শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৩

কিছুই বিশ্বাস হতে চায় না


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এখন টগবগিয়ে যা কিছু বলছেন, তার কোনো কিছুই বিশ্বাস হতে চায় না। অসত্য বলছেন, সেটা উল্লেখ করতেও কেমন সঙ্কোচ লাগে। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো অসত্য কথা বলতে পারেন, এটা আমাদের ধারণারও বাইরে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তেমন কথা বলবেন, সেটি ভাবা যায় না বা ভাবতে চাই না। কিন্তু এ সরকার আমাদের বিশ্বাসের জায়গাগুলো একে একে নষ্ট করে দিয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে আমি প্রাইম ব্যাংকের একটি এটিএম কার্ড নিয়েছিলাম। প্রাইম ব্যাংকে আমার কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। তাতে আমি এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্রেডিট নিতে পারতাম, সওদা করতে পারতাম, নগদ টাকা নিতে পারতাম। যখন আমি ওই ব্যাংককে জিজ্ঞেস করলাম, এক লাখ টাকা তুলে বা এ পরিমাণ স্বর্ণের গয়না কিনে যদি আমি আর আপনাদের টাকা ফেরত না দেই, তা হলে কী করবেন? তখন ওরা বললেন, আপনি যদি তা করেনই, তা হলে অবশ্যই টাকা ফেরত দেবেন, আমরা নিশ্চিত। ব্যাংকিং সিস্টেমে এ বিশ্বাস তখন আমাকে চমৎকৃত করেছিল। শুধু বিশ্বাসের ওপরে আমাকে তারা এক লাখ টাকা খরচ করতে দিয়েছেন। তারপর একাধিক ব্যাংক থেকে অনেকবারই আমাকে আরো বেশি অফার দিয়ে ফোন করেছে। তিন লাখ, পাঁচ লাখ, বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে খরচ, এসব। এর কোনো কো-লেটারালের প্রয়োজন হয়নি। বিশ্বাসের ওপর ব্যবসায়। আর এ ব্যবসায় এখন বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, এটিএম কার্ডÑ এগুলো এখন মানুষের হাতে হাতে; কিন্তু সবই বিশ্বাসের ওপর। আমি একবার মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। বিমানে এটা ওটা কেনব। ডলার নিতে চায় না। যারা ট্রলিতে করে পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে নিয়ে এলেন, তারা ডলার নিতে চাইছিলেন না। বললেন, ক্রেডিট কার্ড দেন। আমি বললাম, আমার ক্রেডিট কার্ড আন্তর্জাতিক নয়। তোমরা টাকা নেবে কিভাবে? বিমানের লোকটি বলল, টাকা কিভাবে নিতে হয় সে ব্যবস্থা আমরা করব। আপনি লোকাল ক্রেডিট কার্ডই দেন। সম্ভবত ১০০ ডলারের মতো পারফিউম, সিগারেট ইত্যাদি কিনেছিলাম। ভদ্রলোকও ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করে আমাকে রিসিট দিয়ে দিলেন। দেশে ফিরে আসার পর প্রাইম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাকে ফোন করল, স্যার মালয়েশিয়ান বিমানে আপনি কিছু কেনাকাটা করেছিলেন। ওরা বিল পাঠিয়ে দিয়েছে। আপনি কি দয়া করে টাকাটা পরিশোধ করবেন? আমি সাথে সাথে টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। এর সব কিছুই নির্ভর ছিল বিশ্বাসের ওপর। বিশ্বাসে মিলায় কেষ্ট, তর্কে বহু দূর। আমরা বহু জায়গায় এখন বিশ্বাস করতে শিখেছি; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের কারো কথাই আমরা আর বিশ্বাস করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এরা সবাই যেন হায় হায়কোম্পানি। অনুজপ্রতিম যোগাযোগমন্ত্রী (্আমার সাথে তার জীবনে কোনো দিন কথা হয়নি) ওবায়দুল কাদের ছাড়া এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আর কোনো মন্ত্রীকে আসল সত্যটি বলেন বলে মনে হয়নি। তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কে যে কখন কোথায় কী বলেন, ধুলায় অন্ধকার। কোনো মন্ত্রী, কোনো উপদেষ্টা কখন যে কোথায় কী করেন, কী বলেন, সেটিও ধুলায় অন্ধকার। রেলের কালো বিড়াল-মন্ত্রী তো একেবারে সাফ্ফাং সাফ্ফা। এবং আশ্চর্য ঘটনা এই যে, দুর্নীতি দমন কমিশন বলে একটি সংস্থা আছে, তাদের কথা শুনলে মনে হয়, সরকারের দুর্নীতিবাজ লোকদের দুর্নীতিমুক্তবলে সার্টিফিকেট দেয়াই এ কমিশনের প্রধান কাজ। তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন ধারাবাহিকভাবে এমন সব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সম্ভাবনাই বাংলাদেশে নেই। এ কমিশনের আত্মঘাতী বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে এখন আর কেউ এর ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। রাখার কোনো কারণও নেই। এরা সরকারের এতটাই দালালে পরিণত হয়েছে যে, এদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আর কোনো উপায় নেই। এ অবস্থা তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে সরকারের মেয়াদ শেষে নির্বাচন কমিশনই কার্যত সরকারে পরিণত হয়। পুলিশ, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে তারা যেভাবে বলেন, সেভাবেই পরিচালিত হয়; কিন্তু এখন আমাদের দেশে যে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন রয়েছে, তারা সব কথাই বলে সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী। আবার একেক নির্বাচন কমিশনার একেক কথা বলেন। কেউ বলেন, নির্বাচন কবে হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেউ বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল না এলেও অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হলো, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এরা মেরুদণ্ডহীন। এ ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডহীন কথাটার অর্থ এই নয় যে, নির্বাচন কমিশনারের কোনো মেরুদণ্ড নেই। তা হলে তিনি হতেন একজন কেঁচো। তিনি মানুষ বটে, তার দায়িত্ব ও কর্তব্যে অটুট-অবিচল থেকে সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা থাকা উচিত। সেটি যখন থাকে না, তখন তাকে মেরুদণ্ডহীন বলে অভিহিত করা হয়। অথচ একজন নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের সামনে চেয়ার থেকে উঠে ঘুরেফিরে দেখালেন যে, তার মেরুদণ্ড আছে এবং মেরুদণ্ড শক্ত বলেই তিনি এ ষাটোর্ধ্ব বয়সেও কেমন দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন। এসব ভাঁড় এখন নির্বাচন কমিশনের সদস্য। আসলে এ সরকারের আমলে এ ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এরকম ভাঁড়েরা মনোনীত হয়েছেন। দুর্ভাগ্য এ দেশের জনগণের। তাদের এই ভাঁড়দের মশকরার মধ্যে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যসব মন্ত্রী এমন ভাষায় কথা বলেন, এমন বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রদর্শন করেন, তাতে তাদের বেশির ভাগকেই সম্ভবত এরকম ভাঁড় বলে অভিহিত করা যায়। সরকার বলছে, দেশ বিদ্যুতে সয়লাব হয়ে গেছে; কিন্তু দিনভর দুঃসহ লোডশেডিংয়ে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। প্রধানমন্ত্রী চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশ গ্যাসের ওপর ভাসতে থাকে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের সব গ্যাস শুকিয়ে যায়। সেই সাথে আল্লাহ তায়ালার দোহাই দিয়ে বলেছেন, তিনি জন বুঝে ধন দেন; কিন্তু মহান আল্লাহ যে তাকে ধন দেননি, সেটি জনগণ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন। দেশ যদি গ্যাসের ওপরই ভাসে তাহলে বাসায় বাসায় গ্যাসের এত সঙ্কট কেন? গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় ডেভেলপারদের কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে গেছে। বিদ্যুতের সংযোগও বন্ধ। এতই যদি গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকেন, তাহলে সংযোগ দিয়ে দিন। আর অবিরাম সরবরাহ নিশ্চিত করে দিন। তা তো আর হচ্ছে না। গত সোমবার দৈনিক দিনকালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেল, চট্টগ্রামে শিল্পোদ্যাক্তারা চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন। কারখানা তৈরি। গ্যাস দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। দুবছর ধরে সংযোগের অপেক্ষা। এ বিনিয়োগ তাদের অনেকে করেছিলেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। এখন তারা ঋণখেলাপি। কারখানা চালু হয়নি। উৎপাদন শুরু হয়নি। এসব কারখানার কোনো কোনো যন্ত্রপাতি এতই স্পর্শকাতর যে, বেশি দিন বন্ধ থাকলে এর সবই অচল হয়ে যাবে; কিন্তু সরকারের চাপা থামে না। তারা নিজেদের সাফল্যের ফিরিস্তির বিলবোর্ড যেমন দিচ্ছে, তেমনি বিএনপির ব্যর্থতার কথাও বিলবোর্ডে প্রকাশ করছে। জনগণ বিলবোর্ড দেখে ভোট দেয় না। সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে তারা ভোট দেয়। কিন্তু কর্মকাণ্ডের বড় বেহাল দশা। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খুন, গুম, সরকারের নীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সরকার যা বলে, তার মধ্যে হয়তো কোনো সত্য আছে; কিন্তু আমার মতো সাধারণ মানুষেরা তা বিশ্বাস করতে চায় না, বিশ্বাস করতে পারে না। আমি তো সাদা চোখে দেখতে পাই, এ সরকার একটি লুটেরা সরকার। এ সরকার আফগানিস্তানের বাচ্চায়ে সকাবের সরকার। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে বইটি যারা পড়েছেন, তারা জানেন বাচ্চায়ে সকাব কী? বাচ্চায়ে সকাব ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন। বাদশাহ আমানুল্লাহ আফগানিস্তানে একটি আধুনিক সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সে কারণে সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানে, গুণে পারদর্শী বিজ্ঞানীদের তার দেশে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার দেশের জনগণকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। ভারত থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সেখানে তিনি যে কী ভয়াবহ বিপদে পড়েছিলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দেশে-বিদেশে বইতে আছে। বাংলাদেশে এখন বোধ করি, বাচ্চায়ে সকাবের চেয়েও ভয়াবহ দুঃশাসন চলছে। কাকে যে বিশ্বাস করব, কী যে বিশ্বাস করব, কিছুই বুঝতে পারি না। এক দিকে শুনি প্রধানমন্ত্রী অসাধারণ ধর্মভীরু নারী। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে, কুরআন তিলাওয়াত করে তিনি তার দিন শুরু করেন; কিন্তু যখন তার ছেলে মাদরাসার শিক্ষার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন, তখন ভয় হয়। যখন মাদরাসায় বোমা বিস্ফোরিত হয় এবং সে আগুনের মধ্য থেকে তাজা গ্রেনেড উদ্ধারের কাহিনী প্রচার করা হয়, তখন তা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, এটা স্যাবোটাজ। এর ভেতর কোনো ষড়যন্ত্র আছে। বিস্ফোরণ ঘটল, আগুন ধরল, সেই আগুনের ভেতরে তাজা গ্রেনেড পাওয়া গেল, যা বহু আগেই বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ার কথা, তা তো হলো না। সরকার শেষ সময়ে এসে এমন সব নাটক তৈরি করছে, এমন সব বিচারের রায় ঘোষিত হচ্ছে, যার কোনো কিছুই এখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, বিশ্বাস হয় না। এ সরকার জনগণের বিশ্বাস ভেঙে ফেলেছে। যদি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ডাক শুনে কেউ না আসে, তা হলে সরকার ও নির্বাচন কমিশন একসাথে চলবে এবং আমরা তাদের সব কর্মকাণ্ড অবিশ্বাস করতে শুরু করব। আমরা বিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাস করতে পছন্দ করি। বিশ্বাসই আমাদের সম্বল। সরকার সব ক্ষেত্রেই আমাদের সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। এখন সরকারের কোনো কিছুই আর বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করা যায় না। তবে কি এ সরকার সেই অবিশ্বাসী রাখাল, যে কেবল বাঘ আসিয়াছে, বাঘ আসিয়াছে বলিয়া, চিৎকার করিত’, তারপর লোকজন জড়ো হয়ে যেত। অথচ বাঘ আসেনি; কিন্তু সত্যি সত্যি একদিন বাঘ এলো। সে দিন সে চিৎকারে আকাশ-বাতাস ফাটিয়েছিল; কিন্তু কোনো কৃষক এগিয়ে আসেনি। রাখালকে বাঘ খেয়েছিল। জয় বাংলা। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads