বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৩

বাংলাদেশ কখনো জঙ্গিরাষ্ট্র হবে না


সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন ও কিছু নাস্তিকের ফাঁসির দাবিতে ঢাকা অভিমুখে এক ঐতিহাসিক লংমার্চ করল হেফাজতে ইসলাম। হাজারো বাধাবিপত্তির পাহাড় ডিঙিয়ে ৬ এপ্রিল মতিঝিল শাপলা চত্বরকে কেন্দ্র করে লংমার্চ করে এসে সমবেত হয়েছিল লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ দ্বীনদার মুসলমান-আশেকে রাসূল। বিশ্লেষকেরা হয়রান হয়ে যাচ্ছেন সমাবেশে কী পরিমাণ লোক হয়েছিল তা নির্ধারণ করতে। ভাড়া করা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এত লোকের সমাবেশ আর কবে হয়েছিল তার হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাংবাদিক মহল। এ দিকে টিকাটুলী পার-এ দিকে কাকরাইল- মধ্যে সব প্রধান সড়ক ও গলিপথ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। ঢাকার ইতিহাসে এর আগে এত বিশাল এলাকাজুড়ে জনসমাবেশ আর কখনো হয়েছিল কি না তা নিয়েও বেশ সংশয় আছে। আর দশটা সমাবেশকে যদি বলা হয় গণজোয়ার, তাহলে অভিধানে নতুন শব্দ সংযোজন করে এই লংমার্চের সমাবেশকে বলতে হয় ‘গণসুনামি’। আর দশটা জনসমাবেশ যদি জনসমুদ্রে পরিণত হয়, তাহলে এই সমাবেশ জনমহাসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। গুটিকয়েক লোকের উপস্থিতি যদি হয় গণজাগরণ, তাহলে এটা ছিল গণবিস্ফোরণ।

লংমার্চ ঠেকাতে হাজারো বাধার পাহাড় তৈরি হয়েছিল। নাস্তিকদের সহযোগী মিডিয়া লংমার্চের বিরোধিতা করে বিভিন্ন বিষোদগার সংবাদ পরিবেশন করছিল আগে থেকেই। সরকার লংমার্চ ও সমাবেশের অনুমতি প্রদান করে এবং বাধা প্রদান করা হবে না বলেও আশ্বাস প্রদান করে। তা সত্ত্বেও লংমার্চ প্রতিহত করতে ঘাদানিক ৫ তারিখ শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৬ তারিখ শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেয়। অন্য দিকে গণজাগরণ মঞ্চ ৫ তারিখ শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৬ তারিখ শনিবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২২ ঘণ্টার অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করে। যারা হরতাল ও অবরোধের ডাক দেয় তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত। সুতরাং খোদ সরকারই লংমার্চ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এ কথা জোর গলায় বলা যায়। কেননা শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকামুখী সারা দেশের সব যানবাহন বাস-ট্রাক-লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়। লংমার্চ ঠেকাতে পথে পথে বাধা দেয়া হয়। শুক্রবার রাতে হঠাৎ করে ঢাকামুখী ট্রেনগুলো বন্ধ করে দেয় রেল কর্তৃপ। সরকারের প থেকে বলা হয় নাশকতার আশঙ্কায় তারা এ কাজটি করেছে। নাশকতা নাকি লংমার্চ ঠেকানো উদ্দেশ্য? তা না হলে গত দেড় মাসে দেশের অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতেও ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়নি। এমনকি ট্রেনে আগুন লাগলেও। শুধু অগ্নিদগ্ধ বগি বাদ দিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। এত বাধার পরও শুধু ঢাকা নয়, গোটা বিশ্ব দেখেছে শুভ্র ফেনিল গণসুনামি। যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই শুধু সাদা মানুষের তরঙ্গ। এত বিশাল এলাকাজুড়ে মহাসমাবেশ- একজন মানুষের পে গোটা সমাবেশ একসাথে দেখা সম্ভব হয়নি। উঁচু ভবনের ওপর থেকে টেলিভিশন ক্যামেরায়ও সে দৃশ্য পুরোটা ধারণ করতে পারেনি। বিশিষ্ট কলামিস্ট ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘বাধার কারণে মাত্র ১০ ভাগের একভাগ মানুষ এসেছে লংমার্চে’। তাতেই এ অবস্থা! যদি বাধা না দেয়া হতো তাহলে ঢাকায় সেদিন কী হতো!
সরকার নাশকতার ভয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। কারা করত নাশকতা? এসব সর্বশ্রদ্ধেয় আলেম? লংমার্চ ঘিরে আলেমসমাজের একতাবদ্ধ হওয়া ও তাদের ডাকে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়াকে নাশকতার আশঙ্কায় রূপ দেয়া জুজুবুড়ির ভয় দেখানোর প্রাচীন কল্পকাহিনীরই একটি অংশবিশেষমাত্র। আলেমসমাজ প্রমাণ করলেন, তারা জঙ্গি নন। মানবজমিন লংমার্চের খবর প্রকাশ করতে গিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লিখেছে, নতুন শক্তি। এই নতুন শক্তির শক্তিধর সর্বশ্রদ্ধেয় আলেমেদ্বীন আল্লামা আহমদ শফী সাহেব অহিংস সংগ্রাম করে প্রমাণ করলেন বাংলাদেশ কখনো জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত হবে না। এ দেশ পাকিস্তানও হবে না, আফগানিস্তানও হবে না। ওলি-আউলিয়ার এই বাংলাদেশ লাল-সবুজে ভরা ঈমানে উজ্জীবিত বাংলাদেশই থাকবে। পদে পদে পথে পথে এত বাধা দেয়া হয়েছে অথচ হেফাজতে ইসলাম তো কোথাও আগুন জ্বালায়নি, কোথাও ভাঙচুর করেনি। কোনো সংখ্যালঘুর বাড়ি ঘর ভাঙেনি। ভাঙচুর করেনি তাদের মন্দির। তারা কেউই লগি-বৈঠা নিয়ে লংমার্চে আসেনি। তাদের কারো হাতেই শাহবাগীদের মতো উদ্যত লাঠি-বাঁশ ছিল না। তাদের কারো হাতেই ছিল না চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল। ছিল না কোন পিস্তল, শর্টগান, ককটেল, গ্রেনেড। ছিল শুধু জায়নামাজ, তসবিহ, মিসওয়াক। তার পরও কি বলা হবে তারা জঙ্গি? তারা এ দেশকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান বানাতে চায়?
হেফাজতে ইসলাম বরাবরই বলে আসছে এটি অরাজনৈতিক সংগঠন। অথচ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল বলেছেন, আল্লামা শফী পাকিস্তানের গোয়েন্দো সংস্থা আইএসআইর টাকায় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। লংমার্চ প্রমাণ করেছে তারা কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে আন্দোলন করছেন না। তারা সরকারের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করছেন না। তারা শুধু ইসলাম রার আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
৬ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টায় (ক্যালেন্ডারের তারিখ তখন ৭ এপ্রিল) একুশে টিভিতে ‘একুশের রাত’ লাইভ টকশো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানের উপস্থাপনায় এতে অংশ নেন জাতীয় সংসদের পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা, গলাচিপা) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি ও সাংবাদিক মনির হায়দার। টকশোর বিষয়বস্তু ছিল ঐতিহাসিক লংমার্চ। গোলাম মাওলা রনি এমপি বলেন, হুজুরদের সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা রয়েছে তা ভুল। এ ধারণা পরিবর্তনের সময় এসেছে। সাংবাদিক মনির হায়দার বলেন, এত বাধা ও অবরোধের মুখে আলেমরা যে সুশৃঙ্খল লংমার্চ করেছেন তাতে তারা প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশ কখনোই জঙ্গিরাষ্ট্র হবে না। বরং যারা এ ধরনের কথা বলে, তারা মতলববাজ।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯৮ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন মুসলমান। বর্তমান মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই মুসলমান। যে দেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই অবস্থা, সে দেশে বসে কেউ আল্লাহর, তাঁর রাসূল সা: ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কটূক্তি ও কটা করবে আর ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা চুপ করে বসে থাকবে- এটা যারা ভাবে তারা খুবই ভুলের মধ্যে আছে। এ দেশের সদাজাগ্রত আলেমসমাজ ও দ্বীনদার মুসলমান সহিংসতা পরিহার করে আদর্শিক অহিংস সংগ্রামের মাধ্যমে তা প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। লংমার্চ আমাদের এ বার্তাটাই দিয়ে গেছে, যে আন্দোলন হৃদয়ের গভীর থেকে তৈরি হয়, তা রোখার মতা কোনো মানুষের নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads