূচির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল নজিরবিহীন। ইসলামকে হেফাজতের লক্ষ্যে আহ্বায়কদের পক্ষ থেকে দেয়া ১৩ দফা দাবিও সুনির্দিষ্ট। কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করলেও এর সাথে আপামর জনগণ একাত্মতা প্রকাশে কোনো দ্বিধা ও সঙ্কোচ বোধ করেনি। সরকার আলেমদের অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করলেও লংমার্চ আহ্বানকারীরা সরকারের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেননি। ক্ষমতার রাজনীতিতেও তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করেননি। তাদের প্রতিপক্ষ সরকার বা কোনো দল নয়। ইসলামবিদ্বেষী এবং মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রƒপ ও কটাক্ষকারীদের বিরুদ্ধেই তাদের বক্তব্য। আল্লাহ-রাসূল সা: ও ইসলামের ব্যাপারে অজ্ঞতা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার মতো ঘৃণ্য তৎপরতার বিরুদ্ধে তাদের যত কথা ও ক্ষোভ।
সরকার তৌহিদি জনতার প্রতিনিধিত্বকারী আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের এই কর্মসূচিতে বাধার পরিবর্তে নিরাপত্তা দিলে উপকৃত হতো। লাভবানও হতো। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। সরকার ও প্রশাসনযন্ত্র আর তাদের অনুগত কিছু গণবিচ্ছিন্ন বাম রাজনীতিবিদকে এর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। এক ধরনের বকধার্মিক ও দরবারি আলেমদের দিয়ে মিথ্যা প্রচারণা ও মতদ্বৈধতা সৃষ্টির অপতৎপরতা চালিয়েছে। যা তৌহিদি জনতার প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানকে দিয়েও আলেমদের সামগ্রিক তৎপরতাকে ভণ্ডুল করে দিতে অপচেষ্টা চালিয়েছে সরকার। শেষ পর্যন্ত শাহবাগ মঞ্চ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামকে দিয়ে পাল্টা হরতাল অবরোধের মতো সাংঘর্ষিক কর্মসূচি ঘোষণা করিয়েছে। গণপরিবহন মালিকদের যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করেছে। সড়ক-মহাসড়কে তল্লাশির নামে হয়রানি করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে গণগ্রেফতারের হুমকি, পরিকল্পিত ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি, ফেরি সচল না রাখার ব্যবস্থাসহ হেন কাজ নেই যা লংমার্চকে ভণ্ডুল করার জন্য উদ্যোগী হয়ে সরকার করেনি। রেল, স্টিমার বন্ধ করাও নজিরবিহীন। পুরো লংমার্চকে জামায়াত-শিবিরের কর্ম, হেফাজতে ইসলাম নয় হেফাজতে জামায়াত-শিবির ও ১৮ দলীয় জোটের ‘অপতৎপরতা’ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। সরকার সমর্থিত মিডিয়াও এ লক্ষ্যে প্রচারণা ও প্রতারণারও আশ্রয় নিয়েছে।
এ দেশের আলেমসমাজ নানা বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেও আল্লাহ-রাসূল সা: এবং ইসলামের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ ও সব ধরনের ফের্কার ঊর্ধ্বে এক কাতারে দাঁড়ানোর ঐতিহ্যসমৃদ্ধ একটি সামাজিক শক্তি। সরকার আলেম-ওলামাদের এই ঈমানী চেতনা ও আপসহীন অবস্থানকে কটাক্ষ করার সাথে সাথে তাদের সমর্থিত বি টিমগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে নিজেদের গণবিচ্ছিন্ন ও ইসলামবিদ্বেষী হওয়ার দায় নিয়েছে। সরকারের এই অদূরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতা বোধ করি তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে। অরাজনৈতিক আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের কাছে না টেনে দূরে ঠেলে দেয়া, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা ও রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবেলার খেসারত সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে।
সব প্রতিবন্ধকতার পরও লংমার্চের সফলতা সবার চোখ খুলে দেয়ার কথা, যা জনগণের মনে প্রেরণাদায়ক হয়ে ধরা দিয়েছে। সরকারের নেতিবাচক ভূমিকা জনগণকে আরো সংুব্ধ করে লংমার্চের কর্মসূচির সাথে একাত্ম করে দিয়েছে। যে লংমার্চের কর্মসূচি ৬ মার্চ শেষ হয়ে যেতে পারত, সেটাকে সরকার গ্রামেগঞ্জে ও ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ের ভেতর ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। ধর্মবিদ্বেষী শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সরকার নিজের স্বরূপই শুধু স্পষ্ট করেনি, চরম হঠকারিতা প্রদর্শন করে জাতিঘাতী ভূমিকা নিয়ে একটি আদর্শিক মেরুকরণের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। এখন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ধর্মীয় চেতনা লালন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা জাতিকে পথ দেখাবে। লংমার্চ এখন একটি অবিস্মরণীয় সার্বজনীন প্রেরণা। সরকারি প্রচণ্ড বাধার মুখেও যারা এমন সুন্দরভাবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে পারেন, তাদের যোগ্যতা ও নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই কল্যাণকর। জাতি এই লংমার্চের মধ্য দিয়ে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করার সুযোগ পেল। জাতিসত্তার স্বরূপ উপলব্ধির এ ধরনের সুযোগ বারবার আসে না। যারা এর মর্মবাণী বুঝবে না, তাদের জন্য দোয়া করেও লাভ নেই। আজাব-গজব কিংবা অপমানজনক পরিণতিই তাদের ললাটের লিখন।
শাপলা চত্বরে যে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করা গেল এটাই অলি-আল্লাহর বাংলাদেশ। শহীদ-গাজীর বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ। বিশ্বাসী মানুষের বাংলাদেশ। স্বাধীনচেতা গণমানুষের বাংলাদেশ।
এই বাংলাদেশই সবার চেনা-জানা। ইনশাআল্লাহ বলে যে বাংলাদেশকে মুক্ত করার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, আল্লামা শফী সেই বিশ্বাসেরই প্রেরণা জোগালেন। যারা এই জনপদের এই বৈশিষ্ট্য বুঝবেন নাÑ তারা পরগাছাই থেকে যাবেন। যারা এ দেশের মানচিত্র চিনবেন না তারা ভুইফোঁড় হয়ে থাকবেন। এবার তাদের রাজনীতির শেকড় উপড়ে ফেলার টান পড়েছে। মাটিও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন না বুঝলে তারা সমূলে উৎপাঠিত হবেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
২.
একজন জার্মান দার্শনিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ খাড়া করেছেন, পৃথিবীতে নাস্তিক বলে কোনো প্রাণী নেই। তারুণ্যের রঙিন চশমায় সব ঋতুকেই বসন্ত মনে হয়, সব স্বপ্নই আকাশ ছুঁতে চায়। তখন একবার সব কিছুকে অস্বীকার করার দুর্বার আকাক্সা জাগে। এটা সঠিক খাতে প্রবাহিত হলে ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে। নয়তো তারুণ্যকে বিপথগামী করে। মানুষ স্বভাবগতভাবেই আনুগত্যপরায়ণ। মানুষের ভেতর আনুগত্যের বীজ সহজাত। সঠিক স্রষ্টা কিংবা আনুগত্যের আধার না চিনলে তারা যেকোনো শক্তির কাছে মাথা নত করে। প্রকৃতির পূজা করে। যারা এক সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করে না, তারা স্বভাবগত কারণেই দেবতা বানিয়ে মানুষের পূজা করে। এই ধরনের তারুণ্যের দ্রোহের স্থিতিকাল ৪০ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। তারুণ্যের এই আকাক্সা বা নেতিবাচক দিকটিকে পরিচালতি করে কুপ্রবৃত্তি। এরা প্রবৃত্তির দাসত্বকে ভাবে নাস্তিকতা। আসলে নাস্তিকতা বা কুপ্রবৃত্তি নিজের ইচ্ছার দাসত্ব করে। এটা এক ধরনের চিন্তার বৈকল্য। এ ধরনের চিন্তা নিজের মতো করে এক ধরনের নীতি-নৈতিকতার সংজ্ঞা তৈরি করে। সেখানে নেশা ও যৌনাচার কোনো অনৈতিক কাজ নয়। এই নাস্তিকতা ও নিজস্ব চিন্তার দাসত্ব রোগে আক্রান্তরা নিজেকে অতি বুদ্ধিমান ও চালাক মনে করে। তাদের মধ্যে এক ধরনের ধুর্তামিও প্রশ্রয় পায়।
একই জার্মান দার্শনিকের গবেষণায় ধরা পড়েছে, এরাই ৪০ বছর পার করে একেবারে পাল্টে যায়। তখন নিজেকে প্রকৃতি বা সৃষ্টিকর্তার কাছে সমপর্ণ করে তৃপ্তি খুঁজে নিতে চেষ্টা করে। এ মনোদৈহিক রোগের মূল কারণ পিতা-মাতা-স্বজন-প্রিয়জন, পরিবার কিংবা প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছে সঠিক পথের সন্ধান না পাওয়া। এরা বখে যাওয়া বা উচ্ছন্নে যাওয়া কোনো ভবঘুরে যুবক নয়। এদের বুদ্ধিবৃত্তির একটা নিজস্ব জগৎ আছে। এই জগৎ সম্পর্কে যারা কম জানবেন তারা এ ধরনের তরুণদের ধিক্কার জানাতে গিয়ে জেদ বাড়িয়ে দেন। যেহেতু রোগটি সঠিক পথের সন্ধান না পাওয়া থেকে জন্ম নেয়া এবং নিরাময়যোগ্য, তখন তাদের নাস্তিক গালি দিয়ে দূরে ঠেলে না দেয়াই ভালো। এখানে স্পষ্ট করে জেনে রাখা দরকার, ধর্মবিদ্বেষ আর নাস্তিকতা এক বিষয় নয়। নাস্তিক নিজের ভেতর নিজেকে ধরে রাখে, ধর্মবিদ্বেষ ছড়ায় না, তবে কোনো কোনো বামপন্থী রাজনীতির লোক অতি উৎসাহী সেজে যায়। এরা নাস্তিকও নয়, ধর্মবিদ্বেষীও নয়, এরা মতলববাজ। বিদেশী দালাল। এরাই বাম রাজনীতিবিদ নামের ভুয়া তত্ত্বের আড়ালে খোদাদ্রোহী ফেরিওয়ালাদের সাজানো মানসিক গোলাম। চিন্তার দেউলেপনা থেকে ওরা মনোস্তাত্ত্বিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে বেড়ে ওঠে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিগত শতকের সত্তরের দশকে মাওবাদের সবক পেয়েছিলাম। চেয়ারম্যান মাওয়ের পাঁচটি উদ্ধৃতি মুখস্থ করে কেয়া হনুরে ভাবতে লাগলাম। খোদার আরশ ছেদ করে যাওয়ার মতো দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। ভাগ্যিস অল্পতেই ঘোর কেটে গেছে। নাস্তিক সাজানোর গুরু ছিলেন দিলিপ সোম নামে আমাদের মফস্বল শহরের একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সম্প্রসারণ ও আধিপত্যবাদীদের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ করতে চাননি বলে যুদ্ধে যাননি। তারপর শুনেছি কমরেড সিরাজ সিকদারের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার পরের কোনো তথ্য জানা নেই। তাই তরুণদের দূরে ঠেলে না দিয়ে আগলে রাখাই কল্যাণকর। তারুণ্যকে যারা বিপথগামী করছে তাদেরও শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। যারা গোমরা বা মতান্ধ তাদের ব্যাপারে ফয়সালার ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম।
তবে ধর্মদ্রোহী ও বিদ্বেষীদের ক্ষমা করা উলুবনে মুক্তা ছড়ানো মাত্র। যে যেই ধর্ম পালন করুক, ধর্মপন্থী মানুষ মাত্রই কল্যাণকামী ও অসাম্প্রদায়িক। তাই ধর্মদ্রোহী ও বিদ্বেষী যে ধর্মেরই হোক মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর। এদের উপড়ে ফেলাই দেশ-জাতির জন্য মঙ্গল। আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখরা লংমার্চে সেই আহ্বান জানিয়েই নন্দিত হলেন। অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রইলেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads