শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৩

সাভার ট্রাজেডি নিয়েও রাজনীতি



গত ২৪শে এপ্রিল সকাল ৯টা বাজবার একটু আগে সাভারের রানা প্লাজা নামের একটি ৯ তলা মার্কেট ভবন ধসে গিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। এ মার্কেট ভবনটিতে পাঁচ-ছ’টি পোশাক কারখানা ও পাঁচশতাধিক দোকান, ব্যাংকসহ কয়েকটি বেসরকারি অফিস ছিল। উল্লেখ্য, মার্কেট ভবনটির মারাত্মক ফাটল সত্ত্বেও এর মালিক সোহেল রানা এবং পোশাক কারখানার মালিকরা বিশেষ করে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জোর করে এবং বেতন না দেবার ভয় দেখিয়ে কাজ করতে বাধ্য করে। অনেক শ্রমিককে মারধর করেও কাজে যোগদানে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ভবন ধসের আগের দিন বিপদ অনুমান করে ব্যাংকের কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়া হয় বলে জানা গেছে। এতে সৌভাগ্যবশত ব্যাংকের কর্মচারী-কর্মকর্তা ও এর গ্রাহকরা সবাই বেঁচে গেছেন। কিন্তু ভবনের মালিক ও পোশাক কারখানার মালিকদের একগুঁয়েমিতে কারখানা চালু রেখে প্রায় পাঁচ-ছ’ হাজার শ্রমিককে কাজে বাধ্য করায় তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয় বলে অভিযোগ তীব্রতর হচ্ছে। ভবনটি ভেঙ্গে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার লোকজন আহত-নিহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। খবর পেয়ে দ্রুত সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার ব্রিগেড, আনসার বাহিনী ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হয়। ইতোমধ্যে দুর্ঘটনাস্থল থেকে তিনশতাধিক মৃতদেহ এবং হাজার খানেক আহত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সম্পাদকীয় লেখা অবধি উদ্ধার কাজ অব্যাহত ছিল। কিন্তু ভবনের নিচে চাপা পড়াদের উদ্ধার কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে পচা-গলা মৃতদেহের দুর্গন্ধে উদ্ধার কর্মীরা যেমন টিকতে পারছে না, তেমনি এখনও বেঁচে থাকা মানুষের আর্তনাদ এবং তাদের বেঁচে থাকবার আকুতি উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণকারীদের বারবার হতবিহ্বল করে তুলছে।
সাভার ট্রাজেডি দেশবাসীসহ বিশ্ববিবেককে হতভম্ব করে তুললেও আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা দুঃখজনকভাবে এ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। স্থানীয় এমপি মুরাদ জং একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ বিপর্যয় নাকি ‘ঘটানো হয়েছে।’ তার ইঙ্গিত মনে হয় প্রকৃত দায়ী ছাড়া অন্য কোন দিকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘হরতাল সমর্থকরা ভবনের গেইট ও স্তম্ভ ধরে ধাক্কাধাক্কি করছিল’ বলে ভবনটি ধসে পড়তে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্যকে নিষ্ঠুর রসিকতা বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উল্টা-পাল্টা মন্তব্য না করতে পরামর্শ দিয়েছেন। ১৮ দলীয় জোটনেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আহতদের খোঁজ-খবর নেবার বিষয় নিয়েও বক্র মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা নাকি আওয়ামী লীগ কিংবা যুবলীগের কেউ নয় বলে জোর দাবি করেছেন। অথচ সাভারের অলিতে-গলিতে স্থানীয় এমপি মুরাদ জংয়ের সঙ্গে রানার ছবিসহ অসংখ্য পোস্টার সাঁটানো রয়েছে। অবশ্য এমপি সাহেব আলোচ্য পোস্টার সরিয়ে ফেলবার দাবি করেছেন টিভি ক্যামেরার সামনে। তার মানে ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অগণিত লাশ আর আটকে পড়া আহতদের উদ্ধার চলাকালীন মুহূর্তে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ওদিকে সেখানে চাপা পড়া নিহত-আহতদের খুঁজে ফিরছে শত শত মানুষ। তারা স্বজনদের লাশ অথবা আহতদের খুঁজে পেতে দুর্ঘটনাস্থল থেকে এনাম মেডিকেলের হাসপাতাল কিংবা অন্য হাসপাতালে ছুটোছুটি করছেন হন্যে হয়ে। কেউ পাচ্ছেন। কেউ না পেয়ে হতাশ হয়ে স্বজনদের ছবি নিয়ে খুঁজে ফিরছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে কিংবা উদ্ধারকর্মীদের কাছে অভিশপ্ত রানা প্লাজার সামনে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপাপড়া মানুষের বাঁচবার জন্য আর্তনাদ, পচন শুরু হওয়া লাশের উৎকট গন্ধ আর তাদের স্বজনদের বুক ফাটা কান্নায় সাভারের পরিবেশ যেন ভারি থেকে ভারী হতে চলেছে। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে সারাদেশ। এই ভয়াবহ ধ্বংসকা-ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা উচিত ছিল। কিন্তু বলা হচ্ছে, তাকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ কোথাও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বিষয়টি স্বজনহারা মানুষদের আরও বেদনার্ত ও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
আমরা জানি না, ভেঙ্গেপড়া রানা প্লাজা থেকে আর কতজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হবে। আর কতজনের লাশ উদ্ধার করে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া যাবে। অনেকের চেহারা ইতোমধ্যে ফুলে-ফেঁপে বিকৃত হতে শুরু করেছে। যারা আহত অবস্থায় এখনও বেঁচে আছে, তাদের জীবন প্রদীপও ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যেসব উদ্ধারকর্মী জীবনবাজি রেখে কাজ করছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমাদের জানা নেই। উদ্ধার কাজে সহায়তার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার, লাইট, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব ছিল, এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ ব্যাপারে সরকারসহ সকলের সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল কিনা আমরা জানি না। সম্ভবত আজকের মধ্যেই উদ্ধার কাজ সমাপ্ত হবে। এর মধ্যে জীবিত ও মৃত সবাইকে উদ্ধার করা যাবে বলে মনে হয় না। ধ্বংসস্তূপের অনেক জায়গায় এখনও পৌঁছা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রার্থনা করি অবশিষ্ট সময়ে তা করা সম্ভব হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads