শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

বন্দীদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো ও আমাদের সংবিধান


আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে কোনোরূপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না। সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনানুযায়ী ছাড়া জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না কিংবা কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে, এমন কাজ করা যাবে না। আইনসম্মত নিরপে আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতীত কাউকে কোনো ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না।’

আমরা সবাই জানি, একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, সে সংবিধান লঙ্ঘন করে পুলিশ কি কাউকে মারধর করার অধিকার রাখে? অথবা জেলখানার মধ্যে বন্দীদের শায়েস্তা করার জন্য যখন-তখন ডাণ্ডাবেড়ি কিংবা আড়ুয়া বেড়ি পরিয়ে রাখা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত বা আইনসম্মত? এ পর্যায়ে ডাণ্ডাবেড়ি কিংবা আড়ুয়া বেড়ি কী, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার।
বাংলাদেশের কারাগারে বন্দীদের শাস্তির জন্য ডাণ্ডাবেড়ি এবং আড়ুয়া বেড়ি নামে দু’টি লোহার যন্ত্রের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ডাণ্ডাবেড়ি হচ্ছে বন্দী বা বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তির পায়ে মোটা লোহার রিং পরিয়ে তাতে শিকল এঁটে তা ওই বন্দীর হাতে ধরিয়ে দেয়া। জেল কর্তৃপরে নির্দিষ্ট করে দেয়া সময় পর্যন্ত তাকে এটি পরে থাকতে হয়। ওঠা, বসা, হাঁটা, চলা, ঘুমোনোÑ সবই এ বেড়ি পরেই করতে হয় ওই বন্দীকে।
আর আড়ুয়া বেড়ি হচ্ছে যারা কর্তৃপরে দৃষ্টিতে অবাধ্য তাদের দু’পায়ে রিংয়ের সাথে একটি এক ফুট লম্বা লোহার রড লাগিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে বন্দী দু’পা একত্র করতে পারে না। তাকে হাঁটতে হয় দু’পা ফাঁক করে, ঘুমোতে হয় চিৎ হয়ে বা উপুড় হয়ে। এর নাম আড়ুয়া বেড়ি। প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন শাস্তির নামে, বিচারের নামে কী বর্বর নির্যাতন চলে মানুষের ওপর।
ডাণ্ডাবেড়ি এবং আড়ুয়া বেড়ি বিষয়ে আইনে কী বলা আছে? জেলের ভেতর কেউ অপরাধ করলে তার নিষ্পত্তির নিয়ম রয়েছে জেল কোডের ১৯ নম্বর অধ্যায়ে। এ অধ্যায়ের ৭০৮ নম্বর বিধান অনুযায়ী, জেলের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে জেল সুপারিনটেনডেন্ট ১১ ধরনের লঘু ও ১১ ধরনের গুরুতর শাস্তি দিতে পারেন। গুরুতর শাস্তির মধ্যে রয়েছে সব বন্দী থেকে আলাদা করে কাউকে সাত দিনের জন্য কোনো সেলে আটক রাখা, ৩০ দিনের জন্য ডাণ্ডাবেড়ি পরানো ইত্যাদি। অপরাধী সাব্যস্তকরণের কোনো সাবলীল নিয়ম নেই। কর্তার ইচ্ছায় এখানে কর্ম। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব যাকে অপরাধী মনে করবেন, তিনিই অপরাধী হবেন। আবার জেলের মধ্যে হাজার অপরাধ করলেও হয়তো অন্য কারো অপরাধ হবে না।
তবে জেল কোডের ৭০৮ নম্বর বিধান অনুযায়ী, বিচারাধীন আসামি বা রাজবন্দীদের এ ধরনের গুরুদণ্ড দেয়া যায় না। কারণ ৭০৮ নম্বর বিধানটি কেবল আদালতে সাজাপ্রাপ্তদের েেত্রই প্রযোজ্য। কিন্তু আমাদের সংবিধান যেখানে মানুষকে নির্মম ও বর্বরোচিত শাস্তিদানের বিপে সে েেত্র কিছু কিছু ক্যাটাগরির জেল বন্দীর হাতকড়া এবং ডাণ্ডাবেড়ি পরানো সম্পূর্ণরূপে সংবিধানবিরোধী।
জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কারাবন্দীদের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে অনুসৃত যে ন্যূনতম নীতিমালা তৈরি করেছে, সেখানকার ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোকে অমানবিক বলা হয়েছে। বাংলাদেশে কিন্তু স্রেফ বন্দীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্যও ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর অভিযোগও রয়েছে। সাধারণত একসাথে তিনটি মামলার আসামি হলে তাকে কোর্টে নেয়া হয় ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে। এখানেও আছে বৈষম্য। তিন মামলা কেন, ৩০ মামলার অভিযুক্ত বা অপরাধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বেশির ভাগ সময় ‘জামাই আদরে’ই আনা-নেয়া করা হয় কোর্টে। কারাগারেও জামাই আদরেই থাকেন তারা।
ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোনো একটির কোনোরকম ব্যত্যয় ঘটলেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যেকোনো জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সব জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে।’ ফরাসি দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রাঁন্স বলেছেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে।’ আমাদের বিচারব্যবস্থার বিদ্যমান চরম দুরবস্থায় উপর্যুক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য।
পৃথিবীতে এমন কোনো সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারণাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারিতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময়োপযোগী করে তোলার। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমাদের পুরো আইনব্যবস্থায় রয়েছে ব্রিটিশদের শঠতার ছোঁয়া। কারণ ব্রিটিশরা তাদের দুষ্কর্ম ঢাকতে আইনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে আইন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে তিনিই সর্বপ্রথম আইন ভঙ করেন। তার অধস্তন কর্মচারী জার্মান চিত্রশিল্পীর পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে স্বর্ণের দামে খরিদ করেছিলেন। আজকের আদালতে ব্যবহৃত ন্যায়বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে তিনিই প্রথম অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন তৈরি করেছিল শাসন শোষণের জন্য, দরিদ্র কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের জন্য কিংবা প্রজাকে কাছারিতে ধরে নিয়ে মারধর, হাত-পা বেঁধে আঁধার কুঠরিতে ফেলে রাখা, প্রজার স্ত্রী-কন্যাকে বন্ধক হিসেবে আটক রাখা, বিষয় সম্পত্তি ক্রোক এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য। ডাণ্ডাবেড়ির অমানবিকতা এখনো এর উত্তরাধিকার বহন করছে মাত্র।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপোয় থাকি; যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘উচ্চ আদালত ডাণ্ডাবেড়ি ও আড়ুয়া বেড়ি পরানো
নিষিদ্ধ করেছে’, সেদিন আমাদের সংবিধানের শাশ্বত বাণী বাস্তব রূপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads