সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৩

অরাজনৈতিক মহাসমাবেশের রাজনৈতিক প্রভাব


গত ৬ এপ্রিল ২০১৩ ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে যে মহাসমাবেশ হলো তা শুধু ঐতিহাসিক নয়, এক কথায় অবিস্মরণীয় ও অভূতপূর্ব। বাংলদেশের ইতিহাসে এ রকম বিশালকায় জনসমুদ্র ও অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাবেশ এর আগে কখনো হয়েছে বলে কোনো রেকর্ড নেই। দেশের এক ক্রান্তিকালে অনুষ্ঠিত সমাবেশটির বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ঘটনাটিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে দেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবী সেকুলারিজমকে জাতীয় আদর্শ হিসেবে জাতীয় জীবনের সর্বত্র শক্তভাবে প্রোথিত করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে যেভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল, শাপলা চত্বরে আলেমদের মহাসমাবেশ তার ওপর একটি বড় ধরনের চপেটাঘাত। যারা মনে করত যে, একমাত্র সেকুলারদের মনন ও অভিপ্রায়ই হচ্ছে দেশের জনগণের একমাত্র পরিচয় এবং রাজনীতিতে ধর্মীয় চেতনার ভূমিকা গৌণ, তারা নিঃসন্দেহে বড় একটা হোঁচট খেয়েছেন। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর দিলারা চৌধুরীর মতে, শাহবাগ চত্বরের বাড়াবাড়ির কারণেই হেফাজতে ইসলামের আহ্বানে জনগণ বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে। আজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিকদের জন্য একটি বড় মেসেজ হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মকে বিশেষত ইসলামকে উপো করার সুযোগ আর নেই। এ দেশের রাজনীতিতে ইসলাম একটি অনস্বীকার্য উপাদান হিসেবে নতুন করে জেগে উঠেছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
দ্বিতীয়ত, হেফাজত ইসলামের নেতারা বলেছেন, তাদের আন্দোলন ও দাবিদাওয়ার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নেই; সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। তারা সরকার পরিবর্তন করতে বা মতায় যেতে চান না। সন্দেহ নেই যে, হেফাজতে ইসলাম দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক দল নয় এবং প্রচলিত রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিও তাদের নেই। তবে তারা যে ১৩ দফা দাবিদাওয়া পেশ করেছেন তা একটি রাজনৈতিক সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে এবং সরকারও বিষয়গুলোতে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। যেমন প্রথম দফায় বলা হয়েছে, দেশের সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেতা’ বাদ দিয়ে ‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপন করতে হবে। দাবিটি মানতে হলে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধান পরিবর্তন করে জাতীয় সংসদ এবং এটি হচ্ছে সর্বোচ্চ মাত্রার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এর সদস্যরা হচ্ছেন এক শ’ ভাগ রাজনৈতিক। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেতা’ ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেট ছিল না। ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘ধর্মনিরপেতা’র স্থলে ‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপন করেন এবং গণভোটে তার অনুমোদন নেন। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর তা সংবিধানে বহাল ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় মহাজোট সরকার ‘ধর্মনিরপেতা’ পুনর্বহাল করে। এটি এখন উচ্চমাত্রার একটি রাজনৈতিক বিষয়। সন্দেহ নেই যে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী ‘ধর্মনিরপেতা’র বিরোধী। হেফাজতে ইসলামের ৬ এপ্রিলের সমাবেশ এই রাজনৈতিক বিষয়টির গুরুত্বকে আরো প্রকট করে তুলল। এ ছাড়াও অন্যান্য দাবির সাথে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। যেমন নাস্তিক ও ধর্ম অবমাননাকারীদের শাস্তির বিধান সংবলিত আইন পাস করার দাবিটিও সংসদে পেশ করতে হবে এবং রাজনৈতিক সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এটি যেকোনো সরকারের জন্য একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। অন্য দাবিগুলোরও একইভাবে রাজনৈতিক সংশ্লেষ রয়েছে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সব দাবি মানা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধের দাবিকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল আলম হানিফ কোনো কোনো দাবিকে ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’র সাথে তুলনা করেছেন। কেউ কেউ ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের দাবি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, তাহলে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা ভেঙে ফেলতে হবে? বিষয়টির রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এতই বেশি যে, কোনো সরকারের পে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হবে। হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী তার ভাষণে বলেছেন, ‘মতা থেকে কাউকে সরানো বা কাউকে মতায় বসানোর কোনো দাবি নয়: কিন্তু মতায় থাকতে হলে এসব দাবি মেনেই থাকতে হবে, আবার মতায় যেতে হলেও এসব দাবি মেনেই যেতে হবে।’ সুতরাং হেফাজতে ইসলাম রাজনীতিতে অবতীর্ণ না হলেও তারা রাজনীতির একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
তৃতীয়ত, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিটি সমাজে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি যারা সমাজের অন্যান্য স্বার্থরাকারী শক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সমর্থনের পরিধি বৃদ্ধি করে। এগুলোর মধ্যে শ্রমিক ও ছাত্রসংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠন রয়েছে। ইদানীং এনজিও এবং সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো আধুনিক রাষ্ট্রে আলেমসমাজ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি তা এত দিন কোনো কোনো মহলের বিবেচনায় ছিল না। আবার কেউ কেউ তাদেরকে পশ্চাৎপদ একটি গোষ্ঠী হিসেবে উপো করত। হেফাজতে ইসলামের ৬ এপ্রিলের সমাবেশ প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের আলেমসমাজ একটি সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত ও সচেতন জনগোষ্ঠী। তাদের নেতৃত্ব সমাজের অনেক গভীরে শিকড় গেড়ে আছে, যা উৎপাটন করা সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে তারা এবারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিভিল সোসাইটি সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করেছে। এদের কণ্ঠকে এখন থেকে কেউ আর উপো করতে সাহসী হবে না।
চতুর্থত, হেফাজতে ইসলামের ৬ এপ্রিলের সমাবেশে কত লাখ লোক এসেছিল তা কেউ বলতে পারবে না। তবে এটা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল যে, সমাবেশের কমপে ৯০ শতাংশের বেশি লোক ছিল তরুণ। দেশের তরুণদের একটা বিরাট অংশ যে সেকুলার শাহবাগীদের সাথে নেই; বরং তাদের চিন্তাচেতনার বিপরীতে অবস্থান করছে সেটি অনেকেই বারবার তা বলে আসছিলেন। সে কথা এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। শহরের বিত্তবান ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের হাতছানিতে যারা মরীচিকার পেছনে ছুটে চলেছে সেসব তরুণ-তরুণীর বিপরীতে নিষ্কলুষ জীবনধারার অনুসারী তরুণদের আধ্যাত্মিক চেতনা যে কতটা শাণিত তা শাপলা চত্বরে প্রতিভাত হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে তরুণদের প্রকৃত গণজাগরণ ঘটেছে শাপলা চত্বরে-শাহবাগে নয়। শাহবাগের সমাবেশ ছিল কৃত্রিম সরকারি নিরাপত্তায়, বিনা পয়সার খানাপিনায়, বিনোদন-উচ্ছলতায়, প্রতিহিংসার উন্মত্ততায় ও অশালীনতায় পরিপূর্ণ। অপর দিকে শাপলা চত্বরে তরুণেরা এসেছিল বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, ভুখা-নাঙা শরীরে। তারা হেঁটে এসেছে সৌম্য ও শান্ত অবয়বে। তাদের হাতে ছিল না লাঠি বা লগি-বৈঠা; না ছিল কোনো দেশী অস্ত্র। তাদের কণ্ঠে ছিল না কোনো উগ্র রাজনৈতিক স্লেøাগান; কেবল আল্লাহর জিকির করতে করতে তারা সময় পার করেছে। ছিল না কোনো অভিযোগ বা না পাওয়ার বেদনা। কেউ তাদের বাধ্য করেনি দীর্ঘযাত্রার পথ পাড়ি দিতে।
পঞ্চমত, এই সমাবেশে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সব শ্রেণী ও পেশার লোকেরা এতে দলে দলে অংশ নেয়। দল-মত নির্বিশেষে আল্লামা শফীর আহ্বানে অসংখ্য মানুষ শাপলা চত্বরে হাজির হয়। কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া যেভাবে সাধারণ মানুষ লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের খাদ্য-পানীয় দিয়েছে তা এক কথায় অভাবনীয়। এদৃশ্য এটার ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশের জনগণ সময়মতো ঐক্যবদ্ধ হতে জানে। বিশেষ করে ইসলামের মর্যাদা রার স্বার্থে আলেমদের ডাকে তারা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। প্রত্যদর্শীরা জানিয়েছেন, পানি বিক্রেতা, ডাবওয়ালা, শসা বিক্রেতা, তার সব পণ্য বিনা পয়সায় বিতরণ করে দিয়েছে। এভাবে গরিব ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ হেফাজতের সমাবেশকে দিয়েছিল এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
ষষ্ঠত, বেশ কিছু দিন থেকেই বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশ্লেষকরা বলে আসছিলেন, শাহবাগের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হেফাজতের সমাবেশ এই বিভাজনকে আরো তীè করে দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ শাহবাগের কথিত জাগরণ যুদ্ধাপরাধের বিচারে ফাঁসির রায় দাবির মধ্য দিয়ে শুরু হলেও তা ক্রমান্বয়ে ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে গড়ায় এবং ঘটনাক্রমে প্রায় একই সময়ে নাস্তিক ব্লগারদের ইসলামবিরোধী স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এতে সমগ্র দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সরকার অনেকটা প্রকাশ্যে নাস্তিক ব্লগারদের প নেয়। গর্জে ওঠে দেশের আলেমসমাজ। ঘোষিত হয় লংমার্চ। এর প্রতি সমর্থন জানায় প্রধান প্রধান ডান ও ইসলামপন্থী সব দল, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। অপর দিকে সরকার হেফাজতের দাবি মেনে নেয়ার বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে তাদেরকে প্রতিহত করার উদ্যোগ নেয়। আওয়ামী লীগ এবং সেকুলার বাম ঘরানার দলগুলো আলেমদের আন্দোলনে সমর্থন দানে বিরত থাকে। তারা আরো আগ বাড়িয়ে কয়েকটি ুদ্র সংগঠনকে ব্যবহার করে ৬ এপ্রিল হরতাল ও অবরোধ আহ্বান করায়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও তাদের কর্মী বাহিনী হেফাজত সমর্থকদের ওপর হামলা চালায় এবং সব যানবাহন ও পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর ফলে দৃশ্যত জনমনে এরূপ ধারণা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ইসলামবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ যেন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। ফরহাদ মজহার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকলেও এই প্রথমবারের মতো ইসলাম নিজের প্রাধান্য নিয়ে হাজির হলো। শেখ হাসিনা ইসলামি রাজনীতিকে নির্মূল করতে গিয়ে তাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন’। তিনি আরো বলেন, ‘ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদেও যে আধিপত্য গত ৪২ বছর আমরা বাংলাদেশে দেখেছি, তার দুর্বলতা ও য়ের দিকটাও এতে প্রকট হয়ে উঠল।’
সপ্তমত, এবারের ইসলামি সমাবেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব প্রধান ইসলামি সংগঠন, পীর-মাশায়েখ, ওলামা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একই প্ল্যাটফরমে সমবেত হয়েছেন। বাংলাদেশের আলেমরা এর মাধ্যমে একটি বিরাট নজির সৃষ্টি করলেন। তারা উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের মধ্যকার ছোটখাটো মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে কুণ্ঠিত হননি। এ জন্য তারা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
অষ্টমত, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ইসলামি সংগঠনগুলো নেতৃত্ব প্রশ্নে কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে হিমশিম খেয়ে থাকে। কিন্তু তারা এবারে দেশের বর্ষীয়ান আলেম মুফতি শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে সহজেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তার নেতৃত্ব নিয়ে কোনো মতপার্থক্য দেখা দেয়নি। আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ আল্লামা শফী জাতির এক মহা ক্রান্তিকালে এক দার্শনিক রাজার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। জাতি এমনি এক নেতৃত্বের অপোয় ছিল। দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল ঠিক তখনই তিনি আলোর বর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। ইতিহাসের পাতায় তার ভূমিকা স্বর্ণারে লিখিত থাকবে। ইরানের জনগণ ও আলেমসমাজ যেভাবে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাহের বিরুদ্ধে ইসলামি বিপ্লব ঘটিয়েছিল বাংলাদেশের জনগণ ও আলেমসমাজও আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে রূপ একটি ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করলেন। পাশাপাশি মুফতি শফী সাহেবের সহকর্মী ও সহযোগীরা যে সাংগঠনিক দতার পরিচয় দিয়েছেন তাও চোখে পড়ার মতো। আমাদের দেশের আধুনিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের চেয়ে তারা অনেক বেশি দতা ও শৃঙ্খলার পরিচয় দিতে সম হয়েছেন। এমনকি দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ যে এতটা সুশৃঙ্খল হতে পারে তা আগে আমরা অনুভব করিনি। আমাদের সামনে তো শুধু উন্মত্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই চলে। ধর্মীয় জীবনযাপন যে দেশের জন্য সুনাগরিক তৈরি করতে পারে নীতিপ্রণেতা ও রাজনৈতিক নেতারা এ ঘটনা থেকে শিা নিতে পারেন।
নবমত, এই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ থেকে কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে? সরকারদলীয় নেতারা এবং শাহবাগীরা বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর বি-টিম হিসেবে কাজ করছে। তারা যুদ্ধারাধীদের বাঁচাতে মাঠে নেমেছে। হেফাজতে ইসলাম নেতারা এরূপ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তাদের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। অনেকেই জানেন যে, দেওবন্দ সিলসিলার বা কওমি মাদরাসার আলেমদের সাথে জামায়াতে ইসলামীর মতপার্থক্য দীর্ঘ দিনের। যদিও তা কখনোই প্রকট আকার ধারণ করেনি। তবে এটাও উল্লেখ্য, তাদের মতপার্থক্য ইসলামের মৌলিক বিষয় নিয়ে নয়। আবার এটাও সত্য যে, কওমি মাদরাসার আলেমরাই দেশের প্রধান ধারার ধর্মীয় নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। আর জামায়াতে ইসলামী দেশের ইসলামি রাজনীতির প্রধান ধারার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এ দু’টি প্রধান ধারার মধ্যে যদি কোনো সমন্বয় হয়ে থাকে সেটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ইসলামি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য একটি মাইলফলক হবে। যা-ই হোক, কওমি ধারার আলেমদেরকে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে মাঠে নামাতে সম হয়েছে এমনটি মনে করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। সে সামর্থ্য জামায়াতের আছে বলে মনে হয় না। সরকারি দল ও বাম নেতারা এরূপ অভিযোগ করে জামায়াতের শক্তিসামর্থ্যকে জাতির সামনে অনেক বড় করে তুলে ধরছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশের ১৩ দফা দাবির সাথে জামায়াতের চিন্তাচেতনার মিল রয়েছে। সুতরাং তাদের লাভ ছাড়া কোনো লোকসান নেই।
দশমত, বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের জন্য একটি বিশেষ বার্তা দিয়ে গেল। তারা এ দেশের জনগণের মনমননের একটি প্রতিচ্ছবি বাস্তবে দেখতে পেল, যা তাদের ভূরাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে।
পরিশেষে এটা বলা সমীচীন হবে যে, বর্তমান সরকারের ইসলামি রাজনীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ফলে অনেকেই বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এ দেশে ইসলামের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ জাতিকে একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়ে গেল যার রেশ দেশের রাজনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতিতে দীর্ঘকাল অনুরণিত হবে। বিশিষ্ট সমাজ বিশ্লেষক ও কবি ফরহাদ মজহার মনে করেন, ‘ইসলাম প্রশ্ন আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির নির্ধারক হয়ে উঠবে। রাজনীতি যেভাবে গঠিত হতে থাকবে তার মধ্যে ইসলাম প্রশ্নের মীমাংসা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হয়ে নানাভাবে হাজির হতে থাকবে।’

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads