রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতের অন্ধকারে মন্দিরে হামলা হচ্ছে : সঞ্জীব চৌধুরী



বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বিতর্ক এবং বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রধান সহকারি সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান-পাট এবং মন্দিরে হামলা-ভাংচুর-লুটপাটের সমালোচনা করে বলেছেন,  এইসব হামলার পেছনে সরকারের সমর্থন রয়েছে। সরকারদলীয় লোকেরা এসব হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা ভয়ে কারও নাম পর্যন্ত বলছে না। হিন্দুদের পাশাপাশি দাড়ি-টুপিওয়ালা মুসলমানরাও নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
তাঁর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাতকারটি এখানে উপস্থাপন করা হল-


প্রশ্ন  : দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান-পাট আর মন্দিরের ওপর বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিচ্ছিন্নভাবে যে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এবং তা এখনো পুরোপুরি থামেনি। এ নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে। তো আসলে কারা এবং কেন এ হামলা চালাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
সঞ্জীব চৌধুরী : দেখুন! যখন বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর থেকে দেশের মধ্যে যে বিক্ষোভ মিছিল, হরতাল ও পুলিশি হামলা চলছে সেই পটভূমিতে হঠাত করে দেখা গেল সংখ্যালঘুদের ওপর বিশেষ করে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান-পাট এবং মন্দিরে হামলা হচ্ছে, ভাংচুর হচ্ছে ও লুটপাট হচ্ছে। কারা এগুলো করছে পুলিশ তা ট্রেস করতে পারছে না। তাছাড়া এসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে আসামিও করতে পারছে না বা কাউকে গ্রেফতারও করতে পারছে না পুলিশ। আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারাও সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম বলছে না। আর এ ঘটনা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হয় তারা কাউকে চিনতে পারিনি। যারা হামলা করছে তারা বহিরাগত। আর যদি বহিরাগতরা এসে এভাবে মাঝে মাঝে হামলা চালায় তাহলে ধরে নিতে এটা পরিকল্পিত একটা ব্যাপার। আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি হতে পারে সেটি হচ্ছে-এইসব হামলার পেছনে সরকারের সমর্থন এবং সরকারদলীয় গুণ্ডা-পাণ্ডারা এর সঙ্গে জড়িত। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরা ভয়ে কারও নাম বলছে না। তবে যারাই করে থাকুক না কেন এর সমস্ত দায়-দায়িত্ব কিন্তু সরকারের ওপর বর্তায়। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, দেশের প্রতিটি মানুষের ডিগনিটি বা মর্যাদা রক্ষা করা, জনগণের ধন-সম্পত্তির অধিকার, প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
সরকারের দাবি- এসব করছে বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত-শিবির করছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে- আসলেই যদি এই অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, হামলা এইসব কাজ যদি জামায়াত-শিবির বা বিএনপি করত তাহলে সরকার একমুহূর্তও বসে থাকত না। জামায়াতের একজনকে কোনরকমে ধরতে পারলে আরো ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিত। কিন্তু তা তো দিতে পারছে না বা তাতো দেখছি না। এর আগে রামুর ঘটনায় দেখা গেল সরকার প্রথমেই জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ওপর দোষ চাপাল। পরে ভিডিও ফুটেজ থেকে শুরু করে সবকিছুতে দেখা গেল- আওয়ামী লীগের স্থানীয় লোকজনই এর সাথে জড়িত।
প্রশ্ন : অনেকে বলছেন,সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার জন্য প্রধানত সরকার দায়ী। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- দেশে তো বহু রাজনৈতিক দল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকার একা কেন দায় নেবে?
সঞ্জীব চৌধুরী : সরকারকে একা দায় নিতে হবে কারণ- তারা জনগণের সরকার। অন্যান্য রাজনৈতিক দল সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে কিন্তু মূল দায়িত্বটা সরকারকেই নিতে হবে। দেশের জনগণের ভোটে তারা জিতেছে। ভোটে জয়লাভের পর জনগণের এই দায়িত্ব নেয়ার শপথ তারা নিয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রী হয়েছে এবং মন্ত্রীসভা গঠন করেছে। অতএব সরকার দায়-দায়িত্ব নেবে না তো নেবে কে? দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বলে কথা নয়, বড় কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে এমনকি কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় বা এ জাতীয় কিছু ঘটলেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজ উদ্যোগে কিছু করবে বা দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়াবে সে কালচারটা দেখা যায় না। তবে এই কালচারটা পাকিস্তান আমলে ছিল। আর বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে এই কালচারটা একেবারে উঠে গেছে। তবে তারপরও বর্তমান সংখ্যালঘু নির্যাতনের সময় আমি নিজে একজন হিন্দু এবং মোটামুটি পরিচিত হিন্দু হওয়ার কারণে আক্রান্ত হওয়া অসহায় ও ক্ষতিগ্রস্ত দু’চারজন সংখ্যালঘু হিন্দু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কোন সাহায্য পাওয়ার আশায় নয়, কেবলমাত্র সহানুভুতি এবং সহমর্মিতার আশায় তারা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। তো তাদের কাছে আমি যেটা শুনেছি সেটা হচ্ছে, জায়গায় জায়গায় ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু হিন্দুদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির মেরামতের জন্য অর্থ সাহায্যও দিয়েছে, মিস্ত্রি নিয়োগ করেছে এবং সার্বিক খোঁজখবর নিয়েছে। এটা খুবই একটা ভাল খবর এবং আশাব্যঞ্জক খবর। কোথায় কোথায় বিএনপির লোকজন এভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজখবর নিচ্ছে বলে শুনেছি। তবে ব্যাপকভাবে সর্বত্র শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে জামায়াতে ইসলামী খোঁজখবর নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রশ্ন : সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, দোকান-পাট ও মন্দিরে হামলা ঠেকাতে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয় একটা উদ্যোগ ছিল। আপনি কি তাকে যথেষ্ট মনে করছেন না?
 সঞ্জীব চৌধুরী : দেখুন! আমি মনে করার ব্যাপারটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল এখানে- আসলে বাস্তবতা কি! সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে বা প্রশাসনিক উদ্যোগ নিয়েছে- সেটা যদি যথেষ্ট হতো তাহলে এই যেসব হামলা বা হুমকি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনের খবরের কাগজে দেখা যাচ্ছে যে দু'একটি জায়গায় এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে। কোথাও মন্দির ভাঙছে, কোথাও হিন্দুদের ধানের গোলা লুট হচ্ছে বা কোথায় আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তো যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে আমি কিভাবে বলি যে, সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা যথেষ্ট! তাছাড়া সরকারের প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি সরকার দলীয় উদ্যোগ নেবে তাতে অসুবিধা হচ্ছে এইসব ঘটনাগুলো ঘটছে গ্রামাঞ্চলে। আর গ্রামাঞ্চলের যেটা বাস্তবতা সেটা হচ্ছে- আমি সরকারের সমালোচনা করছি না- সরকারের যারা এমপি মন্ত্রী বা নেতারা আছেন এবং তাদের ঘনিষ্ঠ যেসব সরকারদলীয় লোকজন আছেন এবং সরকারের অঙ্গসংগঠনের যারা আছেন তারা গত চার বছর ধরে মানুষের ওপর এত অত্যাচার করেছে যে গ্রামাঞ্চলে প্রকাশ্যে যেতেও ভয় পাচ্ছে। তো আপনি পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন- তারা যদি গ্রামে যেতেই ভয় পায় তাহলে তারা যে হামলা চালাচ্ছে- এই ইকুয়েশনটা মেলাবেন কিভাবে? সেক্ষেত্রে আমি বলব- এই হামলাগুলো হচ্ছে প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং রাতের অন্ধকারে চোরের মত। প্রকাশ্যে দিবালোকে এসব হামলাকারীদের বেরোবার সাহস নেই।
গ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ব্যাপারে এবারের একটা আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে গ্রামবাসীরা মনে করছে তাদের গ্রামে কোন হিন্দু বাড়িতে যদি এভাবে হামলা হয় সেটা তাদের গ্রামের বদনাম ও বেইজ্জতি। এইজন্য গ্রামবাসী মুসলমানরা  যারা দল বা রাজনীতি তেমন করে না তারা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের উদ্যোগে হিন্দু পরিবারগুলোকে, তাদের মন্দিরকে পাহারা দিচ্ছে বলে আমি শুনেছি। যার ফলে বদমায়েশরা দিনের বেলায় কিছু করতে সাহস পাচ্ছে না।
প্রশ্ন : এমনও কথা শোনা যাচ্ছে- সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক হিন্দুরাই বেশি জড়িত এবং কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন- হিন্দুরাই হিন্দুদের সবচেয়ে বড় শত্রু। এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
সঞ্জীব চৌধুরী :  দেখুন! নানা কারণে আমাদের সমাজ এক রকম পচে গেছে। আর সেই পচন থেকে হিন্দুরাও মুক্ত নয়। হিন্দুরাও যে হিন্দুদের সাথে  নানা ব্যাপারে পারস্পরিক শক্রতায় লিপ্ত এ বিষয়টি আমি জানি। এ ব্যাপারে বেশ কয়েকমাস আগের একটি ঘটনার কথা আমি বলতে চাই। অ্যাডভোকেট মনোরঞ্জন দাস নামে এক হিন্দু ভদ্রলোককে আমি জানি। তিনি খুলনায় থাকেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত তিনিই একমাত্র হিন্দু যিনি বিচারপতি ছাত্তারের বিপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা  করেছিলেন। মনোরঞ্জন দাস আওয়ামী লীগ করেন না। তিনি তার মত রাজনীতি করেন। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্যা নিয়ে ভাবেন। তার প্রচুর জায়গা জমি আছে সেখানে তিনি এক হিন্দুকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর আশ্রিত ওই হিন্দু তার সময় সম্পত্তির একটি অংশ দখল করে নেয়ার চক্রান্ত করেন। আর এরই অংশ হিসেবে যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে তাই আওয়ামী লীগের কিছু গুণ্ডা-পাণ্ডাদের নিয়ে ওই ভদ্রলোককে শারীরিকভাবে এমন নির্যাতন চালায় যে তিনি মরার দশা হয়ে যায়। কোনরকমে একটু সুস্থ হয়ে এর প্রতিকারের আশায় স্থানীয় 'হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’-এর নেতাদের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার বক্তব্য মতে, ওই আশ্রিত হিন্দু এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ আওয়ামী লীগার সবাই মিলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতাদের ঘুষ দিয়ে হোক, মদ খাইয়ে হোক বা কথাবার্তা বলে হোক এমনভাবে তাদের প্রভাবিত করে ফেলেছে যে তিনি কোন প্রতিকার পাননি। অতএব আপনি যখন বলছেন- কোন কোন ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে হিন্দুরা হিন্দুদের শক্রতা করছে- এ কথায় আমি অবাক হব না। কারণ যেদেশে মুসলমানরা মুসলমানের শক্রতা করছে, বৌদ্ধরা বৌদ্ধদের শক্রতা করছে- এ রকম অনেক ঘটনা আছে। এখানে সহমর্মিতার ঘটনা যেমন প্রচুর আছে তেমনি পারস্পরিক শক্রতা, বিদ্বেষ, ঘৃণা এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতএব আমি আপনার এই তথ্যটাকে ডাহা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে পারছি না।  
প্রশ্ন  : সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় এখন বাংলাদেশের মুসলমানরাও নানাভাবে অসহায় শিকার হয়ে পড়েছেন। নানাভাবে এসব ঘটনা ঘটলেও সব কিছুর দায় চাপানো হচ্ছে মুসলমানদের ওপর। বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সঞ্জীব চৌধুরী : দেখুন! আমি সাংবাদিক মানুষ। আমি আমার একটা লেখায় লিখেছি, বিশেষ করে দাড়ি-টুপিওয়ালা মুসলমানরা এখন বাংলাদেশে হিন্দুদের চেয়েও বেশি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই যে মাত্র গতকালের ঘটনা। আমার বাসা গোপীবাগ এলাকায়।  আমার অফিস থেকে আমি বৌদ্ধমন্দিরে গিয়েছিলাম। আমি হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ মন্দিরে যাই কারণ হচ্ছে আমার জন্মভূমি চট্টগ্রামে। আর বৌদ্ধরা বেশিরভাগই চট্টগ্রামের। ওখানে গেলে সবার সাথে দেখা সাক্ষাত হয়। তো আমি বৌদ্ধমন্দির থেকে ফেরার পথে মানিকনগরের মোড়ে নেমে রাস্তা ক্রস করে গোপীবাগে ঢুকব। ঠিক সেই রাস্তার মুখে দেখলাম অস্ত্রধারী এক পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। আমি যখন তার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি তখন হঠাত করে বলা নেই, কওয়া নেই, ওই পুলিশ খপ করে একজনের হাত ধরে ফেলল এবং তাকে খানিকটা অভদ্রভাবে ‘দাড়াঁও’ বলল। আমি লোকটিকে লক্ষ্য করে দেখলাম একটা হাফহাতা শার্ট ও প্যান্ট পরা। তবে ব্যতিক্রমের মধ্যে লোকটির চাপ দাড়ি আছে। লোকটির বয়স হবে ৪২ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। পুলিশ তাকে কোনভাবেই ছাড়ছে না। লোকটাকে নিয়ে একপাশে নিয়ে গেল। তাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারলাম না। তবে তার চেহারা দেখে বুঝলাম লোকটি অসহায়ভাবে পুলিশকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। বুঝলাম পরিস্থিতি ভাল না। তারপর আমি আমার দেশ পত্রিকায় চাকরি করি ফলে কি-না কি হয়ে যায়, সেই ভয়ে আমিও কিছু বল্লাম না বা এগিয়ে গেলাম না। আমার মত আমি চলে গেলাম। 
তবে আমি বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম বাংলাদেশ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। সেখানে এক নিরীহ মুসলমান যিনি এই এলাকাতেই কোথাও বসবাস করে হয়ত। সে হেঁটে হয়ত তার বাড়ি ফিরছে কিন্তু তার অপরাধ হচ্ছে দাড়ি রাখা। আর দাড়ি রাখার অপরাধে ওই নিরীহ মানুষটাকে যে পুলিশ ধরে ফেলল সেই পুলিশও একজন মুসলমান। আশপাশ দিয়ে শত শত লোক যাচ্ছে সবাই নির্বিকার। আর ওইখান দিয়ে যারা আসা-যাওয়া করছে তাদের বেশির ভাগই মুসলমান। একজন নিরীহ মানুষকে এভাবে হেনস্তা করল পুলিশ। ফলে এখানে ইসলামী সহমর্মিতা কোথায় গেল? তবে আমি নিশ্চিত- পুলিশ ওই রাতে লোকটির কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা আদায় না করে ছাড়েনি। তার একটাই অপরাধ সে দাড়ি রেখেছে।
আপনি ফোন করার মিনিট পনের আগে আমার ছেলের কাছ থেকে একটি ঘটনা শুনলাম। আমাদের পাড়ায় বাসা থেকে খানিকটা দূরে একটা ফার্মেসি আছে। সেই ফার্মেসির মালিক একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। তার ছোট ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে। তিনি ছোট ভাইকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেই হাসপাতালে তাকে সাদা পোশাকধারী অথবা ইউনিফর্মধারী পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তিন থেকে চারদিন হয়ে গেছে তাকে ছাড়া হয়নি। দরাদরি চলছে ৫ লাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে আর ওই পরিমাণ টাকা না দিলে জামায়াত-শিবিরের লোক বলে চালান দিয়ে দেবে।  তো আসলে আমরা আছি কোথায় এবং দেশে এগুলো আসলে হচ্ছে কী? যেদেশের শতকরা ৮৫ জন হচ্ছেন মুসলমান। আর মুসলমানদের একটা ধর্মীয় ঐতিহ্য হচ্ছে দাড়ি রাখা।এ কথাও ঠিক যে প্রচুর মুসলমান দাড়ি রাখেন না তারা ক্লিন সেভ। যদিও ক্লিন সেভ মুসলমানের সংখ্যা দাড়ি রাখা মুসলমানের চেয়েও বেশি। তারপরও তো ইসলামি ট্রেডিশন অনুযায়ী দাড়ি রাখা সুন্নত। কারণ মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) দাড়ি রাখতেন। ফলে মুসলমানদের দাড়ি রাখা সুন্নত। তো সংখ্যালঘু মুসলমানের দেশে মুসলমানরা যদি দাড়ি রেখে বিপন্ন হন, আর দাড়ির সঙ্গে টুপি থাকলে তো কথাই নেই! এটা আসলে কী হচ্ছে!
এটা আসলে আত্মঘাতি, ভ্রাতৃঘাতি একটি বিষয়। দাড়ি-টুপিওয়ালা মুসলমান যদি ক্লিনসেভ মুসলমানের হাতে বিপন্ন হয় এবং নিরাপদ না থাকে সেক্ষেত্রে আমি হিন্দু হয়ে কার কাছে নিরাপত্তার আশা করব? কারণ যে যাই বলুক না কেন, একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে আমার অনেক অভিযোগ আছে, অভিমান আছে। কিন্তু এ কথাতো ঠিক যে, দাড়ি টুপিওয়ালারা কখনও বাংলাদেশ শাসন করেনি। অতএব আমার অভিযোগ অভিমান থাকলেও দাড়ি-টুপিওয়ালা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তো আমার কোন অভিযোগ থাকার কথা নয়, যদি আমি যুক্তি মানি। এখন ওই বেচারারা পড়েছে মহাবেকায়দায়, মহাসমস্যায় সেক্ষেত্রে আমি আমার সমস্যা নিয়ে যাব কার কাছে। এসব কথা ভাবছি আর দিশেহারা বোধ করছি।
প্রশ্ন  : সবশেষে আমরা মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যন ড. মিজানুর রহমানের একটি বক্তব্য নিয়ে কথা বলব। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ২০ বছর পর এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো মানুষ থাকবে না। তিনি বলেছেন,  এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে তা অনুশীলন মাত্র। আসল ঘটনা এখনো ঘটতে বাকি। তার বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য? এবং তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা কি?
সঞ্জীব চৌধুরী : দেখুন! মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান যে কথাটি বলেছেন-এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলব নাকি দানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলব তা বুঝে পাচ্ছি না। নেহায়েত উল্লুক না হলে কেউ এমন কথা বলতে পারে! বাংলাদেশে এখন কমবেশি দুই কোটি হিন্দু রয়েছে। তাহলে এরা যাবে কোথায়। এদেরকে কি  মুসলমানরা কেটে ফেলবে, মেরে ফেলবে? দেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি এ কথা বলে গোটা দেশকে বেইজ্জত করেছেন।
বর্তমানে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো এমনিতেই নানা কারণে ইসলাম ফোবিয়ায় ভুগছে। তারা এখন বিশ্বের দেশে দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হয়েছে। আমি এ প্রসঙ্গে একটু বলতে চাই- আমাদের দেশের ক্লিন সেভ করা মুসলমানরা দাড়ি-টুপিওয়ালা মুসলমানদের নির্যাতন করতে পারলে, ছলে-বলে-কৌশলে একটা ধাক্কা দিতে পারলে, চটকানা দিতে পারলে যেমন খুশি হয়, ঠিক তেমনি পশ্চিমা দেশগুলোর অমুসলমানরা সাধারণভাবে সব মুসলমানদের সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করতে পারলে খুশি হয় এবং সেই রকম ব্যবহার করার জন্য তাদের হাতে একটা হাতিয়ার তুলে দিলেন আমাদের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সাহেব। তিনি নাকি ডক্টরেট! তিনি কোথা থেকে পিএইচডি করেছেন আমি জানি না। তিনি এইভাবে দেশের  বেইজ্জতি করছেন। তাছাড়া তিনি কিভাবে বললেন যে, হিন্দুদের ওপর যে, সব আক্রমণ হয়েছে এগুলো রিহার্সেল, আসল আক্রমণ আসছে। এই কথা বলে তিনি তো হিন্দুদেরকে চরমভাবে আতঙ্কিত করে তুলেছেন। একইসঙ্গে দেশকে বেইজ্জত করেছেন, তার পদের অমর্যাদা করেছেন  এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads