বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৩

শাহবাগের ঘৃণার আগুনে পুড়ছে সরকার



শাহবাগে ব্লগার এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্টের ব্যানারে একদল তরুণ যখন দিন-রাত স্লোগান দিয়ে চলেছে তখন তাদেরকে পই পই করে বলা হয়েছিল তোমাদের এই আন্দোলন ভ্রান্ত, কারণ তোমরা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার নয় ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করছোÑ যা সভ্য দুনিয়ায় নজিরবিহীন। তাদেরকে বার বার বলা হয়েছিল, ফাঁসিই যদি একমাত্র গ্রহণযোগ্য রায় হয়ে থাকে, তাহলে ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত কর্মকর্তা, প্রসিকিউশন ইত্যাদির কী দরকার, অভিযুক্তদের শাহবাগে নিয়ে এসে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দিলেই তো হয়। কিন্তু শাহবাগ তখন মোহাবিষ্ট। সজ্জনদের সদুপদেশ শোনার সময় তাদের হাতে নেই। তারা তখন কোন দিকে কর্ণপাত না করে বিচার এবং ফাঁসি সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দুটি দাবি নিয়ে দিবা-নিশি স্লোগান দিয়ে চলেছে। কয়েকটি টিভি চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা ও কিছু চিহ্নিত সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী এবং স্বয়ং সরকার শাহবাগে জ্বালানো ঘৃণার আগুনে ড্রামে ড্রামে ঘি ঢেলে এই তরুণদেরকে আরও মোহগ্রস্ত করেছেন, তাদের চোখে সেঁটে দিয়েছেন রঙিন চশমা। পরিণামে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত এই তরুণরা তাদের দাবির তালিকায় একে একে যুক্ত করেছে আরও অদ্ভূত সব আবদার। তারা ঘোষণা করতে থাকলো রাজাকারদের ফাঁসি দিলেই চলবে না, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আর একটু এগিয়ে তারা ঘোষণা দিল শুধু জামায়াত-শিবির নয়, ধর্মভিত্তিক সব দল নিষিদ্ধ করতে হবে, এই দলগুলোর সাথে যুক্ত ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, ব্লগ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং বন্ধ করে দিতে হবে। সারা দেশের মানুষের কপালে উঠে যাওয়া চোখকে অগ্রাহ্য করে এরা শাহবাগ থেকে ঘোষণা দিল সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দিতে হবে। মাহমুদুর রহমান যেহেতু তাদের এই দাবিগুলোকে ফ্যাসিবাদ বলেন, সেহেতু মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে আমার দেশ পত্রিকাকে বন্ধ করে দিতে হবে। শাহবাগ থেকে ঘোষণা এলো কাদের সিদ্দিকী যেহেতু তাদের দাবিকে সমর্থন করেন না সেহেতু কাদের সিদ্দিকী রাজাকার। মোহগ্রস্ত শাহবাগ যখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে একের পর এক অদ্ভুত দাবি তুলে নিজেদেরকে ভাঁড় প্রমাণ করতে সক্ষম হলো তখন হঠাৎই একদিন আবিষ্কৃত হলো শাহবাগের ব্লগারদের ভয়ংকর ইসলাম বিদ্বেষের খবর।
শাহবাগের নাস্তিকরা শুধু নাস্তিক হলে এমন কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু তারা নাস্তিকতার নামে পবিত্র ধর্ম ইসলামকে যে অশ্লীল ও নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর প্রেরিত নবী মুহাম্মদকে (সা.) উচ্চারণ-অযোগ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে এবং নবী (সা.) ও নবী পতœীদের চরিত্র নিয়ে জঘন্য ভাষায় কুৎসা রচনা করেছে। দেখা গেল ইসলাম, আল্লাহ ও নবীকে (সা.) আক্রমণে এরা তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার বা সালমান রুশদিকেও ছাড়িয়ে গেছে। শাহবাগের তরুণদের এহেন দুষ্কর্মের খবর প্রচারিত হলে সারা দেশের মুসলিমরা ফুঁসে ওঠে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। সেই বিক্ষোভে পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারায় ইসলামপ্রিয় জনতা। সরকারের পোষা গণজাগরণের বিপরীতে জনগণের প্রকৃত গণজাগরণ দৃশ্য দেখে শাহবাগের তরুণদের নেশার ঘোর কিছুটা কেটে যায়। ফলে রাজাকারের ফাঁসি এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ এই দুটি দাবি রেখে বাকি সব দাবি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় তারা। ইতোমধ্যে নিজেদের মিছিল-সমাবেশে ক্রমহ্রাসমান উপস্থিতি সংখ্যা দেখে শাহবাগীদের উদ্বেগও বাড়তে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের আল্লামা শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারদের শাস্তি, সংবিধানে ‘আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপনসহ ১৩ দফা দাবিতে আগামী ৬ এপ্রিল ঢাকায়  লং মার্চের ডাক দেয়। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দল, চরমোনাইয়ের পীরের ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ ইসলামী ও সমমনা ১২ দল সেই লংমার্চে  সমর্থন দেয়। বলা যায়, আওয়ামী লীগ ছাড়া পুরো জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। আল্লামা শফী ঘোষণা দিয়েছেন ৬ তারিখের লংমার্চে ঢাকা শহরে ৫০ লাখ লোক জড়ো হয়ে  শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। ভয়ে সরকার বাহাদুরের ঘুম হারাম হয়ে যায়। লংমার্চ থেকে বিরত থাকার জন্য হেফাজতকে বাগে আনতে সরকার সব ধরনের কৌশল করতে থাকে। আল্লামা শফী সাহেবের কাছে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে ডিসি, এসপি, পুলিশের আইজি ও সর্বশেষ বন ও পরিবেশমন্ত্রী হাসান মাহমুদকে। কিন্তু হেফাজতকে কোনমতেই তাদের কর্মসূচি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয় না। চারজন ব্লগারকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এদেরকে রিমান্ডেও নেয়া হয়। হেফাজতকে ঠেকাতে সর্বশেষ কৌশল হিসেবে সরকার বেছে নেয় তাদের বি ও সি টিমকে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নামে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা  থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করে সরকার। আর গণজাগরণ মঞ্চের নামে ডাকে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ। কিন্তু পথে পথে বাধা, হামলা, গ্রেফতার উপেক্ষা করে গাড়ি না পেয়ে পায়ে হেঁটে লাখ লাখ জনতা ৬ এপ্রিল সকালেই এসে উপস্থিত হয় মতিঝিলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, স্মরণকালের মধ্যে এত বড় সমাবেশ আর অনু্িষ্ঠত হয়নি। কয়েক লাখ ইসলামপ্রেমিক জনতার উপস্থিতিতে মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় ১৩ দফা দাবি না মানা হলে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ শেষে আগামী ৫ মে ঢাকা অবরোধ করা হবে। এছাড়াও আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে এবং পথে পথে হেফাজতকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আগামী ৮ এপ্রিল হরতালও আহ্বান করে হেফাজতে ইসলাম। এই পরিস্থিতিতে সরকার বিগত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। হেফাজতের দাবি মানতে হলে তাদের সাধের শাহবাগকে তাড়িয়ে দিতে হয়, আবার দাবি না মানলে ইসলামপন্থীদের ভোট ও সমর্থনের আশা ছাড়তে হয়।
শাহবাগে গঠিত নাস্তিকদের তথাকথিত ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ পুরো দেশকে আজ দু’ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। একপক্ষে আছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গুটিকয়েক নাস্তিক, অন্যপক্ষে আছে ইসলামপ্রিয় জনতা। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ চালু আছে লাভ বিগেটস লাভ, হেট্রেড বিগেটস হেট্রেড। অর্থাৎ ভালোবাসা ভালোবাসা ডেকে আনে আর ঘৃণা ডেকে আনে ঘৃণা। বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ক্ষেত্রে। ঘৃণা ছড়াতে জন্ম নেয়া গণজাগরণ মঞ্চ আজ নিজেই সারা দেশের মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। যে ঘৃণার আগুনে ঘি ঢেলে সরকার এতদিন আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে সেই আগুন আজ সরকারকেই ছারখার করে দেয়ার জন্য ধেয়ে আসছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads