বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৩

রিমান্ডের রাজনৈতিক ব্যবহার না হোক



দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানোর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ উঠেছে। এর আশু কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি দেলাওয়ার হোসেনকে দীর্ঘ সময়ের জন্য রিমান্ডে নেয়া। দু’জনের মধ্যে ছাত্রনেতা দেলাওয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ৩১ মার্চ। পরদিন পুলিশের আবেদনে আদালত তাকে ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিল। এই ১৪ দিন দেলাওয়ারকে কোথায় কিভাবে রাখা হয়েছিল তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এমনকি পরিবারের অনুরোধেও দেলাওয়ারের অবস্থান ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানায়নি পুলিশ। নির্ধারিত ১৪ দিন পার হওয়ার পর গতকাল ১৭ এপ্রিল পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে আবারও রিমান্ড চেয়েছে। আদালতও নতুন করে ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। ছাত্রশিবির সভাপতি দেলাওয়ারকে যখন আদালতে আনা হয় তখন তাকে গুরুতর অসুস্থ দেখা যাচ্ছিল। তিনি এমনকি হাঁটতে পর্যন্ত পারছিলেন না। পুলিশ তাকে পেছন থেকে ঠেলে এগিয়ে দিচ্ছিল। দেলাওয়ারের চোখে-মুখে ছিল তীব্র যন্ত্রণার স্পষ্ট ছাপ। তার আইনজীবীও একই কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়া দেলাওয়ার জন্ডিসেও আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু পুলিশ তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। আদালতও কেবল রিমান্ডই মঞ্জুর করেছে, চিকিৎসার নির্দেশ দেয়নি। রিমান্ডকেন্দ্রিক আলোচনায় একযোগে এসেছে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কথাও। পুলিশ তাকে ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করেছিল। সেদিনই পুলিশের আবেদনে আদালত ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। কাকতালীয়ভাবে মাহমুদুর রহমানকেও গতকালই আদালতে হাজির করা হয়েছে। আবারও রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানায়নি পুলিশ। মাহমুদুর রহমানের চেহারা এবং শারীরিক অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, ছাত্রনেতা দেলাওয়ারের মতোই তিনিও হাঁটতে পারছিলেন না। তিনি দুর্বলও হয়ে পড়েছেন যথেষ্ট। জানা গেছে, গুরুতররূপে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন মাহমুদুর রহমান। প্রকৃতপক্ষে তার জীবন নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছিল। মূলত সে কারণেই তাড়াহুড়ো করে আদালতে হাজির করা হয়েছে তাকে রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হবার আগেই। 
দুর্ভাগ্যজনক তথ্যটি হলো, জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং ‘গণতান্ত্রিক’ নামধারী বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকে রিমান্ডে নেয়ার কর্মকা- সেই যে শুরু হয়েছে তা আর থামানোর নাম পর্যন্ত করা হচ্ছে না। বরং তা আজ যেন এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষ করে শিকার হচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। বড়দের পাশাপাশি সেদিন জন্ম নেয়া তরুণ ছাত্ররাও যে রেহাই পাচ্ছেন না তার প্রমাণ তো ছাত্রশিবিরের সভাপতি দেলাওয়ার হোসেনই। আপত্তির কারণ হলো, ঢালাওভাবে রিমান্ড মঞ্জুর হচ্ছে। কথা শুধু রিমান্ড চাওয়া ও মঞ্জুর করার কারণে ওঠেনি। সাধারণত রিমা-ে নেয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য জানার জন্য। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। সে নির্দেশনার কোন তোয়াক্কাই এখন করা হচ্ছে না। ২০০৩ সালে হাই কোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চের দেয়া নির্দেশনার উল্লেখ করা যায়। এই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, রিমান্ডে নেয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবীর উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। রিমান্ডে নেয়ার আগে ও পরে অভিযুক্তকে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে, প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু মহাজোট আমলে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতিও চরম উপেক্ষা দেখানো হচ্ছে আরও বেশি। বিচারকরাও রিমান্ড মঞ্জুর করার সময় এ বিষয়ে তেমন কোনো নির্দেশ দিচ্ছেন না। এর মধ্য দিয়ে আসলে যে আইন ও সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিই অসম্মান দেখানো হচ্ছে সে কথাটা পর্যন্ত বিবেচনা করছেন না কর্তা ব্যক্তিরা। কথা শুধু এটুকুই নয়। দেখা যাচ্ছে, রিমান্ডে নেয়ার মাধ্যমে দেশের বিচার ব্যবস্থাকেই তছনছ করে ফেলা হচ্ছে। কারণ, রিমান্ড মঞ্জুর করা না করা সম্পূর্ণরূপে বিচারকের এখতিয়ার হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না বলে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক মামলায় বিচারকদের ওপর নাকি ‘চাপ’ থাকে। এই ‘চাপ’ নিশ্চয়ই রাস্তার লোকজন দেয় না। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে চাপ আসে বলেই বিশেষ করে নিম্ন আদালতের পক্ষে স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। ছাত্রশিবির নেতার বিষয়টি লক্ষ্য করলেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ১৪ দিনব্যাপী নির্যাতন চালানোর পর এমন এক অবস্থায় আরো ১৮ দিনের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে যখন তিনি এমনকি হাঁটতে পর্যন্ত পারছিলেন না। এমন অবস্থাকে অবশ্যই স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান সরকারের আমলে রিমান্ড পরিস্থিতি আসলেও অত্যন্ত ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সরকারও সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এগিয়ে চলেছে এবং অবজ্ঞা দেখানো হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি। পরিণতিতে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ন্যায় বিচার পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আমরা মনে করি, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ব্যাপারে আদৌ সততা থাকলে এবং রাজনৈতিক শত্রুতা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য না থাকলে সরকারের উচিত রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তার ঊর্ধে ওঠা এবং বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads