বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৩

দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান



দেশের সাধারণ মানুষ আর কত চাপ সইবে? দিনযাপনের গ্লানিতে তারা এখন ‘দিনবদলের স্বপ্ন’ দেখা ভুলে গেছে। কোনো সুসংবাদ নেই, খবর মানেই এখন দুঃসংবাদ। দমন-অবদমন ও রাজনৈতিক সহিংসতার কর্মকা- জনজীবনে দুঃখের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় মানুষ আগামী নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সে নির্বাচন কোন ব্যবস্থায়, কিভাবে হবে সে বিতর্কের অবসান এখনো হয়নি। সরকার সহজেই এ সংকটের সমাধান করতে পারে কিন্তু সেপথে তারা এগুচ্ছে না। বরং নানা পদক্ষেপ ও বক্তব্যের মাধ্যমে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। জনগণ অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে, শুধু দেশের মধ্যেই সংকট ও টানাপড়েনের মাত্রা বাড়ছে না, বাড়ছে বহিঃবিশ্বের সঙ্গেও। দেশের পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হলেও সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের তাতে যেন কিছু আসে যায় না। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি ইসলামী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেও সাক্ষাৎকার পাচ্ছে না। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। পদ্মা সেতু ইস্যুতে কানাডার সঙ্গেও সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। ভারত-ঘনিষ্ঠতার কারণে চীন বিরূপ, নাখোশ পাকিস্তান। শুধু কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বহিঃবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্কও ভালো যাচ্ছে না। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশীরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো খবর নেই। কিন্তু এই সংকট সমাধানে সরকারের তেমন কোনো গরজও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অথচ বিদেশী কূটনীতিকরা রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার সংকটের কথা বলছেন। তারা জানিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা-সংঘর্ষের খবর প্রকাশের পর এদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে বিদেশীরা এখন দ্বিধান্বিত। অবস্থার পরিবর্তন না হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখান থেকে নিজেদের বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যাবেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধু প্রতিবেশী ভারত ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও দাতা সংস্থার সঙ্গে চলছে টানাপড়েন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, মুসলিম বিশ্ব ও বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চলছে এক ধরনের বৈরিতা। এই সংকট উত্তরণের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হলেও তা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনা নষ্টের আশঙ্কা করছেন কূটনীতিকরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান সময়ে আরব দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে বড় অংকের বিনিয়োগের আলোচনা চলছে। তবে তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের শর্ত আরোপ করছেন। সহিংসতা ও সংঘাতের খবর বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উপর কেমন প্রভাব ফেলছে জানতে চাইলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী সদস্য ডেনমার্কের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত সেন্ড ওলিং বলেন, বাংলাদেশকে সাহায্য দেয়ার সংস্কৃতি পাল্টে বাণিজ্য ও অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়তে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা তাদের দেশের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনতে উৎসাহিত করেন। এজন্য তারা বাংলাদেশে ব্যবসায়িক সুযোগ বিষয়ক নিবন্ধ, ডকুমেন্টারি দেখানোর পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে এদেশ নিয়ে অনেক ইতিবাচক সম্ভাবনার কথাও বলেন। কিন্তু রাজপথের সহিংসতা, সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা ও বৈরিতার কারণে তাদের সব প্রচেষ্টা নষ্ট হয়ে যায়। জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদাশিমো জানান, গত মাসে সনি ও টয়োটার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে এসেছিলো। কিন্তু তারা সহিংসতার কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হোটেলের বাইরে যেতে পারেননি। কোনো রকমে বিমান বন্দরে গিয়ে ফিরে গেছেন জাপানে। বাংলাদেশের সহিংস পরিস্থিতির জন্য জাপানের বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। এদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা বলেছেন, আমাকে গভীর রাতে ফোন করে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের টাকায় চলা বাণিজ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। আমার কূটনৈতিক জীবনে এ রকম কখনো ঘটেনি। এমন পরিস্থিতিতে আমরা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আসতে বলতে পারছি না। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর কাছে উদ্বেগ জানিয়েছেন যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নয়ন সহযোগীরা।
বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার আছে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে বহির্বিশ্বের সাথে যে টানাপড়েন চলছে, তা দূর করার লক্ষ্যে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আর দেশের অভ্যন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ, দমন-অবদমন, সহিংসতা এবং হরতাল কর্মসূচীকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এমন অবস্থায় দেশবাসী সরকারের কাছ থেকে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আলাপ আলোচনার পথে না গিয়ে সরকার দমন-পীড়ন ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে। ফলে উন্নতির বদলে পরিস্থিতি আরো অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে। লক্ষ্য করা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গণবিক্ষোভ প্রতিরোধে পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে সেসব জায়গায় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবি মোতায়েনে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এমন পরিস্থিতি কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কারো কাম্য হতে পারে না। সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বদলে দেশে এখন যেভাবে সহিংসতা ও দমন-পীড়নের সংস্কৃতি চলছে, তার ফলাফল সবদিকেই মন্দ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও হরতালের কারণে সময়মত পণ্য পাঠাতে না পারায় ৩২টি পোশাক কারখানার ২ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে গেছে। তা ছাড়া পুরো পোশাক শিল্পে একদিনের হরতালে প্রায় ২০০ কোটি টাকার উৎপাদন ব্যাহত হয়। গত ২৩ এপ্রিল বিজেএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ নেতারা এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে দেশের প্রধান রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের অস্তিত্ব ধরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, শ্রীলঙ্কার মত বাজার হারাতে বসেছে আমাদের সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক শিল্প খাত। উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতার কারণে শ্রীলঙ্কার তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে তার রমরমা অবস্থান হারিয়েছিলো। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিণাম আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ উপলব্ধি করলেও সরকার সেভাবে উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের চাইতেও দমন-অবদমনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে পঙ্গু করে দেয়াই যেন সরকারের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এ কারণেই হয়তো পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, ‘এতিমের মত ফিরে যাচ্ছে ৫০ বিলিয়ন ডলার’। খবরটিতে বলা হয়, সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে ৫০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার বা ৪ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার হুন্দাই ভেঞ্চার এসএনডি ইনকর্পোরেট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয়ার পর গত ১ মাসেও সরকারের বক্তব্য জানতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। উল্লেখ্য যে, দেশের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ বিনিয়োগ প্রস্তাব। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের যোগাযোগ, সেতু, রেলওয়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটনসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে বিনিয়োগের প্রস্তাবটি দিয়েছিল মালয়েশিয়ার হুন্দাই ভেঞ্চার।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এবং বহির্বিশ্বের সাথে এখন সরকারের যে সম্পর্ক চলছে তা কোনো সচেতন নাগরিক মেনে নিতে পারে না। সরকার তো মুখে মুখে গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়নের কথা বলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কথা ও কাজে এমন গড়মিলের কারণে দেশে-বিদেশে আস্থার সংকটে পড়েছে সরকার। ফলে দেশের সমস্যা সমাধানে যেমন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তেমনি বহির্বিশ্বের সাথেও সম্পর্কের টানাপড়েন মিটাতে পারছে না সরকার। এমন অবস্থায় দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে জনগণের দুর্ভোগের মাত্রা। আমরা জানি, দেশ এবং জনগণের কল্যাণ ও অগ্রগতির জন্যই তো গঠিত হয় সরকার। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর সে কথা সব সময় সবার মনে থাকে না। সংবাদপত্রের দায়িত্ব সে কথা মনে করিয়ে দেয়া। সরকার এখন দায়িত্বের কথা উপলব্ধি করে কাজ করলে দেশ ও জনগণের মঙ্গল। কিন্তু সরকার যেভাবে দমন-পীড়নে মত্ত হয়ে উঠেছে এবং বিরোধীদলও উত্তপ্ত হয়ে আছে তাতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা ও সহিংসতা সহসা দূর হবে বলে তো মনে হয় না। বিশেষত যখন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে বিএনপির সব নেতাকে জেলে পাঠানো হবে, তখন তো আর আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। তাই জনমনে এখন একটাই প্রশ্ন, সরকার দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান? 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads