বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের বার্তা


অবশেষে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলো। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করতে সরকার ক্ষোভের আগুনে ঘি ছিটিয়ে দিলো। এই গ্রেফতার দেশ-জাতির স্বার্থে নয়, রাষ্ট্রের প্রয়োজনেও নয়, প্রতিহিংসার রাজনীতিকে আরো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। শাসকদের কাছে এটা প্রত্যাশিত হলেও সাধারণ জনগণের কাছে এই গ্রেফতার প্রত্যাশিত ছিল না। তবে সরকার বেসামাল হলে তাকে গ্রেফতার করতে পারে, এমন ধারণা সবার মগজে ছিল। একজন সম্পাদককে গ্রেফতার করে সরকার একই সাথে কয়েকটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। সরকার বোঝাতে চাচ্ছেÑ

ক. সরকার আপসহীন, কঠোর এবং সব কিছু একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।
খ. মত প্রকাশের স্বাধীনতা সরকারের কাছে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সরকারের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে যারাই বাধা হবে, তাদেরকে এমন ভাগ্যই বরণ করতে হবে।
গ. সরকার জানান দিতে চেয়েছে, তারা শাহবাগ মঞ্চের প্রতি যতটা অনুরাগী ও দায়বদ্ধ, শাপলা চত্বরের গণপ্লাবনের প্রতি ততটাই বৈরী।
ঘ. এর মাধ্যমে ভিন্নমতের সব মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের বোঝাতে চেষ্টা করেছে সরকারের হাত অনেক লম্বা। অতএব খামোশের খড়গ যেকোনো সময় যে কারো গর্দানের ওপর পড়তে পারে।
ঙ. এর মাধ্যমে বিরোধী দলকেও বার্তা দেয়া হলো, সরকার ভীত নয়। পরোয়াহীন। প্রয়োজনে আরো কঠোর হওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত।
চ. শাহবাগ মঞ্চ, ধর্মদ্রোহী ও ধর্মবিদ্বেষীরা সরকারের কাছের লোক। তাদের চিন্তার প্রতিধ্বনি করতেও সরকার আন্তরিক। বন্ধুপ্রতিম পতিত বামপন্থীদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে সরকার আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান।
ছ. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সরকার বোঝাতে চায়, মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক ও উসকানিদাতা। সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধের পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও সন্ত্রাস বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে মাত্র।
এসব বার্তার বাইরে সরকার নিজস্ব জনশক্তি ও অনুসারীদের ভেঙে পড়া মনবল ও নৈতিক শক্তি চাঙ্গা করতে চেয়েছে। অপরপক্ষে বিরোধী দল, ভিন্নমত ও আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের মনোবল ভেঙে দিতে চেয়েছে। আমাদের মনে হয়, সরকার নিশ্চিত পতনের ফাঁদে পা দিয়েছে। একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে। ভুল যেন সরকার করছে না, অদৃশ্য কেউ ভুলগুলো তাদের দিয়ে করাচ্ছে। হঠকারীও বানিয়ে দিচ্ছে কোনো আসমানি ইশারায়। তাই বাড়াবাড়ির পথ ধরেছে। মাহমুদুর রহমান স্ত্রীর আঁচলের আশ্রয় থেকে গ্রেফতার হননি। একটি জাতীয় দৈনিকের অবরুদ্ধ অফিস থেকে কলম হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। তার সাহসকে অনেকেই দুঃসাহস মনে করলেও তার সাহসের উৎস দল ও মতান্ধ রাজনীতি নয়, ঈমান। তার প্রেরণার উৎস ভীতি, ক্ষতি ও লোভের বিপরীতে সত্যের প্রতি অবিচল আস্থা থেকে জন্ম নেয়াÑ অতএব মাহমুদুর রহমানেরা মরে না, মাথা নত করে না; কাপুরুষের মতো শতবার মরতে চায় না।
বিরোধী দল ও ভিন্নমতের অবস্থান থেকে ভাবলে সারা দেশ কারাগারে পরিণত হয়েছে, এমন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হলে কে জেলে গেল, কে গ্রেফতার হলো সেটা কোনো মুখ্য বিষয় নয়। যারা ভাবেন হররোজ আশুরা, হরজমিন কারবালাÑ তাদেরকে এজিদের প্রেতাত্মা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এরা হোসেনের উত্তরাধিকার। ফলে সেই বিখ্যাত কবিতারই প্রতিধ্বনি করতে হয়Ñ কতলে হোসেইন মরগেই এজিদ। অর্থাৎ খুন হয়েছে হোসেইন, বাস্তবে মরে গেছে এজিদ।
ভাই মাহমুদুর রহমান মাথা নত করেননি। তাকে ভয়ের চোখে দেখে সরকারই ব্যর্থতার কফিনে আরো একটি পেরেক ঠুকে দিলো। বন্দিত্ব বরণ করলেন মাহমুদুর রহমান, নৈতিক পরাজয় ঘটল সরকারের।
এর প্রতিক্রিয়া হবে বহুমুখী। ফুঁসে ওঠা জনমত আরো বিগড়ে যাবে। বিভক্ত জাতির বিভক্ত রেখা আরো দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে। ফুঁসে ওঠা জনমতের একটি অংশ অসংযমী  হতে বাধ্য হবে। অন্য অংশটি নিপীড়ক অধ্যুষিত জনপদের মজলুম হয়ে আরশের প্রভুর কাছে হাত তুলবে, যে হাতগুলোকে কারাগারে নেয়ার সাধ্য সরকারের নেই। আর পতনটা ত্বরান্বিত হবে সেই পথ ধরেই। সময়ের এই সাহসী মানুষটির শত্রু যেমন অগণন, তেমনি বন্ধু, সুহৃদ এবং শুভাকাক্সীর সংখ্যাও বেশুমার। সরকার একজন মাহমুদুর রহমানকে আমলে নেয়নি, নিয়েছে তার সাহস, লড়াকু মানস ও ঈমানি জোরকে। অথচ এখানে সরকার শুধু বলদর্পী আর মাহমুদুর রহমান জানবাজ। কোনো জানবাজকে কারাগার, জেল, জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন ঠেকাতে পারে না। এই জায়গাটিতেই মাহমুদুর রহমান বিজয়ী। সরকার পরাজিত ও পরাভূত।
এভাবেই সত্য ও অসত্যের মাঝে ফারাক সৃষ্টি হয়। জালেম ও মজলুমের স্বরূপ চিহ্নিত হয়। অবশেষে সত্য ও মজলুমই জিতে যায়। অবশ্য এ জন্য ধৈর্যের সাথে অপেক্ষার প্রহর যেমন গুনতে হয়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কঠিন পথেও হাঁটতে হয়। সেই সাথে ধৈর্য, সংযম ও দূরদর্শী হওয়ার দায়ও বাড়ে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads