বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

সাভারের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয় গণহত্যা


সাভারের রানা প্লাজায় যা ঘটেছে, তা সুস্পষ্টভাবে এক গণহত্যা। কোনো মতেই মামুলি কোনো দুর্ঘটনা নয়। উইকিপিডিয়াতে গণহত্যার (Mass murder) সংজ্ঞায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, যখন এক বা একাধিক ব্যক্তি কোনো একটি ঘটনায় চার বা ততোধিক মানুষকে হত্যা করে, তখন সেটি গণহত্যা বলে গণ্য হবে।

উইকিপিডিয়ার মতে, গণহত্যা সরকারি এজেন্টও সংঘটন করতে পারে। সেটি ইচ্ছা করে এবং বাছবিচারবিহীনভাবেও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, যখন সরকারি এজেন্ট নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় সেটাও গণহত্যা। তবে এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কিংবা জেনোসাইড নয়।
সাভারে ভবন ভেঙে পড়ে চারজনের বেশি মানুষ মারা গেছে। এ লেখা তৈরি করা পর্যন্ত সময়ে দুই শতাধিক লোক মারা গেছে। ঘটনাটি যদি হঠাৎ করেই ঘটত, তাহলে এটি হয়তোবা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আলোচ্য ভবনটিতে ধসে পড়ার এক দিন আগে ফাটল দেখা গিয়েছিল। বিষয়টি ভবনের মালিক ও স্থানীয় প্রশাসন সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। ভবনের মালিক সেই ফাটলকে সামান্য প্লাস্টার খসে পড়া বলে উল্লেখ করেছিলেন। অন্য দিকে সরকারের প্রশাসনযন্ত্র ফাটল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত না পাওয়া পর্যন্ত ভবনে জনমানুষের প্রবেশ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে বুধবার নয়তলা ভবন ধসে মৃত্যুর মিছিল তৈরি হয়েছে। ভবনের মালিক এবং প্রশাসন কেউই এই গণহত্যার দায় এড়াতে পারেন না।
পুলিশ প্রশাসন থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের নিষেধ অমান্য করে ভবনে স্থাপিত পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা ভবনে ঢুকেছে। কথা শুনে হাসি পায়। এ দেশের পুলিশ ৩৮ শতাংশ ভোটের অধিকারী বিএনপি নেতাদের এক চুল পরিমাণ নড়াচড়া থামাতে পারে। আর পোশাক শ্রমিকদের ভবনে প্রবেশ ঠেকাতে পারে না। অবশ্য পোশাক শ্রমিকেরা বলেছেন, মালিকপক্ষ তাদের জোরপূর্বক ভবনে প্রবেশে বাধ্য করেছে। জানতে চাই, প্রশাসন তখন কী করেছিল? আঙ্গুল চুষছিল? একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইলেই তো সেটা মালিকদের পারার কথা নয়। প্রয়োজনে মালিকদের গ্রেফতার করা যেত। পুলিশ ও জনপ্রশাসনের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব জনগণের জানমালের হেফাজত করা। এরা সেটি কেন করতে পারেনি, সে প্রশ্নের জবাব অবশ্যই দায়িত্বশীলদের দিতে হবে। কিছু জবাব অবশ্য আমরা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী ঘটনার পরপরই কমলাপুরে ডেমু ট্রেন উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, সাভারে ধসে পড়া নয়তলা ভবন থেকে সব লোককে আগেই সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। হতাহতরা পরে নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে। প্রশ্ন হলো হাজার হাজার শ্রমিক ঠিক কী ধরনের মূল্যবান জিনিসপত্র তাদের কর্মস্থলে রেখে এসেছিলেন যে সেগুলো আনতে গিয়ে তারা লাশ হলেন?
ঘটনা পুরোপুরি না জেনে এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবার নিজেকে শুধুই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে জাতির সামনে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ব্লগার রাজীব হত্যার পরও আমরা তার বিভ্রান্তিকর ত্বরিত বক্তব্য দেখেছি। এবার তিনি শত শত মানুষের মৃত্যু ও হাজার হাজার মানুষের আহত হওয়ার জন্য সেই মানুষগুলোকেই দায়ী করলেন। নিন্দুকেরা বলছেন, ভবনের মালিক যুবলীগের নেতা হওয়ার কারণেই প্রধানমন্ত্রী এমনটা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, প্রশাসনকে বাঁচিয়ে দিতেই তার এই বক্তব্য। উল্লেখ করা যেতে পারে, ডেমু ট্রেন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘একটি বিষয় আমার নজরে এসেছে। ওই এলাকায় মৌলবাদী বিএনপি এদের হরতালের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল। আমাকে বলা হয়েছে, হরতাল সমর্থক কিছু ভাড়াটে লোক সেখানে গিয়ে এই যে ভাঙা দালান বা ফাটল ধরা দেয়াল ছিল, সেই দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করে। এটিও এ ধরনের ধসের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।’
এসবই নোংরা রাজনীতি। মন্ত্রীদের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য এই প্রথম নয়। ভবন ধসে পড়ার ঘটনা এ দেশে অতীতেও ঘটেছে। এ অবস্থায় বাচাল মন্ত্রীদের মুখে লাগাম দেয়া উচিত এবং ফাটল ভবনে মানুষকে ঢুকিয়ে কিংবা ঢুকতে দিয়ে গণহত্যা যারা ঘটিয়েছে, তাদের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। নতুবা এমন ঘটনা আগামীতেও ঘটবে।
শোক পালন কিংবা জাতীয় সংসদে শোকপ্রস্তাব অপরাধ থেকে অপরাধীদের নিবৃত্ত করবে না সে কথাটি রাষ্ট্রপতি এবং সংসদ সদস্যদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আরো মনে করিয়ে দিতে চাই, রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান সবচেয়ে জরুরি ও প্রধান বিষয়। সেখানে চরম ব্যর্থতা দেখানোর পর সমুদ্র বিজয় হলেও সেই বিজয় শেষ বিচারে বালুকণায় কিংবা জলবিন্দুতে পরিণত হতে বাধ্য।
সংসদ চলছে। সংসদে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা উচিত। এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করা উচিত এবং আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া উচিত। এ কাজে যত বিলম্ব করা হবে মানুষের জানমাল ততই অনিরাপদ থাকবে। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে অপরাধীদের চিহ্নিত করা ও তাদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করা হলে সেটা হবে দেশের সাধারণ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার শামিল। মানুষ সংসদ সদস্যদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠায় করমুক্ত গাড়ি, সরকারি প্লট, বিদেশ ভ্রমণ, ব্যাংকের অর্থ লুটপাট, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন খাওয়ার জন্য নয়। আইন প্রণয়ন এবং প্রণীত আইন বাস্তবায়নে ভূমিকা পালনের জন্য। আমরা আশা করব, এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জাম কেনা এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির দিকেও সরকার মনোযোগী হবে।
সব শেষে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তাদের পরিবারের এই শোক সইবার ক্ষমতা যেন হয় সেই প্রার্থনা করছি। প্রার্থনা করছি আহতদের দ্রুত আরোগ্য যেন ঘটে। সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এখনো সুযোগ আছে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। হিংসা বিভেদ আর বিভক্তির রাজনীতি পরিহারের।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads