শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৩

গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে কারো কল্যাণ হয় না


দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে গ্রেফতার করা হয়েছে। কারওয়ান বাজারে পত্রিকাটির কার্যালয় থেকে ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ, ধর্মীয় উসকানি দেয়া এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে স্কাইপ কথোপকথন আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার ঘটনায় তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করা হয়। ওই মামলাতেই সকালে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধ (আইসিটি) আইনের ৫৬ ও ৫৭ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১২৪, ১২৪ (এ), ১২০ (বি) ও ৫১১ ধারায় অভিযোগ আনা হবে বলে জানান তিনি। পুলিশ আমার দেশ অফিসের কোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিওফুটেজ এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কম্পিউটার ও নথিপত্র নিয়ে গেছে। ডিবি পুলিশ মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে চাইলে তিনি নফল নামাজের জন্য কয়েক মিনিট সময় এবং কিছু বই আর পোশাক নিতে চান। সে সময়ও দেয়া না হলে তিনি শুধু কুরআন শরিফ হাতে করে পুলিশের সাথে বের হয়ে যান। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে উসকানি দেয়ার অভিযোগেও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে শাহবাগ ও পল্টন থানায় পাঁচটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর আগে ২০১০ সালের ২ জুন মাহমুদুর রহমানকে পত্রিকার কার্যালয় থেকে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। পরে পুলিশি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে ওই দিনই একটি মামলা দায়ের এবং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই বছরের ১৯ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আদালত অবমাননার অভিযোগে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক মাসের কারাদণ্ড দেন। এ মামলায় তিনি সাত মাস কারাভোগ করে ২০১১ সালের ১৭ মার্চ মুক্তি পান।

দেশের বিরোধী মতের ধারক হিসেবে পরিচিত একটি প্রধান জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে গ্রেফতারের মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলো। যে অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের কথা বলা হলো সেটি বাংলাদেশে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। স্কাইপের কথোপকথন প্রথম প্রকাশ হয় লন্ডনের বিখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্ট পত্রিকায়। সেই সূত্র থেকে আমার দেশ এটি প্রকাশ করেছে বলে উল্লেখ করে। পরে এর দায় শিকার করে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তার পদ থেকে ইস্তফাও দিয়েছেন। এর পরও যদি গণমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশের ব্যাপারে সরকার সংুব্ধ হয়, তাহলে মামলা করার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর সরকারের আস্থা নষ্ট হলে সাধারণ আদালতেও মামলা করতে পারে। কিন্তু এ জন্য একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে তার অফিস থেকে এভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া কোনো যুক্তিসিদ্ধ কাজ হতে পারে না। এর মাধ্যমে সরকার ভিন্ন মত ও গণমাধ্যমের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। যে পত্রিকাটি সরকার একবার বন্ধ করে দেয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনায় প্রকাশ হচ্ছে, সেটির সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার করা পত্রিকার প্রকাশনা ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই হয়েছে বলে মনে হয়। এটি কোনো গণতান্ত্রিক ও সভ্যসমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের একটি দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এখানে আইনের প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগের অবারিত সুযোগ থাকে সরকারের জন্য। এই সুযোগের অপব্যবহার করে নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা বিঘিœত করার ঘটনা বারবার ঘটছে দেশে। এটি যেকোনো সভ্যসমাজকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একই সাথে এতে বহু মত ধারণের গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য লোপ পেয়ে একনায়কতান্ত্রিক দুঃশাসনের সূচনা ঘটতে পারে।
আমরা মনে করি, দেশের একটি শীর্র্ষ দৈনিকের সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার দেশের স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য হুমকি এবং রাষ্ট্রের জন্য একটি অশুভ পদক্ষেপ। এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থেকে সরকারের উচিত মুক্ত ও দায়িত্বশীল মত প্রকাশের সুযোগের সামনে সৃষ্টি হওয়া সব বাধা তুলে নেয়া। আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি আইনের স্বাভাবিক নিয়মে আদালতে চলতে পারে। কিন্তু তাকে কোনোভাবেই কারারুদ্ধ করে রাখা সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবি জানাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads