বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৩

প্রতিহত, উৎখাত ও নির্মূলের রাজনীতি পরিহার করতে হবে



মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। স্বাধীনতার পর ৪২ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। শিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মানুষের জীবনযাত্রার মানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও গৃহায়নের ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি উল্লেখ করার মত। আমাদের জনশক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে তাদের পরিশ্রমলব্ধ যে অর্থ বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট্ট দেশ হলেও নানা কারণে দেশটির গুরুত্ব অপরিসীম। তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিগত দিনগুলোতে মানুষের অব্যাহত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উজ্জ্বল দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সমস্ত সম্ভাবনাকে ধুলিসাৎ করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিকে যেমন বাধাগ্রস্ত করছে তেমনি সামাজিক মূল্যবোধকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। আবহমানকাল থেকে আমাদের সামাজিক জীবনে যে সৌহার্দ সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা বিরাজ করছিল তা যেন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, বিগত ৪২ বছরে বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। আমাদের রাজনীতিতে বিরোধী মতকে সম্মান ও মর্যাদার সাথে গ্রহণ করার প্রবণতা নেই বললেই চলে। প্রতিপক্ষকে নির্মূল, উৎখাত, উৎপাটন, নিশ্চিহ্ন করাই যেন রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। আদর্শ ও নীতির মোকাবিলা আদর্শ দিয়ে না করে পেশী শক্তির বলে আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। সত্যকে সত্য বলার, মিথ্যা কে মিথ্যা বলার সাহস রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হারাতে বসেছেন। নিজেদের দলীয় আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিপক্ষের উপর ভিত্তিহীন, অবান্তর, অনৈতিক ও অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত দোষ চাপানো দূরারোগ্য ব্যাধি রাজনীতিকে কলুষিত করছে। সর্বক্ষেত্রে আজ বিপর্যয়ের মহাউৎসব চলছে।
অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক কর্মকা-ের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ এক কঠিন রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত। পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও মর্যাদাবোধ রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় নিতে চলেছে। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কার্যক্রমে গণতন্ত্রের বালাই নেই। প্রতিহিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও ঈর্ষাপরায়ণতা রাজনীতিকে নিদারুণভাবে কলুষিত করছে। ফলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য  শাসক গোষ্ঠী ও বিরোধী দলের আন্তরিক প্রচেষ্টার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যারা যা করছেন তা গণতন্ত্রের স্বার্থেই করছেন বলে ডুগডুগি বাজাচ্ছেন। গণতন্ত্র রক্ষার নামে শাসকগোষ্ঠী- প্রতিহত, দেখামাত্র গুলীর নির্দেশ ও নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিয়ে দেশে এক ভয়াবহ অরাজকতা সৃষ্টি করেছে। পাখির মত গুলী করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো মানুষের জান, মাল, ইজ্জত, আব্রুর নিরাপত্তা দেয়া। আর সেই নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনরত নিরস্ত্র জনতার উপর গুলী করে নির্দয়, নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।
যে মহান ত্যাগ, রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান লাভ করেছে তার পেছনে ছিল দেশপ্রেম। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ দেশের ভালোবাসা বুকে ধারণ করে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের রক্তের উপর দাঁড়ানো বাংলাদেশের পবিত্র জমিনে যারা রাজনীতি করছেন তাদের বিশেষ করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কর্মকা-ে দেশের ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন। আজ প্রশ্ন উঠেছে কোন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তি এ ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে কিনা! সংকট নিরসনের পরিবর্তে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়া কোন দেশপ্রেম হতে পারে না।
রাজনীতিতে থাকতে হয় দেশপ্রেম। দেশপ্রেম ছাড়া রাজনীতি হয় না। দেশের মানুষকে নিয়েই রাজনীতি। মানুষের কল্যাণ, শান্তি, সুখ, নিরাপত্তা ও ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করাসহ জাতীয় জীবনে স্থিতিশীলতা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দলসমূহ ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে মানুষের কল্যাণে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও ন্যায্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানে তাদের ভূমিকা সকলের নিকট শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রেরণা জোগায়।
দেশকে গড়ে তোলা, বিপদে আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সংকট নিরসনে সময়োচিত, যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ করে যথাযথ প্রতিকার গ্রহণ রাজনীতিবিদদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ্য করেছি অতীত রাজনীতিবিদদের মধ্যে। তারা জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে আছেন। জাতি তাদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্মরণ করে। তারা নিজের জীবনের চাইতে দেশকে ভালোবেসেছেন, দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন। মানুষের কল্যাণে নিজেদের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়েছেন। তাই তারা স্মরণীয়, বরণীয়।
আজ যারা রাজনীতি করছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে কল্যাণকর দৃষ্টিভংগীতো দূরের কথা, প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলে জব্দ করাই তাদের একটি বিশেষ কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ নিরসনে যৌক্তিক সমাধান বের করার পরিবর্তে অপরের চরিত্র হননের কাজেই নেতৃবৃন্দ আজ বেশী ব্যস্ত। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত তারা মতবিরোধ নিরসনে বা সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করার পরিবর্তে কালক্ষেপণ করে অহেতুক সংকট দীর্ঘস্থায়ী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। শাসক গোষ্ঠীর ভূমিকার কারণে ছোট খাটো সমস্যাও বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে। আজ এমনি এক সংকটের কঠিন আবর্তে নিমজ্জিত বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকা-ে দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট সৃষ্টির পিছনে দায়ী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। কাজেই সমাধানও তাদেরকেই করতে হবে। সংকট উত্তরণের একমাত্র উপায় হিসেবে আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার কথা বলছেন দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়। কিন্তু সরকারের আচরণ, আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের সম্ভাবনাকে ক্রমেই কঠিন করে তুলছে। রাজনীতিবিদদেরকে গণহারে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। জাতীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে এমন সব মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে, ব্রিটিশ শাসনামলেও যার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক সমঝোতার আবশ্যকতা যখন বড় হয়ে উঠছে ঠিক তখন নেতৃবৃন্দকে কারাগারে আটক করে সরকার পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তুলছে। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের সাথে আলোচনা বা সমঝোতার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার সম্ভবত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন করে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের সাজানো মামলায় বিরোধী দলের নেতাদের শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। এ ভয়াবহ রাজনৈতিক কৌশল বাংলাদেশকে দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মধ্যে ফেলবে।
জনগণ ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অর্থ এটা নয় যে, আওয়ামী লীগ যা ইচ্ছা তা-ই করবে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলবে। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সংবিধান অনুযায়ী। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদেরকে সংবিধানের আনুগত্য করার শপথ পাঠ করতে হয়। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী আজ তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন না। আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানকে পদদলিত করেছে। জনগণের মতামতের প্রতি তোয়াক্কা না করে তারা যা ইচ্ছা তা-ই করছেন। আর এসব করা হচ্ছে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে নয়। ফলে সংকট ক্রমাগতভাবে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
॥ দুই ॥
অবাধ ও উদার গণতন্ত্রের পূর্বশর্তই হলো এক বা একাধিক বিরোধী দল ও মতের অস্তিত্ব। সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলসমূহের বিরুদ্ধে সরকার এমনসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যেগুলো গণতান্ত্রিক মুল্যবোধকে নস্যাৎ করার শামিল। ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক কারণে যারা কারারুদ্ধ হতেন তাদের একটি বিশেষ রাজনৈতিক মর্যাদা ছিল। তাদের বলা হতো রাজবন্দী। বাংলাদেশ আমলে প্রায় ৩৫/৩৬ বছর ধরে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা এ বিশেষ মর্যাদা ভোগ করেছেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেই মূল্যবোধও যেন অপসৃত হতে চলেছে। একথা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বিএনপি জামায়াতসহ বিরোধী দলের অনেক শীর্ষ নেতাকে ডান্ডাবেড়ী পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধের অভিযোগে যেসব কয়েদিকে ডান্ডাবেড়ী পরানো হয় তাদের সাথে রাজবন্দীদের আর কোন ফারাক রাখা হচ্ছে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই মারাত্মক অবনতি দেশের সামগ্রিক রাজনীতিকে দ্রুত রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে। আজ রাজনৈতিক কারণে যারা কারারুদ্ধ হচ্ছেন তারা সরকারের চোখে আর রাজবন্দী বলে পরিগণিত হচ্ছেন না। তারা গণ্য হচ্ছেন গাড়ি ভাংচুর করা বা অগ্নিসংযোগকারী ক্রিমিনাল হিসেবে।
অতীতে দেখা গেছে রাজনৈতিক দলসমূহের অফিসে পুলিশ সাধারণত হানা দিত না। হানা দিলেও পূর্ব অনুমতিসহ প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করেই ঐসব অফিসে তল্লাশি চালানো হতো। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে জামায়াত ও বিএনপি অফিসে তল্লাশির নামে পুলিশ যা করেছে তা ৬ দশকের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ তল্লাসী চালায়। এ সময় পুলিশ কেন্দ্রীয় অফিসে ব্যবহৃত সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। অফিসে ব্যবহৃত কম্পিউটার ও আসবাবপত্র তছনছ করে। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ.টি.এম আজহারুল ইসলামসহ প্রায় ১০০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর জনাব এ.টি.এম আজহারুল ইসলাম ও জনাব তাসনীম আলমকে ডান্ডাবেড়ী পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। একই কায়দায় ১১ মার্চ ২০১৩ প্রধান বিরোধীদল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুরূপ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। পুলিশ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কক্ষের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে। অফিসে তল্লাশি, কম্পিউটারসহ মূল্যবান জিনিষপত্র ভাংচুরের দৃশ্য কয়েকটি চ্যনেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। দেশবাসী প্রধান বিরোধী দলের অফিস ভাংচুরের এ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায়। এটিকে ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে!
খালেদা জিয়া ব্যতীত বিএনপির তেমন কোন শীর্ষ নেতা নেই যারা কারা প্রকোষ্ঠের অন্তরালে আটক নন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যকে একাধিকবার গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত ৭ এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় নেতৃবৃন্দকে নি¤œ আদালত জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায়। আদালতের এ আদেশের পর দেশের আইন বিশেষজ্ঞগণ মন্তব্য করেছেন, যেকোন বিবেচনায় আদালত এসব নেতৃবৃন্দের জামিন দিতে পারতেন। আইনজীবীদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অভিযোগ করে বলেছেন নি¤œ আদালতের বিচারকরা সরকারের আজ্ঞাবহ। জামায়াতে ইসলামীর ৯ জন শীর্ষ নেতা মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক আছেন। জামায়াতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতারাও এখন কারাগারের অন্তরালে। জামায়াতে ইসলামীর প্রায় ৪০ হাজার নেতা-কর্মীকে এ সরকারের আমলে গ্রেফতার করা হয়। মহিলারাও গ্রেফতারের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বাংলাদেশের কারাগারসমূহে এখন ধারণ ক্ষমতার তিনগুণেরও বেশি বন্দী রয়েছে।
সরকার দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক এবং সামাজিক কোন শক্তির সাথেই যেন সুসম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। সরকার নিত্য নতুন বৈরী ফ্রন্ট খুলছে। এতদিন পর্যন্ত মানুষ শুধুমাত্র বিএনপি ও জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের বৈরিতা দেখে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বিশাল শক্তি হিসেবে উত্থিত হেফাজতে ইসলামের সাথেও সরকারের সম্পর্ক বৈরিতার পথেই এগোচ্ছে। হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। দেশের আলেম, ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ধর্মপ্রাণ মানুষের সমন্বয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠা। এ দলটি বার বার বলে আসছে, কোন দল বা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন নয়। তাদের আন্দোলন হচ্ছে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। মহান আল্লাহ, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সাঃ), মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ও ইসলামকে যারা কটাক্ষ করে তাদের বিরুদ্ধেই হেফাজতের আন্দোলন। এই অরাজনৈতিক ধর্মীয় শক্তিকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে যে ভূমিকা রাখছে তা তাদের জন্য বুমেরাং হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হেফাজতে ইসলামকে কটাক্ষ করে যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন তা মোটেই সুখকর নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা তিনি। তিনি আওয়ামী লীগের মত এত বিশাল এবং তৃণমূল ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিগত ৩২ বছর ধরে। তিনি দু’টি মেয়াদে সাড়ে ৯ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন এবং দু’টি মেয়াদে অর্থাৎ আরো দশ বছর ধরে বিরোধী দলের নেতৃত্ব করেছেন। তিনি ছাড়াও আওয়ামী লীগে রয়েছেন অনেক প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা। আওয়ামী লীগ ৬৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল। দলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কথা বলে গেছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে সবসময়ই আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক রীতি, নীতির কথা বলে আসছে। প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করার যে প্রবণতা সরকারকে সম্প্রতি পেয়ে বসেছে খাঁটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে এখন তাদেরকে সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সরকার ভারতীয় সংস্কৃতির তল্পিবাহক কিছু মিডিয়া, ব্যক্তিত্ব এবং কিছু ব্যবসায়িক সুবিধাভোগী মানুষের খপ্পরে পড়েছে। সরকারের উপর আরো ভর করেছে কতিপয় বামপন্থী নেতা যারা মন্ত্রীত্বের গদিতেও সমাসীন। এদের অশুভ প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সরকার ও আওয়ামী লীগ উভয়কেই করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে।
উদার, মুক্ত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতবাদ আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে এর নেতৃবৃন্দ দাবি করেন। তারা আরো বলেন, আওয়ামী লীগের জন্ম এবং বিকাশ গণমানুষের দল হিসেবে। আগামী দিনে যদি সুনাম এবং মর্যাদার সাথে আওয়ামী লীগকে টিকে থাকতে হয় তাহলে গণতান্ত্রিক আচরণ এবং সংস্কৃতির প্রতি দলটিকে আরো নিষ্ঠাবান হতে হবে। উৎখাত, নির্মূল ও প্রতিহত করার রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে বেরিয়ে আসতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads