সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৩

কবে কিভাবে আওয়ামী সরকার বিদায় নেবে-২


শফিক রেহমান

আওয়ামী লীগ সরকর ক্ষমতায় আসার পরে গত চার বছর চার মাসে যে পনেরটি বড় মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয় ঘটেছে তার মধ্যে বারোটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীÑমন্ত্রীÑপ্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টা-নেতাদের বিভিন্ন মাত্রায় সম্পৃক্তির অভিযোগ উঠেছে। এই বারোটি ঘটনার লিস্ট এর আগের লেখাটিতে দেয়া হয়েছে। বাকি তিনটি ঘটনা হলো মুন্সিগঞ্জে লঞ্চডুবিতে ১১২ জনের মৃত্যু (১৪.৩.২০১০) ঢাকায় নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ড ১২৪ জনের মৃত্যু (৩.৬.২০১০) এবং নরসিংদিতে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২০ জনের মৃত্যু (১০.১২.২০১০)।
যে এক ডজন ঘটনায় আওয়ামী মন্ত্রীÑনেতারা সম্পৃক্ত ছিলেন তার মধ্যে সর্বশেষটি হচ্ছে ২৪ এপৃল ২০১৩-তে সকাল পৌনে নটায় সাভারে নয়তলা বিশিষ্ট রানা প্লাজা ধস। এই দুর্ঘটনায় এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ৩৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় ২,৪৩৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এবং এখনো অজানা সংখ্যক ব্যক্তি, ধ্বংসস্তুূপে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় আছেন। ইনডিয়ার ভূপাল, মধ্যপ্রদেশে, ইউনিয়ন কারবাইড ফ্যাকটরিতে গ্যাস লিকেজের ফলে ২ ডিসেম্বর ১৯৮৪ দিবাগত রাতে যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, এখন পর্যন্ত সেটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনডাস্টৃয়াল অ্যাকসিডেন্ট। এ মুহূর্তে ওয়ার্ল্ড মিডিয়া মনে করছে সাভার দুর্ঘটনা তার পরেই দ্বিতীয় স্থানটি অধিকার করবে। শেখ হাসিনার উৎসাহে সরকারের বহু ট্যাকটিকস সত্ত্বেও সুন্দরবনকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন অতি সহজেই বাংলাদেশ যে একটি বিশ্ব রেকর্ডের কাছাকাছি পৌছালো তার জন্য হাসিনা সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।
সাভার ট্র্যাজেডি একদিনে ঘটেনি। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার ৪১ দিন পরেই পিলখানায় বিডিআর-আর্মি ট্র্যাজেডি থেকে শুরু করে পরপর আরও দশটি ট্র্যাজিক ঘটনায় পূঞ্জিভূত আওয়ামী অযোগ্যতা, অদক্ষতা, স্বজন ও দলপ্রীতি এবং দুর্নীতি প্রভৃতির ফলেই বারো নাম্বার ট্র্যাজেডি অর্থাৎ সাভার দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
মূল্যবোধের অভাব
তাই সাভার ট্র্যাজেডিকে এককভাবে বিবেচনা করলে চলবে না। বুঝতে হবে আওয়ামী সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে মূল্যবোধের যে বিরাট অভাব রয়েছে, ন্যায় ও নীতির যে বিপুল ঘাটতি রয়েছে এবং সততার যে বিশাল শূন্যতা রয়েছে তারই পরিনামে সাভারে এত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, এত মানুষ পঙ্গু হয়েছে এবং এত মানুষ নিখোজ হয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের নৈতিক দেউলিয়াত্ব আওয়ামী সরকার ও দলের মধ্যে প্রতিটি পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। ফ্রম শেখ হাসিনা ভায়া ম. খা. আলমগীর টু মুরাদ জংÑসোহেল রানা। ফ্রম পিলখানা টু সাভার Ñ সব ঘটনাই এই একই অন্তর্নিহিত দেউলিয়াত্বের কদর্য মর্মান্তিক বিকাশ। তাই দৃঢ়ভাবে বলা চলে সাভার ট্র্যাজেডি অপরিকল্পিত হলেও ছিল অবধারিত, অভাবনীয় হলেও ছিল অবশ্যম্ভাবী।
সোজা কথায়, আওয়ামী সরকার ও দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সৃষ্ট ও চর্চিত নীতি হত্যার কালচার সর্বনি¤œ পর্যায় পর্যন্ত অবাধে গড়িয়ে গিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে মানুষ হত্যার কালচারে। আরও সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়, এই আওয়ামী সরকার, হত্যাকারী সরকার। বিবেচনা করুন, সাভার হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী নেত্রীÑনেতাদের সংশ্লিষ্টতার পরিমান। বিবেচনা করুন, এসব খল নায়িকাÑনায়করা ২৪ এপৃল ২০১৩-তে কি করেছিলেন।
২৪ এপৃল সকালে বিএনপি নেতা-কর্মীরা
বুধবার ১১ বৈশাখে ছিল নির্মেঘ আকাশ। সকাল থেকে রোদে ঝলসে যাচ্ছিল রাজধানী ঢাকা এবং প্রায় পনের মাইল দূরে সাভার শিল্প এলাকা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আহূত দুই দিন ব্যাপী ছত্রিশ ঘণ্টা হরতালের এটা ছিল দ্বিতীয় দিন। পথে প্রাইভেট কার, কোচ ও লরির সংখ্যা কম থাকলেও ছিল রিকশা, সিএনজি, কিছুৃ সরকারি ও বেসরকারি বাস। অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। সরকারি অফিস ছিল খোলা। কিছু প্রাইভেট অফিসে ছিল সীমিত সংখ্যক স্টাফ। এই হরতাল শেষ হবার কথা ছিল বিকেল ছ’টায়। তারপর হতো নিয়ম মাফিক বিরোধী দলের প্রেস কনফারেন্স, সরকারি দলের দাবি “হরতাল অসফল” এবং আওয়ামী মিডিয়ার প্রচার “হরতাল ঢিলেঢালা।”
সেদিন সকালে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা এবং নেতা-কর্মীরা ভাবছিলেন ছত্রিশ ঘন্টার হরতাল শেষে কিভাবে তাদের আন্দোলন চলমান রাখা সম্ভব হবে? পরবর্তী সপ্তাহে আরও হরতাল? কোন যুক্তিতে? ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ কি সেসব যুক্তি বুঝবে? মেনে নেবে? এসব চিন্তা ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছিল বিএনপি নীতি নির্ধারকদের মনে।
২৪ এপৃল সকালে সোহেল রানা
সেদিন সকালে বিপরীত চিন্তাধারায় চলছিলেন সাভারের এমপি তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ ও তার স্নেহধন্য স্থানীয় যুব লীগ নেতা রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা। তারা ভাবছিলেন সেদিনের হরতাল কিভাবে ব্যর্থ করা যায়। তাদের দুজনারই আরও একটি মিশন ছিল। তারা ভাবছিলেন কিভাবে সরকারের ইংগিতে কতিপয় এনজিও আহূত শনিবার ২৭ এপৃলে মতিঝিল ও প্রেস কাবের সামনে নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের সম্মেলনে সাভারের বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে নারী শ্রমিকদের নেওয়া যাবে। হেফাজতে ইসলামি-র তের দফা দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবং হেফাজতে ইসলামি আহূত আসন্ন ৫ মে “ঢাকা অবরোধ” কর্মসূচির বিরুদ্ধে শক্তি দেখাতে সরকারের চাপে ঢাকায় নারী গার্মেন্টস কর্মীদের সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছিল, আওয়ামী সরকার গার্মেন্টস মালিকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। সরকার তাদের হুমকি দিয়েছে ২৭ এপৃল যদি নারী গার্মেন্টস কর্মীদের সম্মেলন বিশাল না হয় তাহলে হাতির ঝিলে বিজেএমইএ-র বিতর্কিত ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা হবে।
রানা প্লাজার মালিক সোহেল জানতেন আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার ২৩ এপৃলে ওই ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা গিয়েছিল। সেজন্য শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে চান নি। সোহেল রানা জানতেন ভবনের দোতলায় ব্র্যাক ব্যাংকের ব্রাঞ্চ অফিস মঙ্গলবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভবনে ফাটলের খবর পেয়ে মঙ্গলবারেই সাভার থানার ওসি আসাদুজ্জামান পুলিশের একটি দল নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। তারা ভবনের প্রতিটি ফোর পরীক্ষা করে সব ফোর খালি করে দেন। এতে সোহেল রানা ক্ষুব্ধ হন। ওসি আসাদুজ্জামান নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি সোহেল রানাকে নির্দেশ দেন উপযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ইনসপেকশনের আগে ভবনের ভেতরে যেন কেউ না ঢোকে।
এরপরে রানা প্লাজাতে আসেন ইউএনও। সোহেল রানা তাকে “ম্যানেজ” করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রানা প্লাজাতে এসে হাজির হন সোহেলের কয়েকজন বন্ধু। ওই ভবনে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক পক্ষের লোকজনকে ডেকে আনেন সোহেল রানা। তিনি মালিকপক্ষকে বলেন, “ওরা ইঞ্জিনিয়ার। ভালোভাবে ভবন পরীক্ষা করেছে। একশ বছরেও ভবনের কিছু হবে না। কোনো ভাবেই গার্মেন্টস বন্ধ রাখা যাবে না। হরতালের দিন গার্মেন্টস বন্ধ রাখলে নেগেটিভ ইমপ্যাকট পড়বে। তাই গার্মেন্টস খোলা রাখতে হবে।” এই হুমকি দেয়ার সময়ে ইউএনও উপস্থিত ছিলেন। (মানবজমিন ২৮.০৪.২০১৩)
হুমকি যেন ফলপ্রসূ হয় সেটা নিশ্চিত করতে বুধবার ২৫ এপৃল সকালেই রানা গিয়েছিলেন তার ভবনে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন হরতাল বিরোধী মিছিলের জন্য একদল মাস্তান যারা আগের দিনেও গিয়েছিল। সকাল থেকে এদের সঙ্গে প্লাজার বেইসমেন্টে রানা মিটিং করছিলেন। ওই সময়ে ভবন ধস শুরু হয়। রানা সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু নয়তলা প্লাজার অন্যান্যরা রানার মতো লাকি ছিলেন না। বিকট শব্দে রানা প্লাজা পেছনের দিকে হেলে গিয়ে ধসে পড়ে পেছনের একটি বাড়ির ওপর। প্লাজার এক তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত একাকার হয়ে যায়। সাত, আট ও নির্মীয়মান নয় তলায় ধ্বংসযজ্ঞের পরিমান কম হয়। বিধ্বস্ত রানা প্লাজায় আহতদের চিৎকারে সঙ্গে যখন মিশে যেতে থাকে কংকৃটের ধূলাবালি তখন সোহেল রানা গিয়ে আশ্রয় নেন তার রাজনৈতিক মুরুব্বির কাছে।
২৪ এপৃল সকালে নতুন রাষ্ট্রপতি
সেদিন সকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে সদ্য প্রমোটেড স্পিকার আবদুল হামিদের মন ছিল দুঃখ ও আনন্দে মেশানা। দুঃখ ছিল এই কারণে যে তার ছোট ভাই আবদুর রাজ্জাক দুদিন আগে সোমবার ২২ এপৃলে পিজি হসপিটালে পরলোকগমন করেছিলেন। তার মরদেহ মর্গে ছিল এবং স্থির হয়েছিল বুধবার ২৫ এপৃলে মিঠাইমনের কামালপুরে গ্রামের বাড়িতে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার ২৪ এপৃল সকালে আবদুল হামিদের মনে অনেক আনন্দও ছিল। কারণ শেখ হাসিনার বান্ধবী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে হতাশ করে সেদিনই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি পদে বঙ্গভবনে তিনি শপথ নেবেন। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী রাজনৈতিক দলের নেতারা বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীরা, ডিপ্লম্যাটরা, সবাই আসবেন বঙ্গভবনে। শপথ গ্রহণের পর খানাপিনা হবে। সেই প্রস্তুতি সেখানে চলছিল। আবদুল হামিদ সেই খোজখবর নিচ্ছেলেন। তিনি একটি ধোপ দুরস্ত কালো বঙ্গবন্ধু কোট এবং পায়জামা-পাঞ্জাবি রেডি রেখেছিলেন। এ সবের পাশাপাশি আবদুল হামিদের স্টাফরা যোগাযোগ রাখছিলেন বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কারণ শপথ গ্রহণের পরদিন সকালে হেলিকপটারে নতুন রাষ্ট্রপতি প্রথমেই যাবেন টুঙ্গিপাড়াতে শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থলে তার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। তারপর তিনি যাবেন কিশোরগঞ্জ কামালপুরে তার ভাইয়ের জানাযায় অংশ নিতে। বুধবার ২৪ এপৃল সকালেই আবদুল হামিদ খবর পেয়েছিলেন সাভারে রানা প্লাজায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের জ্ঞান যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ এবং তার নিজের নির্বাচনী এলাকা ও তার নিজ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেহেতু তিনি জানতেন না সাভারের চাইতে বিদেশে অনেক ছোট দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রপতিরা তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে গিয়েছেন অকুস্থলে। যেমন, অক্টোবর ২০১২-তে হারিকেন স্যান্ডি যখন নিউ ইয়র্কে আঘাত হানে তখন প্রেসিডেন্ট ওবামা তার নির্বাচনী ক্যামপেইন ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন উদ্ধার কাজে অংশ নিতে। যেমন এপৃল ২০১৩-তে বস্টন ম্যারাথন দৌড়ে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলার সংবাদে প্রেসিডেন্ট ওবামা ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। যেমন, ৫ আগস্ট ২০১০-এ কোপিআপো, উত্তর চিলিতে একটি খনি ধসে ২,৩০০ ফিট নিচে ৩৩ খনি শ্রমিক আটকে পড়লে প্রেসিডেন্ট পিনেরা বিদেশে সফর ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। ৬৯ দিন পরে আটক সবাইকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। যেমন, ৭ জুলাই ২০০৫Ñএ লন্ডনে পাতাল রেলপথের তিনটি অংশে সন্ত্রাসীদের বোমা বিষ্ফোরণে আটকে পড়েছিল শত শত অফিসযাত্রী। এই রেলপথগুলোর একটি অংশ ছিল ১০০ ফিট গভীরে। অকুস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন তদানীন্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী।
এই জাতির চরম দুর্ভাগ্য যে বর্তমানে ক্ষমতার শীর্ষে যারা আছেন তাদের জ্ঞান টুঙ্গিপাড়া ও শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ইতিহাসে সীমাবদ্ধ। তারা জানেন না লন্ডন, কোপিআপো, বস্টন, নিউ ইয়র্ক কোথায়? তারা জানেন না অন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা দুর্যোগেÑদুর্ঘটনায় কি করেন। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান উৎসাহী এই দেশের নেতাদের চরম অজ্ঞতা ও নিষ্ঠুর অবহেলার শিকার হচ্ছে এই বাংলারই মানুষ এবং সেই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ।
২৪ এপৃল সকালে প্রধানমন্ত্রী
বুধবার ২৪ এপৃল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবছিলেন কোন পোশাকে তিনি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাবেন ঢাকাÑনারায়ণগঞ্জ রুটে নতুন ধরনের ডিজেল ইলেকটৃক মালটিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ট্রেন উদ্বোধন করতে। সাধারণত তিনি চেষ্টা করেন সময় এবং অনুষ্ঠানের সঙ্গে ম্যাচিং পোশাক পরতে। ১৯৯৬ Ñএর জুনÑজুলাইয়ে নির্বাচনের আগে তাকে দেখা যেত হিজাবÑতসবিহ ও ফুল সিøভ ব্লাউজ পরতে।
নির্বাচনে জয়ী হবার সেই পোশাকে তাকে আর দেখা যায়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে তাকে সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে দেখা গিয়েছে। সেদিন বুধবার সকালে তিনি বেছে নেন শাদা জমিনে সবুজ কাজ করা জামদানি শাড়ি যার আনুমানিক দাম হতে পারে বিশ হাজার টাকা। এর বিপরীতে পাঠকরা বিবেচনা করতে পারেন রানা প্লাজায় হতাহত নারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের পরনে কি ছিল। তাদের পরনে ছিল সবচেয়ে শস্তা প্রাইড অথবা জনি পৃন্টার্সের শাড়ি। সবচেয়ে শস্তা সালওয়ার কামিজ। এই বাংলাদেশে যারা ক্ষমতা ও সমাজের শীর্ষে আছেন, তাদের সঙ্গে শ্রমজীবনের সবচেয়ে নিচে যারা আছেন, তাদের মধ্যে তফাৎ কতো লাইট ইয়ার্স? এই পার্থক্য কতো ভালগার? কতো অসহ্য অশ্লীল?
এই ট্রেন উদ্বোধনের সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “জনগণকে এই সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে।… বিরোধী দলের আন্দোলন মানেই মানুষ হত্যা। এরা পাকিস্তানিদের মতো মানুষ হত্যা করছে। ইট দিয়ে মাথা থেতলে মানুষ হত্যা করছে। কি জঘন্য তাদের মনোবৃত্তি! … হরতাল ডাকছেন। এটা আপনাদের অধিকার। কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায় Ñ তাদের কি সুবিধা হচ্ছে? উৎপাদিত পণ্য তো বাজারজাত হচ্ছে না।… এরা হরতাল ডেকে এয়ারকনডিশন্ড ঘরে মুরগির ঠ্যাং চিবান আর সিনেমা দেখেন।” (আমাদের অর্থনীতি ২৫.৪.২০১৩)
এসব মন্তব্যের সময়ে শেখ হাসিনা ভুলে যান ১৯৯৬-এ বিএনপি ক্ষমতায় থাকা কালে চট্টগ্রামে নতুন নির্মিত গোটা রেলস্টেশনই পুড়িয়ে দিয়েছিল আওয়ামী হরতালকারীরা। কেন? তারা তখন আসন্ন নির্বাচনের আগে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করছিলেন। শেখ হাসিনা এখন ভুলে গিয়েছেন কেন সেই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি আন্দোলনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করছিল। শেখ হাসিনা হয়তো ভুলে গিয়েছেন চট্টগ্রামে যখন রেলওয়ে স্টেশন পুড়ছিল তখন তিনি কি খাচ্ছিলেন? গরু, খাসি অথবা মুরগির ঠ্যাং?
প্রধানমন্ত্রী জঘন্য ভাষার সিনড্রোমে ভুগছেন? একই সঙ্গে দুর্বল স্মৃতিশক্তির সিনড্রোমেও ভুগছেন। এই ধরণের ভাষা নিয়তই যার মুখ নি:সৃত হয় তিনি কোনো সম্মানিত ব্যক্তি হতে পারেন না। তিনি মাননীয় হতে পারেন না।
কমলাপুর স্টেশনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে খবর পান সাভার দুর্ঘটনার। কিন্তু তিনি সেখানে যাননি।
দুপুরে প্রধানমন্ত্রী যান সংসদ অধিবেশনে। ইতিমধ্যে সাভার দুর্ঘটনার আরও কিছু খবর তার কাছে পৌছায়। শেখ হাসিনা বলেন, “এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। তাই সরকারের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার ২৫ এপৃলে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হচ্ছে।… উদ্ধার কাজে দুই একদিন লাগবে।… হরতালের কারণে অনেক ক্ষতি হওয়ায় ছুটি হওয়ায় ছুটি দেয়া হবে না। কিন্তু সব জায়গায় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।… হরতালের কারণে উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত ঘটছিল। কিন্তু বিরোধী দল হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক সুবিধা হচ্ছে। তাই বিরোধী দলকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”
ওদের স্থান মাটির নিচে
শেখ হাসিনা সম্ভবত এই প্রথম বিরোধী দলের প্রতি সৌজন্যসূচক কিছু বললেন। কেন? আসলে তিনি বিরোধী দলের হরতাল ডাকার প্রতি কটাক্ষ করতে চেয়েছিলেন। সত্যটা হচ্ছে এই যে, সেদিন হরতালের ফলে সকালে ট্রাফিক চলাচল কম ছিল এবং সেজন্য ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত সাভারে পৌছাতে পেরেছিলেন। হরতালের কারণে প্লাজার শপিং মলে কিছু দোকান বন্ধ থাকায় হতাহতের সংখ্যা কিছু কম হয়েছে।
তবে জাতীয় শোক দিবস ঘোষনায় দুপুরের মধ্যে সাভারে সমবেত উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। আর শোকের দিনে ছুটি না দেয়ার প্রসঙ্গে সবারই মনে পড়ে যায় আওয়ামী সরকারের আমলে প্রতি বছরের পনেরই আগস্টে শোক দিবস পালিত হয এবং ছুটিও দেয়া হয়।
বাংলাদেশে শুধু একজনের মৃত্যুর কাস উচুতে এবং সংরক্ষিত। সেই মৃত্যু নিয়ে চলে শোকের মাস এবং আওয়ামী মাতম। অন্য কোনো ঘটনায় এক দিনে এক হাজার মানুষের মৃত্যুর কাস একেবারেই আলাদা। তাই সাভারে মৃত্যুর কাস আলাদা এবং সবচেয়ে নিচে। ওরা জনগণ (শেখ হাসিনারই অতি ব্যবহৃত শব্দ)। ওদের স্থান মাটিতে এবং এখন ওদের স্থান মাটির নিচে।
সেদিন সংসদে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “রানা প্লাজা ধসে পড়ার বিশ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজ শুরু করে। বিশ্বের ইতিহাসে এত দ্রুত কেউ উদ্ধার কাজ করেছে কিনা, তা বলতে পারবে না।”
বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বিলম্বিত
সরি। বিশ্বের ইতিহাসে এর চাইতে অনেক দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে এবং জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় মানুষ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত মানুষের পঙ্গুত্বকে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বৃটেন, চিলি ও আমেরিকার যে চারটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী পড়ে দেখতে পারেন।
বস্তুত সাভার দুর্ঘটনায় অদক্ষভাবে যে উদ্ধার কাজ পরিচালিত হয়েছে সেটা বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বিলম্বিত রূপে পরিগণিত হবে। এই বিলম্বের ফলে এবং উদ্ধারকাজে আওয়ামী সরকারের হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে অসংখ্য হতভাগ্য এখন পর্যন্ত নিখোজ রয়েছেন।
বিদেশি সাহায্য নেয়নি
আওয়ামী সরকারের এই হঠকারিতা আজকের লন্ডনের দৈনিক পত্রিকা দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত হয়েছে। পড়–ন :
গত বুধবারে রানা প্লাজা ধসে ইট সিমেন্ট সুরকির একটি বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে মারা গেছে ৩৭০ জনেও বেশি। স্থানীয় উদ্ধারকারী দলগুলোর কাছে উপযুক্ত সরঞ্জাম ছিল না। তারা কোনোক্রমে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে মানুষ বের করার চেষ্টা করছিল।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিদেশিরা অভিজ্ঞ উদ্ধারকারীর দল পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। এর ফলে হয়তো অনেক মাুনষের প্রাণ বাচতো। দি ডেইলি টেলিগ্রাফ যেসব ডকুমেন্ট দেখেছে তাতে বোঝা যায়, বিদেশিদের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা আশংকা করেছিলেন বিদেশি সাহায্য নিলে জাতীয় গর্ব ক্ষুন্ন হবে। এসব ডকুমেন্ট জানিয়েছে, বিদেশিরা তাদের সাহায্য নিতে বারবার অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের। এমনকি বিদেশিরা এটাও বলেছিলেন, বিষয়টিতে বাংলাদেশ সরকারের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে তারা নিজেদের উপস্থিতি লো প্রোফাইলে (যথাসাধ্য কম দেখিয়ে) রাখবেন।
যখন জাতিসংঘের কর্মচারিরা বোঝেন যে ধ্বংস্তূপের নিচে বহু মানুষ চাপা পড়েছে তখন তারা পশ্চিমি ডিপ্লম্যাটদের নিয়ে মিটিং করেন। তারা বিবেচনা করেন এত বড় দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামর্থ আছে কিনা। তারা সবাই একমত হন যে সেই সামর্থ নেই। তখন তারা বৃটেনসহ বহু দেশের সরকারের কাছে আবেদন করেন, তারা যেন উদ্ধারকারীদের এবং হেভি লিফটিং ইকুইপমেন্ট (ভার উত্তোলনের ভারি যন্ত্র) পাঠান।
জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা বলেন, বৃটেনসহ আন্তর্জাতিক কমিউনিটি ধ্বংসস্তূপে তল্লাশী এবং উদ্ধারকাজে সাপোর্ট দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়।
পরিবর্তে উদ্ধারকাজে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভর করা হয়। যাদের কোনো প্রটেকটিভ কোদিং (নিরাপত্তামূলক বুট, পোশাক ও হেলমেট) ছিল না। তাদের পায়ে ছিল প্লাস্টিক স্যানডাল! এক শ্রমিককে বাচানোর জন্য তার হাত কেটে যখন ফেলতে হয় তখন সেটা উপস্থিত কোনো ডাক্তার করেননি। বরং হাত কাটতে ডাক্তাররা নির্দেশ দেন অন্য আরেক শ্রমিককে!
আগেভাগেই উদ্ধারকাজ শেষ করার চেষ্টা সরকার করেছে এমন সমালোচনা এসেছে সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারি কর্মচারিরা বলেছিলেন ৭২ ঘন্টার বেশি কেউ বাচবে না। এই বলে তারা হেভি যন্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু উপস্থিত আত্মীয় স্বজনদের তীব্র ক্ষোভের মুখে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। তারপর যখন আরও মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয় তখন জনতা তাদের দাবি আরও জোরালো করে। তারা বলে আরও মানুষকে জীবিত পাওয়া যাবে।
বৃটিশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)-এর জনৈক মুখপাত্র স্বীকার করেছেন, তারা যে “স্পেশালিস্ট টেকনিকাল এডভাইস” দিতে চেয়েছিলেন সেটা বাংলাদেশ সরকার নাকচ করে দিয়েছে।”
এই হলো দি ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্ট।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিসের জন্য গর্ব করেন?
নিজেদের বংশ মর্যাদা? সেটা কি খুব বেশি? দুই পুরুষ পিছনে তাকিয়ে দেখুন। উত্তরটা পাবেন।
আভিজাত্য? নিজেদের ভাষা ও চালচলন প্রকৃত অভিজাতদের সঙ্গে তুলনা করুন। উত্তরটা পাবেন।
শিক্ষা? বাজারে কেনা অনারারি ডক্টরেট এবং খালখননের ডক্টরেটের বিপরীতে বিবেচনা করুন ড. ইউনূসের ডক্টরেট। উত্তরটা পাবেন।
জ্ঞান? আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং চিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পিনেরা-র সঙ্গে তুলনা করুন। উত্তরটা পাবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে এই অজ্ঞ, অপদার্থ এবং অহমিকাপূর্ণ শাসকদের গর্ব নয়, ফুটানি-র জন্য রানা প্লাজায় কতো মানুষ মারা গেল?
হয়তো এত মানুষ মারা যেত না। যদি সেই সকালে রানা প্লাজায় একটি বিশেষ পরিবারের কোনো সদস্য চাপা পড়তেন।
১৯ জুলাই ৬৪ খৃষ্টাব্দে গোটা রোম শহরে আগুন লেগেছিল। ছয় দিন জুড়ে সেই আগুনে রোম পুড়েছিল। কথিত আছে সেই সময়ে রোমের অত্যাচারী সম্রাট নিরো মঞ্চনাটকের পোশাক পরে গান গেয়েছিলেন এং বাশি বাজিয়ে ছিলেন। অন্য একটি সূত্রের মতে নিরো এক ধরনের হার্প লায়ার বাজিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে সাভারে রানা প্লাজা যখন ধ্বংসস্তুূপে পরিণত হচ্ছিল তখন শাসক কোথায় ছিলেন তা জানানো হয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads