রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

লংমার্চ ও এই সময়ের বাস্তবতা


আওয়ামী লীগ। দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক কারণেই এ দলটিতে প্রবীণ রাজনীতিবিদদের সংখ্যা অন্য সব দলের তুলনায় কিছুটা বেশি থাকারই কথা। বাস্তবে রয়েছেও তাই। তার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের একদল অনভিজ্ঞ তরুণ ও বামপন্থী ক’জনের সমাহারে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে তার এবারের সরকারের অভিযাত্রা শুরু করেন। কেউ বলেছেন, তরুণদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভা দিয়ে তিনি জাতিকে এক চমক দেখাতে চান। আবার কেউ বলেছেন, শেখ হাসিনার এই অনভিজ্ঞ ‘কচিকাঁচার মন্ত্রিসভা’ দিয়ে শেখ হাসিনা নৌকা কূলে ভিড়াতে পারবেন না। কার্যত দ্বিতীয় অভিমতটিই বাস্তবে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে, যদিও তার রয়েছে সাদা চুলওয়ালা বেশ ক’জন উপদেষ্টা। কিন্তু এসব উপদেষ্টাও সম্ভবত সরকারকে রাইট ট্র্যাকে রাখতে সক্ষম হননি। বরং সেই সাথে এরা যেমনি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়, তেমনি নিজেদেরকেও রাখতে পারেননি বিতর্কের ঊর্ধ্বে। মন্ত্রীদের পাশাপাশি উপদেষ্টারাও দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছেন, এমন জনধারণাই আজ প্রবল। তবে ওইসব উপদেষ্টা এক দিক থেকে সফল। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও এখন পর্যন্ত তাদের পদত্যাগ করতে হয়নি, যেমনিভাবে দু’জন মন্ত্রীকে দুর্নীতির মুকুট পরে হারাতে হয়েছে তাদের মন্ত্রিত্বের পদ। অনেককে বদলাতে হয়েছে তাদের পোর্টফোলিও। মন্ত্রিসভায় নতুন যারা এসেছেন তাদের ভাবমর্যাদা জনমনে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত।

শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টাবর্গ প্রধানমন্ত্রীকে যথাসময়ে যথা উপদেশটি দিতে পারলে আজকে সরকারকে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়তে হতো না। জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে সরকারের ব্যর্থতা আজ চরমে। রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সঙ্কটও সময়ের সাথে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উৎপাদনশীলতা ও বৈদেশিক বাণিজ্য প্রবণতা নিম্নমুখী। সবচেয়ে বড় কথা, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গোটা দেশ আজ পরিণত একটি কিলিং ফিল্ডে। নানা কারণে সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিুব্ধ হয়ে উঠছে। বিুব্ধ মানুষ তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে নেমে আসছে রাজপথে। জনবিক্ষোভ দমনে সরকার মরিয়া। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ বাহিনীকে পরিণত করা হয়েছে দলীয় ঠ্যাঙারে বাহিনীতে। পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিতে চলছে বল্গাহীন দলীয়করণ। ফলে বিক্ষোভ দমনে পুলিশ পাখির মতো গুলি করে মারছে নিরপরাধ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে। ঘটনার শিকার কোনো কোনো জনপদও পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে হাত তুলছে পুলিশের গায়ে। মোটকথা সরকার আজ পুলিশকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জনতার মুখোমুখি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বিুব্ধ জনতার ওপর পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে দেড় শতাধিক মানুষকে। বিরোধী দলের অভিযোগ, এর মাধ্যমে সরকার কার্যত এক গণহত্যার সূচনা করেছে। এর জন্য সরকারে থাকা শীর্ষনেতারা দায় এড়াতে পারেন না। এ গণহত্যার দায়ে তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। এ ধরনের অভিযোগের পরও পুলিশের গুলিতে মানুষ হত্যা থামছে না। কখনো কখনো কার্যত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেখা মাত্র গুলি করার প্ররোচনা দেয়া হচ্ছে পুলিশকে।
আজ সরকারি দলের অনেক নেতাও স্বীকার করেন, সরকার যেভাবে বিরোধী দল দমন, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় সরকার বিরোধী পক্ষকে নির্মূল করতে চাইছে, তা সঠিক নয়। তা কোনো মতেই গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির সাথে সামঞ্জস্য নয়। কিন্তু সরকার যারা কার্যত চালান, তাদের মধ্যে সে উপলব্ধি নেই। তাদের ভাবটা যেন এমন, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যান্ডেট নিয়ে এ সরকার ক্ষমতায়। অতএব সরকার যা চাইবে তাই করার অধিকার তাদের আছে। এর ফলে সরকার পরিচালনায় এদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবই প্রবল। এরা মনে করে বিরোধী দলকে বিগত নির্বাচনে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। অতএব বিরোধী দলের মত-অভিমতের কোনো মূল্য নেই। এদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও এরা ভোটে হেরে যাওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছে। এর ফলে সরকার বিরোধী দলের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে নারাজ। বরং এদের ভাবটা এমন, আমরা যেভাবে দেশ চালাতে চাই, বিরোধী দলকে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা মেনে নিতে হবে। ফলে সরকার বিরোধী দলের মতামতকে উপেক্ষা করে এমন সব রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে, তা-ই সরকারের জন্য বড় ধরনের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে এসব পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত বিরোধী দলকে বিুব্ধ করে তোলায় বিজারক হিসেবে কাজ করেছে। উদাহরণ হিসেবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা এবং একইভাবে সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা’র বিষয়টি বাদ দিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নীতিকে নিয়ে আসার বিষয়গুলো টেনে আনা যায়।
এখানে স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন আসে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গর্বের সাথে উল্লেখ করতেন। সেই তিনি তার সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাড়াহুড়ো করে, এমনকি আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার আগেই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দিলেন। ঘোষণা করলেন, আগামী নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। কেন তিনি এই স্ববিরোধিতায় নামলেন? জবাব সুস্পষ্ট। তার সরকারের কর্মকাণ্ডের সূত্র ধরে মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তার পারদমাত্রা আজ তলানিতে গিয়ে জমেছে। জনধারণা এমন যে, আগামী নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলে বর্তমান সরকারের ভরাডুবি নিশ্চিত। কিছু গোয়েন্দা রিপোর্ট ও কিছু জনমত জরিপও এমনই নির্দেশ করে। ফলে কী করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যায়, সরকার ব্যস্ত তারই বিকল্প অনুসন্ধানে। আর এর মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বিকল্প অপকৌশল হিসেবে সরকার আদালতের একটি রায়কে সামনে নিয়ে এসে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, যদিও এই রায়ের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় অস্থিতিশীলতা এড়াতে আগামী দু’টি জাতীয় নির্বাচন তৎকালে বিদ্যমান নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। অথচ সরকার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অনেকটা তাড়াহুড়ো করে সংসদে এককভাবে আইন পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চিরতরে বাতিল করে দিলো। আরো অবাক হওয়ার বিষয়, অবসরে যাওয়া বিচারপতিকে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখানো হলো সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর। আর এই রায়ে আরো দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার বিষয়টিও উধাও করে দেয়া হলো। প্রাথমিক রায়ে উল্লিখিত বিষয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে বাদ দেয়ার ঘটনা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির ঘটনা বোধ হয় বাংলাদেশে এই প্রথম এবং নজিরবিহীন।
সবচেয়ে বড় কথা, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে দেশে সহিষ্ণু রাজনীতির সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি। আমাদের দেশে এই আস্থার পরিবেশেরই বড় অভাব। এই অভাববোধ থেকেই কার্যত এ দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণাটির সূচনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান চরম অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। ১৯৯৬ সালে এ দাবিতে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও আর ব্যাপক হরতালের আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের তোড়ে বিএনপি সরকার বাধ্য হয় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজন করতে। আজ সেই আওয়ামী লীগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যখন তুলে দিলো, তখন বিরোধী দল থেকে প্রবলভাবে এর বিরোধিতা এসেছে। দেশের সুশীলসমাজ বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অবাধ করার জন্য যে রাজনৈতিক সহিষ্ণু পরিবেশ থাকা দরকার, তার বিন্দুমাত্রও দেশে বিদ্যমান নেই। এ জন্য প্রশাসনকে যেভাবে দলীয়করণমুক্ত রাখা দরকার, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সহিষ্ণু আচরণ দরকারÑ তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়া উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কোনো সরকারই যেনতেনভাবে গায়ের জোরে নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব ক’টি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। কিন্তু এর আগে আমরা দেখেছি, একটি দল ক্ষমতায় এলে দলীয় সরকারের অধীনে বারবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় টিকে থেকেছে। তখনো নির্বাচনে কারচুপি ও জোরজবরদস্তির অভিযোগ এসেছে বিরোধী দল ও অন্যান্য নিরপেক্ষ মহল থেকে। সার্বিক দিক বিবেচনায় জনধারণা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া উচিত। এ দাবি আজ বলা যায় জনদাবিতে রূপ নিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এর অবস্থানে এখনো অনড়। দলীয় সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন। বিপরীত মেরুতে বিরোধীদলীয় জোটও তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড়। বিষয়টি দেশকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত গন্তব্যে। দেশে সৃষ্টি হয়েছে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
সরকারি দল চাইছে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে হীনবল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করতে। পাশাপাশি সরকারের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে, ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোই আওয়ামী লীগের জন্য প্রধান শত্রু। অতএব ইসলামি দলগুলোকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিদায় করতে হবে। এ জন্য আওয়ামী লীগ দু’টি উপায় অবলম্বন করেছে। প্রথমটি হচ্ছে, স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে এ দলটিকে সম্ভব হলে নিষিদ্ধ করা। এটি সম্ভব করে তোলার জন্য নানা ধরনের কৌশলী কৃত্রিম ও প্রশ্নবিদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে ইতোমধ্যেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, দেশের সংবিধানে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তন করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিতে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে দেশ থেকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রয়াস চালানো। সেই লক্ষ্যে সংবিধানে এরই মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগানো হয়েছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির আলোকে সংশোধন করার জন্য। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সংবিধান থেকে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা’র রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির স্থলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মৌলনীতিকে সংবিধানে ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষ করে দেশের ওলামা-মাশায়েখেরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন প্রবলভাবে। এরই প্রতিফলন হচ্ছে গত ৬ এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ। এই লংমার্চে যে কয়েক লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটে, তা জানিয়ে দেয় সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির নামে দেশে ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চায় না। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন দেখছে, সরকার কৌশলে শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ বানিয়ে সেখান থেকে রাতদিন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের স্লোগান চার দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন এ দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছে এ বিভ্রান্ত শাহবাগী তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে। জনগণ এ-ও দেখছে, নাম দেয়া হয়েছে তরুণ প্রজন্মের, কিন্তু নেপথ্যে সবই করছে ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ঘাদানিক আর আওয়ামী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি সমর্থক কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বাম ঘরানার নানা দল-সংগঠন। এ বামেরাই ডুবিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। এবার এরা শেখ হাসিনার ঘাড়ে চেপে বসেছেÑ এমন হুঁশিয়ারি চার দিক থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সচেতন হতে পারলে মঙ্গল সবার। ক্ষতি নেই কারো।
এ দেশের মুসলমানেরা মনে করে ইসলাম এমন একটি আদর্শ, যা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ বয়ে আনার সমূহ সম্ভাবনা মানবসমাজের সামনে উপস্থাপন করে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে ইসলামি নীতি চর্চিত হতে পারে না। ব্যক্তিগতপর্যায়ে কার সাথে কার কী ধরনের আচরণ করা উচিত, রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে কী ধরনের নাগরিক অধিকার ভোগের সুযোগ পাবে, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট জনদের আচরণ কেমন হবে, কিভাবে রাখবে সব নাগরিকের মৌল অধিকার ও তাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যাবে, কেউ হবে না সামান্যতম বঞ্চিতÑ এর সব কিছুই সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত আছে ইসলামের মৌল নীতিমালায়। সে বিবেচনায় ইসলামের অনুসারী মানুষ মনে করে ইসলাম কোনো খণ্ডিত জীবনবিধান বা আদর্শ নয়, বরং পরিপূর্ণ একটি জীবনবিধান, সম্পূর্ণ এক আদর্শ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ আদর্শের বাস্তবায়ন চলতে পারে এবং চলা উচিত। এটাই একজন মুসলমানের মৌল বিশ্বাস। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা’ যখন বলেন ইসলাম দিয়ে রাজনীতি চলে না, রাষ্ট্র চলে না; তখনই একজন মুসলমান মনে করে এ ধরনের ভাবনাচিন্তা ইসলামের মৌল বিশ্বাসের ওপর আঘাত। ঈমান ও আকিদার ওপর আঘাত। তাই আসে এর প্রতিবাদ।
গণতন্ত্রের কথা হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন মহল রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এক-একটি আদর্শকে লালন করে এক-একটি রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতিতে বিশ্বাস করে। আর তারা তাদের নিজ নিজ বিশ্বাসভিত্তিক আদর্শকে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গড়ে তোলে এক-একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এসব রাজনৈতিক সংগঠন তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনা জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে। যে দলের প্রতি জনগণ ভোট দিয়ে সমর্থন জানাবে, সে দল সরকার গঠন করে দেশ চালাবে। ইসলাম একটি আদর্শ। হিন্দু ধর্মও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি আদর্শ। তেমনি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে খ্রিষ্টান ধর্মও একটি আদর্শ। প্রতিটি ধর্মের লোকের অধিকার আছে নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসের আলোকে রাজনৈতিক দল গঠন করে দেশের রাজনীতিতে অংশ নেয়ার। জনসমর্থন আদায়ের জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার। এ নীতি মেনে নিয়েই আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে অসংখ্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতেও রয়েছে ধর্মভিত্তিক নানা রাজনৈতিক দল। সেখানে যে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশই মুসলমান, সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নীতির দোহাই দিয়ে ইসলামি আদর্শভিত্তিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে কোন নীতির ভিত্তিতে? আর আমাদের দেশের সরকারই বা কী করে সে নীতিচর্চায়ই মরিয়া হয়ে ওঠে? কে দেবে এর জবাব?
এর কোনো সদুত্তর নেই। নেই বলেই আজ সরকার তার জনবিচ্ছিন্নতাকেই শুধু বাড়িয়ে তুলছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ দেশের মানুষ দেখছে, সরকার তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতা করছে যারা আজ ইসলাম, ইসলামের নবী, মুসলমানদের আকিদা, বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে নানা কটূক্তি আর ক্যারিকেচার রচনা করে চলেছে। আর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিরোধী মতের মানুষের ওপর পরিচালনা করছে দমন-পীড়নের স্টিমরোলার। পাঠ্য পুস্তকেও চলছে কুরআনের নানা বিকৃতি। সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালদের, বিরোধী দল-মত স্তব্ধ করার জন্য পুলিশ বাহিনীকে পরিণত করে সরকারি দলের ঠ্যাঙারে বাহিনীতে, পুলিশকে দিয়ে নির্বিচারে বিুব্ধ সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে সূচনা করছে গণহত্যা। উপেক্ষা করা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালসহ নানা জনদাবি।
এসব করে সরকার যেমন নিজে ডুবছে, তেমনি ডুবাচ্ছে দেশ-জাতিকে। মানুষ আজ শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। চরম নিরাপত্তাহীনতার এক পরিবেশ সারা দেশে। হত্যা, খুন, গুম যেন আমাদের নিত্যসাথী। দুর্নীতির সদর্প পদচারণা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের খবর আসছে গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত। নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে আর দেরি না করেই সরকারকে এবার থামা দরকার। নইলে বিপর্যয় সামনে।
সবশেষে ৬ এপ্রিলের লংমার্চ প্রসঙ্গ। আমাদের প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের দাবি হেফাজতে ইসলাম কিংবা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মোল্লা-মৌলবিরা ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীÑ এদের কথা শুনলে আমাদের বাংলাদেশ জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত হবে। দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে মধ্যযুগে। দেশ হবে একট সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। বিএনপি ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী বলে বলা হচ্ছে, বিএনপি রাজনৈতিক দল নয়, একটি সন্ত্রাসী দল। আর বেগম জিয়া সন্ত্রাসের নেত্রী। বেগম জিয়া দেশকে জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত করার বিষয়টি পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলেন। আওয়ামী লীগ দেশকে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছে। গত ৬ এপ্রিলের লংমার্চ শান্তিপূর্ণ ও সন্ত্রাসহীনভাবে সম্পন্ন করায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও হেফাজতে ইসলামকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এর কিছু দিন আগে ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনও লাখো মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত করেছে রাজধানী ঢাকায়। সে সমাবেশটিও ছিল অভূতপূর্বভাবে শান্তিপূর্ণ। সেখানে বিন্দুমাত্র সন্ত্রাসী ও জঙ্গিপনার কণাচিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ দু’টি মহাসমাবেশে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশ আওয়ামী লীগ বা তথাকথিত প্রগতিবাদী কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হয়েছে কি না জানি না। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করে প্রমাণ করল লংমার্চকারীরা জঙ্গি নয়, সন্ত্রাসী নয়। এরা বাংলাদেশকে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রেও পরিণত করবে না; বরং আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত প্রগতিবাদীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আমরা যে ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটতে দেখি, তাতে প্রমাণ হয় কারা সন্ত্রাসী ও কারা জঙ্গি। বলা হয়, শাহবাগীরা অহিংসবাদী। কিন্তু তাদের প্ররোচনায় আমরা কিছু দিন আগে দেখেছি তাদের অনুসারীরা কিভাবে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল অফিসসহ ব্যাংক বীমা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পুলিশের ছত্রছায়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে। গত ৬ এপ্রিলের লংমার্চ প্রতিরোধ করার নামে ২৫টি সংগঠন ও শাহবাগ মঞ্চ যে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে, সে সময় মিটিং-মিছিলে কাদের হাতে ছিল নানা ধরনের মারণাস্ত্র। অতএব তৌহিদী জনতার বিরুদ্ধে যত তাড়াতাড়ি এ ধরনের অপপ্রচার থেকে দূরে সরে এসে বাস্তবতার আলোকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখবে ধর্মনিরপেক্ষতাদীরা ততই মঙ্গল। এদের উপলব্ধি করা উচিত, বেগম জিয়া সর্বাধিক সময় এ দেশের শাসনক্ষমতায় ছিলেন। তখন দেশ আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হয়নি। জঙ্গিরাষ্ট্রও হয়নি; বরং সামনে এগিয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে, বাংলাদেশ পরিচয় নিয়েই। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads