রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

মহাজাগরণ : ৫৬ হাজার বর্গমাইলের


নতুন এক বাংলাদেশ দেখল বিশ্ব। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া সব একাকার করে দেবেন বলে রাজনীতিবিদেরা সস্তা বুলি আওড়ান। প্রকৃত অর্থে সেটা কী জিনিস, কখনো তারা দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি। আলেম-ওলামা যাদের ভিত্তি এ দেশের মাটির সাধারণ মানুষকে নিয়ে সেটা তারা দেখালেন। কেঁপে উঠেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। তার এক টুকরো প্রজ্ব¡লন দেখা গেল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে। মানুষের মহাসাগরে পরিণত হয় পাঁচ বর্গমাইল এলাকা। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ছেলেখেলা মনে করে যে পুলিশ আনন্দের আতিশয্যে রাইফেলের বোতাম টিপে সুখ অনুভব করেছে, তারা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। লাখ লাখ জনতার সীমাহীন স্রোত বিস্মিত চোখে উপভোগ করল। তারা এই বার্তা গ্রহণ করলে মঙ্গল যে, গুটিকয় অপরিণামদর্শী নাদানের হম্বিতম্বিতে ১৬ কোটি বাংলাদেশী দমে যাবে না।

আমাদের জাতীয় পরিচিতির আসল চিত্রটি বেরিয়ে এসেছিল মতিঝিলে। মঙ্গলপ্রদীপ নয়, রাখিবন্ধন নয়, নারী-পুরুষের অবাধ শরীরী একাকার হয়ে যাওয়া নয়, সেটা নিরেট একজন বাংলাদেশী হয়ে ওঠার চিত্র ছিল। আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক লালসবুজের অসংখ্য পতাকা উড়েছিল অনেক উঁচুতে। এই পাতাকা জানান দিচ্ছিল দেশের সার্বভৌমত্বের সাথে কোনো আপস নেই। মুখে ছিল সেই দৃপ্তশপথ। মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের। উগ্র প্রচারণা চালানো হয়েছে জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হচ্ছে বলে। মুসলিমদের অন্যতম ভূষণ দাড়ি-টুপি নিয়ে সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব দিয়েছেন আলেমরা। মাথায় টুপি পায়জামা পাঞ্জাবি কিনশেভ লাখো মানুষ ছিলেন তাদের দিকনির্দেশনায়। এরা ধার্মিক হলেও টুপি পাঞ্জাবি নিয়মিত পরেন না। তারা সম্ভবত জানান দিতে চাচ্ছিলেন এই পোশাকগুলোর সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই। ছিলেন থুরথুরে বুড়ো। আহ্বায়ক আল্লামা শফী নিজেই বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। বক্তৃতা করার যথেষ্ট শক্তি নেই তার। জাতির যত সব কাণ্ডারি ‘জাতীয় নেতা’ অভিভাবকের দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে বন্দুকের নলপ্রিয় শাসকের প্রতি যখন অনুগত বা ভীতসন্ত্রস্ত সেই দুঃসময়ে নুইয়ে পড়া শরীর নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। শিশুরাও এসেছে দেশরক্ষায়। তবে তাদের কাউকে ‘জবাই কর’ স্লেøাগান দিতে দেখা যায়নি মিডিয়ায়।
তরুণ প্রজন্ম এ মহাজাগরণের প্রাণ। এদের সাথে কথিত গণজাগরণের ‘তরুণ প্রজন্মের’ মহাসাগরসম পার্থক্য। এদের কেউ পাঁচতারকা হোটেলে রাজকীয় আপ্যায়নের সুযোগ পাননি। ঢাকায় তাদের একটু বিশ্রামের জায়গা না থাকলেও হোটেল রূপসী বাংলায় মাসখানেকের জন্য সিট বুকিং দেয়া হয়নি কারো পক্ষ থেকে। দুপুর হওয়ার আগেই তাদের জন্য বিরিয়ানি নিয়ে আসেনি কোনো মতলববাজ। তবে তারা আপ্যায়িত হয়েছেন নিখাদ ভালোবাসায়। তার আগে তাদের হিমালয় ডিঙিয়ে, কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। পথে মোকাবেলা করতে হয়েছে রামদা-কিরিচওয়ালা সন্ত্রাসীদের। তাদের গাড়ি ভেঙেচুরে দেয়া হয়েছে। কেড়ে নিয়ে গেছে ড্রাইভারকে গাড়ির চাবিসহ। পায়ে দলে তারা মাইলের পর মাইল পেছনে ফেলে এগিয়েছেন। ঢাকায় বাংলাদেশবিদ্বেষী কয়েকটি সরকারি সংগঠন কিছু উৎপাতকারী লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের ওপর হামলার জন্য অপেক্ষ করছিল। প্রাণের ভয়ে এ তরুণেরা কেউ ভীত হননি। শক্তিশালী তারুণ্য লাঠিসোঁটাওয়ালাদের ম্লান করে দিয়ে সামনে এগিয়েছেন। এত সব বাধা মাড়িয়ে বীরের বেশে যখন তারা মতিঝিলে ঢুকছিলেন তাদের জন্য অনেকেই অকৃত্রিম মেহমানদারি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কেউ শরবত, কেউ গ্রীষ্মের তাপদাহ নিবরাণকারী তরমুজ খাইয়ে তাদের বরণ করেছেন। অনেকে পকেটের সব টাকা দিয়ে যে কয়জনকে পেরেছেন ুধা নিবারণ করিয়েছেন। অনেকে নিয়ে এসেছেন স্যালাইনসহ প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধপত্র। পানির বোতল বিস্কিট নিয়ে অনেকে ঘুরেছেন এ প্রজন্মকে খাওয়ানোর জন্য। দিনমজুর, গার্মেন্টস কর্মী, রিকশাওয়ালাসহ সর্বস্তরের জনগণ তাদের ন্যূনতম সামর্থ্য দিয়ে এ লড়াকু তরুণ প্রজন্মকে আপ্যায়িত করার চেষ্টা করেছেন।
শাহবাগে তরুণ-তরুণীদের পুলিশ পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা দিয়েছে। তাদের জন্য অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে দেশের সর্ববৃহৎ দু’টি হাসপাতালের চিকিৎসা। অন্য দিকে বাধা উপেক্ষা করে যে তরুণ রাতে জড়ো হয়েছিলেন মতিঝিলে তাদের ওপর মারমার কাটকাট আক্রোশ দেখিয়েছে সরকারের পুলিশ। রাতে একটু ঠাঁই নেয়ার জায়গা ছিল না ঢাকায় তাদের। পুলিশ যখন উদ্ধত হয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছিল এ তরুণেরা রুখে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ তাদের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। এক দেশে শাসকশ্রেণীর দুই আচরণ। শাহবাগে সৃষ্ট ফ্যাসিবাদ দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল। তাদের নির্দেশে সারা দেশে অসংখ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়েছে। অনেক নিরীহ মানুষের ওপর অক্রমণ করা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের সৃষ্ট উন্মাদনা অনেকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ধর্মদ্রোহীদের পাশাপাশি রাজাকার, খুনি ও নিষিদ্ধ সংগঠনের অনেকে শাহবাগে সংগঠিত হয়েছে। যারা এদের চরিত্র উন্মোচন করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কায়দায় হুমকি দেয়া হয়েছে। শাহবাগের মঞ্চকে ব্যবহার করে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলেছে। পুলিশ এসব সন্ত্রাসীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।
এর বিপরীত চিত্র জাতি দেখেছে মতিঝিলে। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারণা চালিয়েছে মিডিয়া। মিডিয়ার একটি বড় অংশ এত দিন একটি ছায়ার (জামায়াত-শিবির) বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ চালাচ্ছে। টকশোওয়ালারা নির্লজ্জভাবে সরকারসমর্থক উগ্র সাম্প্রদায়িকদের হাজির করছেন শোতে। উপস্থাপকের সামনে হাজির হওয়া চিহ্নিত পরজীবীর পাশাপাশি লাইভ হাজির করছেন আরো অনেককে। এরা নামে ভিন্ন হলেও সবাই একই সঙ্কীর্ণ আদর্শের। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, তাণ্ডব ও সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আনছেন তাদের কারো সাথে একটি কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। এটার নাম ‘বাংলাদেশী ওউন ফরম্যাটেড এক্সকুসিভ জার্নালি(পার্টি)জম’ দেয়া যেতে পারে। হেফাজতকেও তারা হাওয়া করে দিতে চেয়েছে। তাই বলে মতিঝিলের মঞ্চ থেকে কেউ মিডিয়া উড়িয়ে দেয়া, সম্পাদককে খতম করার হুমকি দেয়নি। তারা বিচার চেয়েছে। মবলিঞ্চিং দাবি করেনি। অর্থাৎ সাক্ষীসাবুদ ও প্রমাণসাপেক্ষে যতটুকু অপরাধ ততটুকু শাস্তি চেয়েছে। এটিকে শাহবাগের ুদ্র গোষ্ঠীটি দাবি করছে ধর্মীয় উন্মাদনা বলে। বিচার চাওয়া যদি ধর্মীয় উন্মাদনা হয় তাহলে ‘ফাঁসি চাওয়া’, ‘জবাই করা’র দাবি কী হতে পারে?
মতিঝিল মঞ্চ থেকে দিনভর দৃপ্তশপথের উচ্চকিত ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। আত্মবিশ্বাস ও নিখাদ দেশপ্রেম সেই গগনবিদারী ধ্বনি জাদুর মতো চার দিকে ছড়িয়েছে। ছিল না উগ্রসন্ত্রাসী কোনো আস্ফালন; ছিল না সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্লোগান। তারা ছড়িয়েছে সাম্যের বার্তা; বলেছে খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম কারো প্রতি নেই ঘৃণা। লালবাগের যে মাদরাসা থেকে আল্লামা শফী জাগরণের প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে এসছেন সেই মাদরাসার পাশেই রয়েছে মন্দির। ঐতিহ্যবাহী মাদরাসাটির পরিচালক মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনী সব সময় এ মন্দিরের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত যতœবান। হাটহাজারীর মাদরাসার পাশে রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় আবাস। সন্ত্রাসী দখলদারদের বিরুদ্ধে মাওলানা শফী তাদের বড় আশ্রয়স্থল। সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ হামলার সাথে এদের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক কেউ কখনো বাংলাদেশে দেখাতে পারেনি। ওলামা-মাশায়েখদের এ সমাবেশের মূল স্পিরিট তাই অসাম্প্রদায়িক।
অত্যাচার নিপীড়ন ফ্যাসিবাদ থেকে জাতিকে রক্ষা করতে লংমার্চ মহাজাগরণ তৈরি করেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। তার সুস্পষ্ট স্পন্ধন ১৬ কোটি মানুষ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহজুড়ে দেখেছে। এই স্পন্দনের তরঙ্গ শহর নগর বন্দরকে আলোড়িত করেছে। ভীত হয়ে শাসকগোষ্ঠী মহাজাগরণ স্তব্ধ করার সব চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ করে, ফেরি চলাচল বন্ধ করে, সন্ত্রাসী দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে তা রুখে দিতে পারেনি। এমনকি সরকারই হরতাল করার রেকর্ড সৃষ্টি করল দ্বিতীয়বারের মতো। শুক্রবারের পবিত্রতার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ জড়িত। শেকড়ছাড়া সমাজবিচ্ছিন্ন কিছু পরজীবীকে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম এই দিন হরতালে ডাক দিতে শাসকশ্রেণীর দিল একবারের জন্যও কাঁপেনি।
‘হি ইজ মাই সার্ভেন্ট’ গল্পটি সবার জানা। গ্রাম থেকে পায়জামা পাঞ্জাবি পরা বাবা গিয়েছেন শহুরে পড়ুয়া ছেলের কাছে। বাবার বেশভূষা নতুন করে সাহেব হওয়া ছেলের কাছে সেকেলে ঠেকছে। ছেলে বন্ধুদের কাছে বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। একটা উপায় বের করলেন বন্ধুদের কাছে বাবার পরিচয় দেবেন ইংরেজিতে। যারাই আসছেন জিজ্ঞেস করতেই জানিয়ে দিলেন ‘হি ইজ মাই সার্ভেন্ট’। বাবা স্কুল মাস্টার কামাল উদ্দিনের কাছ থেকে ঠিকই জেনে নিয়েছিলেন ইংরেজি বাক্যটির অর্থ। রক্ত-মাংস পানি করা কৃষি উপার্জন দিয়ে মানুষ করা ছেলের এ মূল্যায়ন নিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন। শহুরে একটি শ্রেণীর জন্ম নিয়ে প্রতীকী এ গল্পটির মধ্যে রয়েছে জাতির পচন ধরানোর জন্মের ইতিহাস। এখন এরা তৃতীয় প্রজন্মে আছেন। তারা বাবাকে স্বীকার না করলেও ছেলেকে নিয়ে উচ্চ আশাবাদী। ছেলের সাহেবজাদা নামজাদা ভাব দেখতে চান তারা। শেকড় হারিয়ে এরা ইউরোপীয় আধা ধর্মীয় সংস্কৃতিতে মিশতে না পারলেও মূর্তিপূজকদের মনে করছেন আদর্শ। মঙ্গলপ্রদীপের মধ্যে তারা প্রগতিবাদিতা দেখলেও তারা দেখতে পায় না মঙ্গল প্রদীপওয়ালাদের দেবদেবী মন্দির ভক্তিকে। এদের কেউ কেউ এখন এসেছেন চেম্বারের নেতৃত্বে। কেউ কেউ গরম করছেন শাহবাগ।
এরা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংরক্ষিত কিছু এলাকাকে কব্জা করে জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে চাচ্ছে। সংখ্যাগুরু মানুষের বোধ বিশ্বাস ও ধর্মকে এরা জঙ্গিবাদী কর্মকা  বলে পরিচয় করানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের ব্যবহার করছে, প্রণোদনা দিচ্ছে আঞ্চলিক আধিপত্যাবাদী শক্তি। একশ্রেণীর মিডিয়া গড়ে উঠেছে যেগুলোকে অবলম্বন করে জাতির ঘাড়ে চেপে বসার জন্য তারা জন্ম দিচ্ছে ফ্যাসিবাদের। শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এদের আন্তর্জাতিক আনুকূল্য এবং মিডিয়া ফ্রেন্ডলি অবস্থানকে গ্রহণ করতে চাইছে পুঁজি হিসেবে, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি করছে চরম ক্ষোভ। এ ক্ষোভ মানুষের মনে অনেক দিন ধরে সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষোভকে উত্তরণের পথ করে দিতে পারেনি দেশের রাজনৈতিক শক্তি। এখন এগিয়ে এসেছেন দেশের মাটি ও মানুষের আস্থাভাজন আলেম-ওলামারা। তাদের আহ্বানে সত্যিই জেগে উঠেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। এক বর্গমাইলের শাহবাগের আরোপিত ‘গণজাগরণের’ সাথে এর তুলনা করাটা কখনো ঠিক হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads