মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৩

শাহবাগ ও হাটহাজারী দেশ কোন দিকে



আমানুল্লাহ কবীর
‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ’ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন ঘটনা। মাসাধিককাল চলেছে নবপ্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের অবিরাম বিশাল সমাবেশ। অনেক রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী এই সমাবেশকে নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। ‘আরব বসন্তের’ অনুকরণে কেউ একে বলেছেন ‘শাহবাগ বসন্ত’, আবার কেউ বলে বসেছেন ‘নবপ্রজন্মের গণজাগরণ’। যে যেভাবেই একে আখ্যায়িত করুন না কেন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ কী অর্থ বয়ে এনেছে এবং জাতি কী বার্তা পেল, সেটিই বড় কথা। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আগে ও পরে দেশের পরিস্থিতি কী ছিল ও কী হয়েছে, তা এখন বিচার-বিবেচনা করার সময়। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নির্মাণের প্রয়োজন কেন হয়েছিল, কারা এই মঞ্চ নির্মাণ করেছিল এবং এর পেছনে কারা উদ্যোক্তা, এর লক্ষ্য কী, কোন রাজনীতি ও দর্শন কাজ করেছে, তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার। কেননা এই মঞ্চের প্রতিক্রিয়া শাহবাগ চত্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। শাহবাগ গণজাগরণের পাল্টা জাগরণ ঘটেছে। সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ অবস্থার অবসান কখন কিভাবে ঘটবে, তা কেউ জানে নাÑ সরকারও জানে না, বিরোধী দলও না। তবে আতঙ্কিত সবাইÑ দেশের জনগণও। নিরাপত্তাহীনতায় ‘ভুগছে সাধারণ মানুষ’, শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ যে নতুন পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে, তা ‘জাতীয় জীবনে চরম অনিশ্চয়তাই সৃষ্টি করেছে’। জাতি আজ দ্বিধাবিভক্তÑ প্রতীকী অর্থে, গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে ও বিপক্ষে ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে তার প্রতিবাদে শাহবাগে গণজাগরণের সূচনা। গণজাগরণের উদ্যোক্তা কতজন তরুণ ব্লগার। তাদের দাবি কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অন্য দিকে তখন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ও সব জামায়াত নেতার মুক্তির দাবিতে জামায়াতের ডাকা হরতাল চলছিল। প্রথম দিন শাহবাগের সমাবেশ ছিল দেড় শ’-দুই শ’ লোকের। পরে হাজার হাজার মানুষ, প্রধানত তরুণ-তরুণী, এই সমাবেশে যোগ দেয়। শুরুতে অস্থায়ী মঞ্চ থাকলেও পরে স্থায়ী মঞ্চ স্থাপিত হয় শাহবাগ চত্বরে, যান চলাচল ওই এলাকায় বন্ধ হয়ে যায়। ইমরান সরকার নামে একজন তরুণ চিকিৎসক ও ব্লগার মঞ্চের নেতা ও মুখপাত্র রূপে আবির্ভূত হয়। মঞ্চের নেতানেত্রীরা নিজেদের নবপ্রজন্মের প্রতিনিধি দাবি করে নিজেদের দলনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করে। তাদের দাবি একটাইÑ সব যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। তাদের সমাবেশ চলে দিন-রাত, উৎসবমুখর পরিবেশে চলে স্লোগান, নাচ-গান, নাটক প্রভৃতি। গণজাগরণের সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্য শাহবাগে ছুটে যান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিক বাম দলগুলোর নেতানেত্রীরা। আবেগ ও উচ্ছ্বাস দমন করতে না পেরে অনেক মন্ত্রী-এমপিও যান। ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক বাম দলগুলো ছাড়াও অন্যান্য বাম দলের নেতারাও শাহবাগে যান গণজাগরণের প্রতি তাদের সমর্থন জানানোর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী ও নেতারাও ভিড় জমান শাহবাগে। বক্তৃতা দিয়ে তারা উৎসাহিত করেন গণজাগরণের তরুণ-তরুণীদের। অনেক টেলিভিশন চ্যানেল সারাক্ষণ ‘লাইভ’ প্রচার করতে থাকে তাদের বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার ও মঞ্চের সব কর্মকাণ্ড। তিন-চারটি বাদে সব জাতীয় দৈনিকেও শীর্ষ খবর চলতে থাকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ঘটনা। সাংবাদিকতার সব রীতিনীতি ভঙ্গ করে মিডিয়ায় প্রায় এক মাসই চলে এ প্রচার-প্রচারণা। এসব দেখেশুনে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছেÑ দেশে কী হতে যাচ্ছে? এমনও কারো মনে হতে পারে যে, দেশে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। শাহবাগের দিকে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের ছোটাছুটি দেখে মনে হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রের পরিবর্তন হয়েছেÑ তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রী অফিস থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে শাহবাগ মঞ্চে। ইমরান সরকার দাম্ভিকতার সাথে বলেছেও, ক্ষমতার উৎস এখন শাহবাগ। ইমরান সরকার একেবারে মিথ্যা বলেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে গণজাগরণ মঞ্চকে অভিনন্দন জানিয়ে আফসোস করেছেন যে তিনি সশরীরে শাহবাগে যেতে পারলেন না। এ আফসোস প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও মৃত্যুর আগে করে গেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শাহবাগের দাবি বাস্তবায়ন করেছেন। তার উদ্যোগে সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে বিল পাস হয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লঘুদণ্ডের বদলে গুরুদণ্ড দাবি করে আবেদন করতে পারবে। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করা যাবে, যা মূল আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে ছিল না। এরপর শাহবাগ মঞ্চ থেকে উঠেছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অতি উৎসাহে সে আইন করারও প্রতিশ্রুতি দেন। সংশোধিত আইন বিচারিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। কারণ বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালে আসামিকে গুরুদণ্ড দেয়ার জন্য যদি কোনো আইন করা হয়, তবে তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে আপিল বিভাগ যদি কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেন, তবে তাকে আইনের ভাষায় Judicial Killing  বলা হবে কি না, আইনজ্ঞরাই তা ভালো বলতে পারবেন। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য যে দাবি উঠেছে, তার পেছনে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিবর্তে অন্ধ আবেগ কাজ করেছে। এর ফলে জামায়াত-শিবিরকে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ঠেলে দিয়েছে, যা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা হলে দলের নেতাকর্মীরা নির্মূল হয়ে যাবে বা দেশান্তরিত হয়ে যাবে, এমন চিন্তা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। স্বাভাবিক কারণেই তারা আইনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাঢাকা দেবে এবং আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে অপারেশন চালাবে, যা হবে আরো ভয়াবহ, দেশে শুরু হবে চরম অস্থিরতা। বিদায় মুহূর্তে আওয়ামী লীগ এমন একটা পদক্ষেপ নিয়ে জাতিকে মারাত্মক অনিশ্চয়তা ও সঙ্ঘাতের মধ্যে ফেলে যাবে।
শাহবাগ মঞ্চের নেতারা নিজেদের দলনিরপেক্ষ ও তাদের আন্দোলনকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করেছে। তারা এই দাবি করে অরাজনৈতিক আবরণে মুখ ঢাকার চেষ্টা করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা দলনিরপেক্ষ নয় এবং তাদের আন্দোলনও অরাজনৈতিক নয়। শাহবাগ মঞ্চের যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বাম রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। আর পেছন থেকে তাদের শক্তি জুগিয়েছে আওয়ামী লীগ ও এই বাম দলগুলোই। ইমরান সরকার স্বয়ং আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপের সদস্য। মঞ্চে আর যেসব তরুণ-তরুণীকে দেখা গেছে তারা সবাই বাম দলগুলোর ছাত্রসংগঠনের নেতা-নেত্রী। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক বাম দলগুলোর বাইরেও অন্যান্য বাম দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-নেত্রীরাও মঞ্চে নেতৃত্ব দিয়েছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটও বাম রাজনীতির ধারক-বাহক। সব বাম দলই নৌকার আরোহী না হলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে তাদের অনেক মৌলিক বিষয়েই মিল রয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো তারাও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। তারা মনে করে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্ব তাদের এই বিশ্বাস ও চিন্তাচেতনা দিয়েই উদ্বুদ্ধ। তাদের এই বিশ্বাস ও চিন্তাচেতনা তরুণ প্রজন্মের একাংশের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে, যা ইন্টারনেট ব্লগারদের লেখালেখিতে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা মনে করে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপরিপন্থী, তারা ইতিহাসের বিকৃতিকারী। ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হলেও মুসলমানপ্রধান বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে। বাংলাভাষা আন্দোলনও হয়েছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে। যারা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা এই প্রজন্মেরই ‘পূর্বসূরি’Ñ তাদের দাদা-নানা, বাবা-চাচা এবং তারা মুসলমান। ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে পাকিস্তান এ দেশের মানুষের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালেও তারা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করে। সুতরাং যারা ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বলে তারা মিথ্যাচার করে এবং নবপ্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তিকর বার্তা পাঠায়। তাদের এই বার্তা ইসলামবিদ্বেষ ও নাস্তিকতার অন্যতম প্রধান উৎস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা দেশপ্রেম নিঃসন্দেহে ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু মিথ্যাচার ও বিকৃত বার্তা সরলজ্ঞান নবপ্রজন্মকে ইসলামপ্রিয় মানুষের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছেÑ একটি হোমোজিনাস সোসাইটিকে (Homogenous Society) দ্বিধাভক্ত করেছে। ফলে শাহবাগের গণজাগরণের ওপর ভর করে বামশিবির রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যে শক্তির বলয় সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেছিল, তার সমাধি শাহবাগ মঞ্চেই রচিত হবে।
শাহবাগের গণজাগরণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক সহযোগিতা রয়েছে। সরকার শাহবাগ মঞ্চের জন্য নিশ্চিত নিরাপত্তাব্যবস্থা করেছে, সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করেছে। পানি সরবরাহ ও টয়লেট সুবিধার ব্যবস্থা করেছে ইত্যাদি। মিডিয়াসহ সরকারসমর্থক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানী ও রাজধানীর উপকণ্ঠের স্কুল-কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষকে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্দেশ দিয়ে প্রতিদিন বাসে ছাত্রছাত্রীদের শাহবাগ চত্বরে পাঠানোর কাজও করেছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তো সর্বক্ষণ শাহবাগ চত্বরে আছেই। এই গণজাগরণের পেছনে কত কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, তার হিসাব এখন জানা না গেলেও ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আওয়ামী লীগ বেহিসেবি কাজ করেনিÑ শাহবাগের গণজাগরণ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্যই করা হয়েছে এত বড় আয়োজন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দু’টিÑ এক. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ও জামায়াতের বিচারাধীন শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবিতে জামায়াত-শিবির যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে প্রতিপক্ষ শক্তি দাঁড় করানো; দুই. শাহবাগের হাওয়া পালে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। কিন্তু পাল্টা হাটহাজারীর গণজাগরণ মাঝপথে পাল ফুটো করে দিয়েছে, উল্টো স্রোতের মুখে নৌকা এখন ডুবু ডুবু করছে। সরকার ও সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা হেফাজতে ইসলামকে ‘হেফাজতে জামায়াত’ অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বলে প্রচার করলেও হালে পানি পায়নি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে আজ আলেমসমাজ যে ুব্ধ হয়ে উঠেছে, তার দায় সরকার এড়াতে পারে না। দীর্ঘ দিন ধরেই কিছু ব্লগার স্বনামে-বেনামে ইসলাম ও নবী সা:-এর বিরুদ্ধে কটূক্তি করে লেখালেখি করছে। এ ব্যাপারে গত বছর মার্চ মাসে হাইকোর্টে একটি রিট হয়। আদালত এ বিষয়ে তদন্ত, কটূক্তিকারী ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং এই ব্লগগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। কিন্তু এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় সরকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে এবং কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে এসব ব্লগার আশকারা পেয়ে ইসলাম ও নবী সা:-এর বিরুদ্ধে অবমাননাকর লেখালেখি অব্যাহত রাখে। পরে শাহবাগের গণজাগরণের সাথে এদের কারো কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। নিহত ব্লগার রাজীব হায়দার এদেরই একজন। পুলিশ বলেছে, ইসলাম ও নবী সা:-এর বিরুদ্ধে অবমাননাকর লেখালেখি করছে, এমন আরো এক শ’ ব্লগারের সন্ধান তারা পেয়েছে। ইতোমধ্যে এদের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার পর সরকার এই প্রথম এদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিলো। পুলিশের দেয়া তথ্যানুসারে গ্রেফতারকৃত এই চারজনও শাহবাগের গণজাগরণের সাথে সংশ্লিষ্ট। হেফাজতে ইসলাম ইসলাম ও নবী সা:-কে অবমাননাকারী এই ব্লগারদের নাস্তিক বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও শাহবাগের গণজাগরণকে নাস্তিক ও নষ্টদের জাগরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে শাহবাগ মঞ্চ নাস্তিক্যবাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম ৬ এপ্রিল ঢাকামুখী লংমার্চের যে কর্মসূচি ঘোষণা করে, তা প্রতিহত করার জন্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ছাত্রলীগসহ ২৩টি সংগঠন ৫ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে সারা দেশে ২৪ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করে। এসব সংগঠন শাহবাগের গণজাগরণের সাথে গোড়া থেকেই সক্রিয়ভাবে জড়িত। হরতাল আহ্বানকারী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, মৌলবাদীদের প্রতিহত করার জন্যই এই হরতাল ডাকা হয়েছে। তাদের এই ঘোষণা বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব নেয় সরকার। হেফাজতে ইসলামকে লংমার্চের অনুমতি দিলেও তা ব্যর্থ ও প্রতিহত করার জন্য সরকারই দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়। এমনকি ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে নজিরবিহীন উদাহরণ স্থাপন করে। এর ফলে আলেমসমাজের কাছে সরকার নিজেও ইসলামবিরোধীদের সাথে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং লংমার্চ প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সরকার রাষ্ট্রকেও এ বিরোধে জড়িত করে ফেলেছে।
৬ এপ্রিল ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেক টার্নিং পয়েন্ট (Turning Point)। লংমার্চকে প্রতিহত ও ব্যর্থ করতে সরকার, আওয়ামী লীগ, গণজাগরণ মঞ্চ, বাম দল ও তাদের সমর্থক সংগঠনগুলো যে কূটকৌশল ও বাধাবিঘœ সৃষ্টি করেছিল, তা ছিল কেবল নিষ্ফল উল্লম্ফন। রাজধানীর শাপলা চত্বরে লাখ লাখ ওলামা-মাশায়েখ ও ধর্মপ্রাণ মানুষের যে মহাসমুদ্র সৃষ্টি হয়, তা স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বাধার মুখেও হাজার হাজার মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে শাপলা চত্বরের সমাবেশে যোগ দেন। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রশিক্ষিত ক্যাডার নয়, কিন্তু সুশৃঙ্খল। তারা যেন ছিল নগরবাসীর সম্মানিত অতিথি। তৃষ্ণার্তের জন্য পানি ও ুধার্তের জন্য খাবার নিয়েই বুঝি তারা অপেক্ষা করছিলেন। তাদের খেদমতে নেমে এসেছিল খালেদা জিয়ার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মিত্র এরশাদের জাতীয় পার্টি। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত চলে এ জনসমুদ্রের গর্জন। এ দিকে শাহবাগ চত্বরেও চলছিল পাল্টা সমাবেশ। কিন্তু শক্তি পরীক্ষায় শাপলা চত্বরের তুলনায় তা ছিল ম্রিয়মাণÑ যেন পরাজিত শক্তির শেষ আস্ফালন। শাহবাগের গণজাগরণের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সরকার ছিল রণকান্ত ও পলায়নপর। যে ‘মৌলবাদীদের’ প্রতিহত করার জন্য এত রণসজ্জা, তা বুমেরাং হয়ে আঘাত হেনেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্গেই। তার ‘মৌলবাদীদের’ প্রতিহত করার কৌশল ‘মৌলবাদীদের উত্থানের’ সোপানই নির্মাণ করে দিলো।
ক্ষমতা থেকে বিদায় মুহূর্তে শেখ হাসিনা জাতিকে বিভক্ত করে দিয়ে গেলেন, ঠেলে দিলেন আস্তিক-নাস্তিকের লড়াইয়ে যা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়লে দেশ গৃহযুদ্ধের হুমকির মুখেই পড়বে। তার সরকারের পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি ও ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত ও তাদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে তা কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। তাহলে জাতিকে বলতে পারতেন তিনি দেশকে রাজাকারমুক্ত জাতিকে দায়মুক্ত করেছেন। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তিনি হয়তো সে কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারবেন না। পিতা শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড তিনি কার্যকর করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারলেও তার এই কৃতিত্বের সাথে আরো একটি কৃতিত্ব যোগ হতো, যা নিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে জয়ের কৌশল রচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতার মতো পুত্রীও ভুল করলেন। শেখ মুজিব বামদের (তৎকালীন মস্কোপন্থী) খপ্পরে পড়ে গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাকশাল গঠন করেছিলেন; শেখ হাসিনাও এবার বামদের খপ্পরে পড়ে ইসলামবিদ্বেষী গণজাগরণ মঞ্চকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে জাতিকে অনিশ্চিত অন্ধকারে ঠেলে দিলেন। ধর্মীয় সহিংসতার যে বীজ তিনি বপন করলেন, তা একদিন মহীরূহ হবেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads