শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৩

কী অর্জন করতে চায় সরকার


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

এখন সাধারণ মানুষের এক প্রশ্নÑ দেশে কী হতে যাচ্ছে? কী করতে যাচ্ছে সরকার? সরকার যা শুরু করেছে, তার শেষ কোথায়? শুধু সাধারণ মানুষই বা বলি কেন, সরকারের সমর্থকেরাও এখন দিশেহারা। তারাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, সরকারের মতলবটা কী, কী হতে যাচ্ছে সামনে। সারা দেশে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। সরকারের জুলুম নির্যাতন এখন শহরকেন্দ্রিক রাজনীতিকদের ওপরই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। তারা কৃষক-শ্রমিক, মুটে-মজুর। রাজনীতি নিয়ে তাদের যে খুব বেশি মাথাব্যথা আছে, এমনো নয়। তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলায়। সে ফসলের ভালো দাম পেলে খুশি হয়, দাম না পেলে হয়তো শস্যের জমিনের ওপরই মাথা কুটে মরে। আর অন্যান্য শ্রমিক কাজের ধান্ধায় ঘোরে। কাজ পেলে দিনের শেষে চাল-ডাল, আনাজ-তরকারি নিয়ে ঘরে ফেরে। এটিই তাদের জীবনচক্র। এরা ভোটের সময় উৎসব করে ভোট দেয়। পান-বিড়ি-চা খায়। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তারপর আবার যে যার উৎপাদন কাজে ফিরে যায়। তাদের শ্রম-ঘামের ওপর শহরের বিত্তশালীরা বিলাসী জীবনযাপন করেন।
তবে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে এসব সাধারণ মানুষের কিছু দোষ আছে। আর তা হলো, এরা প্রায় সবাই ধর্মবিশ্বাসী এবং দিনে পাঁচবার নামাজ আদায় করে। যে তাও না পারে, সে অন্তত শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে মসজিদে গিয়ে হাজির হয়। এরা মনোযোগ দিয়ে ইমাম সাহেবদের বক্তব্য শোনে। কখনো বা সেসব ওয়াজ শুনে কেঁদে বুক ভাসায়। আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। সরকার কোথায় থাকে, সেটি তারা তোয়াক্কাও করে না। গ্রামসমাজে তারা যূথবদ্ধভাবে বসবাস করে। পরস্পরের বিপদে-আপদে সবাই মিলে এগিয়ে যায়। গ্রামে ডাকাত পড়লে একযোগে লাঠিসোঁটা টেটা-বল্লম যার যা আছে, তাই নিয়ে ডাকাত প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এই উদ্যোগে কে প্রাণ হারাবে, সেটি তারা পরোয়া করে না।
কিন্তু সরকারের উৎপীড়ন-নিপীড়ন এখন গ্রামগঞ্জেও বিস্তৃত হয়েছে। তারও কারণ আছে। সরকারের পীড়নের বাহন হচ্ছে র‌্যাব-পুলিশ আর তার ঠ্যাঙারে বাহিনী ছাত্রলীগ। রাজপথে এসব ঠ্যাঙারে বাহিনী নামিয়ে সরকার বিরোধী দলকে দমন করতে চায়। পুলিশের সহযোগী বাহিনী হিসেবে কখনো কখনো আবির্ভূত হয় ছাত্রলীগ। আবার কখনো কখনো ছাত্রলীগের সহযোগী বাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হয় পুলিশ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনের জন্য যখন সরকার ধারাবাহিকভাবে এসব বাহিনী ব্যবহার করে এবং এদের যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিচার তো হয়ই না, বরং পুরস্কৃত করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তখন এদের যে যেখানে আছে, তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। কেননা অপরাধ করলে সাজার ব্যবস্থা তো নেই-ই, বরং বাহবা পাওয়ার আশা আছে। বর্তমান সরকারের আমলে এই হলো সারা দেশের আইনশৃঙ্খলার চিত্র। অর্থাৎ যে যেখানে পারো, যেখান থেকে পারো, যে শক্তিতে পারো, লুটে নাও। যেন হরিলুটের উৎসব শুরু হয়ে গেছে সারা দেশে।
শহুরে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা অনেক বেশি অসহায় যেন। এখানে কেউ একজন খুন হলে অন্যরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে যান, শেষে আবার পুলিশ তাকে হত্যাকারী সাজায় কি না, কিংবা তাকে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করে কি না। এত ঝামেলা কে করে এই ইট-কাঠের নগরীতে। তার চেয়ে সরে পড়াই নিরাপদ। কারণ আমরা দেখেছি, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে রাস্তা থেকে তুলে নিতে যারা দেখে ফেলেছিল, সেই ডাবওয়ালা, সেই দারোয়ান, সেই পুলিশ সদস্য কয়েক দিনের মধ্যেই লাপাত্তা হয়ে যায়। তাদের খোঁজ এখনো মেলেনি। খোঁজ মেলেনি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, যে বাসায় খুন হয়েছিল সে বাসার দারোয়ানেরও। এর কী কারণ, তা জনগণকে বুঝিয়ে বলারও দরকার পড়ে না। কারণ তারা সহজেই দুয়ে দুয়ে চারের হিসাব মিলিয়ে ফেলেন।
এভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম জুলুম-নির্যাতন তাই দেশের সর্বত্র এখন বিস্তৃত। শহরের পুলিশেরা যে গ্রেফতার-বাণিজ্য করে বিশাল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন, সে খবর গ্রাম-গ্রামান্তরে পৌঁছে যেতে সময় লাগে না। শহরে যারা ছাত্রলীগ করে, তারা প্রকাশ্যেই পুলিশের সামনে অস্ত্রবাজি করতে পারে, মানুষ খুন করতে পারে। তাহলে গ্রামে-মফস্বলে যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত, যারা ছাত্রলীগ করে, তারাই কেনবা বসে থাকবে। তারাও উলুধ্বনি দিয়ে ওই অপকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটাই খুব স্বাভাবিক ঘটনা। সেখানেও ছাত্রলীগ বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে। আর পুলিশও মধ্য রাতে আসামি ধরার নামে গ্রামে গ্রামে হানা দিতে শুরু করেছে। এখন এই গ্রেফতার বাণিজ্যের সুবিধার জন্য পুলিশ এক অদ্ভুত কৌশল নিয়েছে। যেকোনো ঘটনার জন্য তিন-চারজনের নাম লিখে আরো হাজার হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা করছে। তারপর মধ্য রাতে হানা। ওই যে ‘অজ্ঞাত পরিচয়’ যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের অনেককে গ্রেফতার করে আনা হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই, গ্রেফতার-বাণিজ্য। বিপত্তি বাধছে সেখান থেকেই। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ এতে ক্রমেই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এখন তারা তাদের নিজস্ব নিয়মেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেছে।
সরকার এর কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এ নিয়ে তারা নানা ধন্ধ সৃষ্টি করছে। প্রথম দিকে সরকার বলতে শুরু করল যে, যারা পুলিশকে ধাওয়া দেয় বা তাড়া করে, তারা জামায়াত-শিবিরের লোক। সে ক্ষেত্রে হাজার দশেক লোকের একটা গ্রামে সবাই কি জামায়াত-শিবির? এই কথা স্বীকার করে নিলে আওয়ামী লীগ-বিএনপির কোনো অস্তিত্বই থাকে না। গোটা বাংলাদেশ এখন জামায়াত-শিবির হয়ে গেছে। অর্থাৎ সরকার গোটা দেশের প্রতিবাদী জনতাকে জামায়াত-শিবির হিসেবে গণ্য করছে। এর মাধ্যমে যে বিভ্রম স্পষ্ট হচ্ছে তা হলো, সরকার এ দেশের মানুষের মন বুঝতে পারছে না। তারা জামায়াত-শিবিরের কথা বলে কার্যত সারা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
এখান থেকে সরকারের উত্তরণের পথ কী? কেউ জানে না। সম্ভবত সরকার উত্তরণের পথ খুঁজতেও অনাগ্রহী। আর সে কারণেই দেশের বিভিন্ন এলাকার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সাধারণ মানুষকে তারা নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। সরকার মনে করছে, আমাদের মতো যেসব বেকুবেরা ইতিহাস-ইতিহাস বলে, সময়ের কথা বলে, তারাই হলো সরকারের শত্রু। কিন্তু হঠাৎ করেই সরকার সংসদীয় কমিটিতে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে ডেকে এনে কেন যে তাদের দিয়ে বলিয়ে নিলেন, সশস্ত্র বাহিনী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ, সেটা পরিষ্কার নয়। সংসদীয় কমিটিতে আলোচ্য বিষয় ছিল, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের রেশন-ভাতা বাড়ানো। ব্যস। সরকারই সেটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু তার জন্য সংসদীয় কমিটিতে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে ডাকার কেন কারণ হলো, এটা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয় এবং তারা সংসদীয় কমিটিতে এসে একযোগে বলে গেলেন যে, তারা কোনো অসাংবিধানিক পদক্ষেপ নেবেন না।
অর্থাৎ দেশে এরকম এক ভয়াবহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নির্যাতন, নিপীড়ন, উৎপীড়ন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে দেশ রক্ষায় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে পারে, এমন ভয় কি ক্ষমতাসীনদের মনে চাড়া দিয়ে উঠেছে? সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে তারা কত যে নজিরবিহীন আইন করেছেন, সেগুলো শুমার করাও কঠিন। কিন্তু তারপরও সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের কাছ থেকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দরকার যে, সেনাবাহিনী কোনো ধরনের অসাংবিধানিক পদক্ষেপ নেবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে তার অতি আপনজন হিসেবে জিয়াউর রহমানকে ডিঙিয়ে সেনা বাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জেনারেল শফিউল্লাহকে সহায়তার জন্য ফোন করেছিলেন, তখন শফিউল্লাহ শেখ মুজিবকে বলেছিলেন যে, তিনি সহায়তা করতে পারবেন না। শেখ মুজিব যেন কোনো মতে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। শেখ মুজিব সেভাবে পালাতে চাননি বা পারেননি। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর সমাদরের অন্ত নেই। এখনো তিনি বড় বড় ফুটানির কথা বলেন। সামান্য লজ্জা-শরম বোধ থাকলেও তিনি আত্মগোপন করে নিভৃত জীবনযাপন করতেন।
এসব কথা বড় নয়। এই যে বিরোধী দল নিশ্চিহ্নকরণ, এই যে ভিন্ন মত দলন, এই যে সশস্ত্রবাহিনী নিয়ে খেলা, এর মাধ্যমে সরকার কী অর্জন করতে চায় বা দেশকে কোন পথে নিয়ে যেতে চায় সেটি এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সরকার বিরোধী দল কিংবা সমালোচক সংবাদপত্রের অস্তিত্বই রাখতে চাচ্ছে না। তাদের হিসাবে বিরোধী দল ও সংবাদপত্র শেখ হাসিনার পথের আবর্জনা। র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি ও ছাত্রলীগের দাপট দিয়ে তিনি এগুলো ফুৎকারে উড়িয়ে দেবেন। আর সেটা মাথায় রেখেই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া শীর্ষস্থানীয় সব নেতা ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতাকে আটক করে কারারুদ্ধ করেছে।
পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও এমন ব্যবস্থা নিয়েছিল জেনারেল আইয়ুব খানের সরকার। আইয়ুব খান মাটির ধুলায় মিশে গেছেন। আওয়ামী লীগ এখনো টিকে আছে, হয়তো মিশবার অপেক্ষায়। সরকার সম্ভবত বিএনপি-জামায়াতকে ধ্বংস করে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে চায়Ñ ভিশন ২০২১-এর মাধ্যমে। সে ভিশনের নজির তো আমরা চার বছর ধরে দেখলাম। ভিশনে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারি লোকেরা রেন্টাল বিদ্যুতের নামে লোপাট করছে। শেয়ার মার্কেটের ুদ্র বিনিয়োগকারীদের চল্লিশ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে সরকার বলেছে, ওরা সব ফটকাবাজ। সরকার তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। গ্রেফতার করেছে। পুলিশ দিয়ে বেধড়ক পিটুনি দিয়েছে। কিন্তু কলঙ্কের যে পুরু কালো দাগ কপালে লেগেছে, সেটা মোছা যায়নি।
সরকারের মদদপুষ্ট হলমার্ক সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা সরকারি ব্যাংক থেকে লোপাট করে নিয়েছে। এই খবরের পর বাহাত্তরে পেয়ে বসা অর্থমন্ত্রী বলে বসলেন যে, হলমার্ক এমন কী করেছে? মাত্র সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা! সরকারের হিসাবে এটা কোনো টাকাই নয়। এখন যা চলছে, তা রক্ত হিম করা কারবার। হলমার্কের তানভীর মাহমুদকে আরো আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে মুক্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমরা সাধারণেরা জোরেশোরে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দেয়া ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি? শুধু হলমার্কই নয়, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপও সরকারের সহায়তায় একই কাজ করেছে। তারাও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।
এর সব কিছুই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছে সরকার। কাজ একটাই করতে চাচ্ছে তা হলো, বিরোধী দল নিশ্চিহ্নকরণ। সরকার ইতিহাস-অনভিজ্ঞ। রাজনীতিতে স্বরলিপির ছাত্র মাত্র। পুতুল নাচের খেলায় যেমন পুতুল নিজেরা নাচে না, কারো না কারো দক্ষ হাতে পুতুল নাচের সুতো থাকে। সেই হাতেই বিরাট মঞ্চে পুতুলকে নাচায়। আর আমরা দর্শক-শ্রোতা বাইরে থেকে করতালি দিয়ে সে নাচের আসর সফল করে তুলি। শেখ হাসিনা সম্ভবত পুতুলের নাচ খেলিয়ে আমাদের দ্বারা করতালি পেতে সব অভিনিবেশ নিয়োগ করেছেন। এর পরিণতি কী হবে তিনি হয়তো জানেন, দেশবাসী জানে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads