শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

নববর্ষে আত্মজিজ্ঞাসা



জীবন গতিময়, গতিময় কালও। গতি আছে বলেই কাল আবার হারিয়ে যায় মহাকালের আবর্তে। জীবনের  প্রয়োজনে আমরা কালের গণনা করি। এই গণনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বর্ষপঞ্জি। বর্ষপঞ্জিতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। কোনো বর্ষপঞ্জিতে লক্ষ্য করা যায় সৌর সন, কোনটাতে আবার চান্দ্র সন। বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনে দু’রকম সনেরই রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, তাই দুই রকম সন গণনাতেই আমরা অভ্যস্ত। আমাদের যে বাংলা সন তাতে ‘চান্দ্র’ ও ‘সৌর’ এই উভয় সনেরই প্রভাব রয়েছে। মূলত: বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে হিজরী সন থেকে। মুঘল স¤্রাট আকবরের নির্দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহুল্লাহ সিরাজী স¤্রাটের মসনদে আরোহণের কাল চান্দ্রসন ৯৬৩ হিজরীকে সৌরগণনায় এনে বাংলা সনের উদ্ভব ঘটান। প্রশাসনিক প্রয়োজন তথা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে শৃংখলা বিধানের জন্য স¤্রাট আকবর এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রাজস্ব আদায়ের সাথে সম্পর্ক রয়েছে ফসলের। তাই বাংলা সনকে ফসলি সন হিসেবেও অভিহিত করা হতো। বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ধর্ম, সংস্কৃতি, উৎপাদন ও কৃষক সমাজের প্রসঙ্গ চলে আসে। এভাবে বাংলা সনের সাথে উঠে আসে একটি সমাজ চিত্র। গভীরতর এমন ব্যঞ্জনার কারণেই বাংলা সন আমাদের কাছে এতটা প্রিয়। আজ বাংলা ১৪১৯ সালকে বিদায় জানিয়ে আমরা স্বাগত জানাবো নতুন বর্ষ ১৪২০কে। নতুন এই বর্ষে আমরা সবাইকে জানাই শুভ-নববর্ষ।
নতুন বছরে মানুষের মনে জাগে নতুন আশাবাদ। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানুষ নব প্রেরণায় নতুন করে জীবনকে বিকশিত করতে চায়। এমন ইতিবাচক চেতনার কারণে নানা দুঃখ, বেদনা ও যন্ত্রণার মধ্যে এখনও টিকে আছে মানব সমাজ। তবে সমাজকে, পৃথিবীকে প্রগতির কাক্সিক্ষত পথে এগিয়ে নিতে হলে অতীতের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই বিশ্লেষণের ত্রুটি থাকলে প্রগতির স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। একটি মজার ব্যাপার হলো, বিগত সময়ে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে দিন বদলের আওয়াজ শুনেছিলাম। কিন্তু সে আওয়াজ ইথারে ভেসে বেড়ালেও মাটির এই পৃথিবীতে আমরা ফলবান হতে দেখিনি। সবাই আত্মস্বার্থে কথামালার রাজনীতি করে গেছেন। তাই মানুষের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। বিগত সময়ে দুঃখের রহস্যটা এখানেই রয়েছে নিহিত। শঠতা, নিষ্ঠুরতা ও প্রহসনের এই ভুবনে এখন অনেক আলো, অনেক জৌলুস। এসব দেখে চোখে ধাঁধা লাগলেও মানুষের মন যেন ক্রমেই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এ কারণেই সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই এখন বলতে বাধ্য হচ্ছেন, আলো ঝলমলে এক জাহিলিয়াতে এখন আমাদের বসবাস।
আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। ‘খামার বাংলা’ হিসেবে আমাদের স্বদেশ বিশেষভাবে পরিচিত। কৃষিকে ভিত্তি করেই মানুষ এগিয়ে যায় শিল্পে। প্রগতির এই পথে ফসল উৎপাদনের সাথে সাথে প্রয়োজন হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, সুশাসন ও নৈতিকতার। প্রগতির এই অভিযাত্রাকে সাফল্যম-িত করতে হলে প্রয়োজন গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার। বিগত বছরে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে আমাদের সরকার, রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবীরা কেমন ভূমিকা পালন করেছেন, তা নববর্ষের এই শুভলগ্নে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এই হিসেবটা নিতে গেলে যে কোনো সচেতন মানুষের অন্তর দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে। কারণ বিগত বছরে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সুশাসন তথা কোনো ক্ষেত্রেই আমরা আশাপ্রদ ভূমিকা পালনে সফল হইনি। বরং দেশ ও জাতির অগ্রগতির বদলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির উগ্রতা দেশকে হিংসা-বিদ্বেষ ও সহিংসতার এমন এক আগ্নেয়গিরিতে পরিণত করেছে, যেখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবনই অচল হয়ে পড়েছে। যে সমাজে, যে রাষ্ট্রে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে সেখানে প্রগতি আসবে কেমন করে? আমরা জানি, শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনীতিতে আমরা পিছিয়ে আছি। এমন অবস্থায় উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আমাদের প্রয়োজন সহিষ্ণুতা, স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্কৃতির বিকাশ। কিন্তু এর বদলে আমরা লক্ষ্য করেছি হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ও ব্লেম-গেমের অপরাজনীতি। এমন অবস্থায় দিন বদলের ওয়াদাবদ্ধ সরকার কাক্সিক্ষত আচরণের মাধ্যমে উত্তম উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতো। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। বরং সরকার দমন-অবদমন ও জেল-জুলুমের হিংসাত্মক পথে চলে গোটা দেশকে একটি কারাগারে পরিণত করেছে। সরকারের দায়িত্ব যেখানে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংহতির চেতনায় এগিয়ে যাওয়া, সেখানে সরকার যেন জাতিকে বিভক্ত করার আত্মঘাতী পথকেই বেছে নিয়েছে। এমন দৃশ্যে জনগণ আশাবাদী হবে কেমন করে? সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগারদের গণজাগরণ মঞ্চ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গণহত্যা ও হেফাজতে ইসলামের মহাজাগৃতি জাতিকে যেন কালান্তরের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের দামামার বদলে এখন প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ ও নৈতিক জাগরণ। এমন জাগরণ ছাড়া আমাদের জাতীয় মুুক্তি সম্ভব নয়। কালান্তরের এমন এক সময়ে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি বাংলা ১৪২০ সালকে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ বছরও হালখাতা খুলবে, ইলিশ-পান্তা খাবে, আবেগে লোক-সঙ্গীত গাইবে, নববর্ষে মেলারও আয়োজন হবে। নববর্ষে সাধারণ মানুষের এমন আয়োজনে সাংস্কৃতিক চেতনার চিত্র যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি লক্ষ্য করা যায় জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার ইতিবাচক আকাক্সক্ষাও। কিন্তু উৎসবের আমেজ শেষ হওয়ার পর মানুষ যখন বাস্তবতায় ফিরবে, তখন কি সে আসলেই আশাবাদী হতে পারবে? এমন প্রশ্ন আজ সরকারের কাছে, রাজনীতিবিদদের কাছে এবং পেশাজীবীদের কাছে। নববর্ষের এ প্রশ্নের জবাব কে কিভাবে দেবেন সেটাই হবে আগামীতে দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads