শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৩

সমঝোতা কি ‘হনুজ দূরওয়াস্ত’- আসলেও অসম্ভব?


শুরুটা একটু আগে থেকেই করতে হয়। তাই বলে বেশি পেছনে নিয়ে যাবো না পাঠকদের। মাত্র ক’দিন আগে উদযাপিত পবিত্র ঈদুল আজহার আগের ও পরের কথাই স্মরণ করে দেখুন। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানদের প্রধান একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও ঠিক এ সময়টিতেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা প্রচ- দমন-নির্যাতনের কবলে পড়েছেন। সরকার নির্বিচারে গ্রেফতার অভিযানও চালিয়েছে। এমন কোনো জেলা-উপজেলার নাম বলা যাবে না, যেখানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ধাওয়ার মুখে না পড়েছেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা-কর্মীকেই বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। খোদ রাজধানীতে ঢাকার সাবেক মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার দুটি বাসভবনে তল্লাশি চালিয়ে তাকে এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলকে সন্ত্রস্ত করা হয়েছে। নয়া পল্টনে অবস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে রেখেছে পুলিশ। অর্থাৎ সব মিলিয়েই সরকার ঈদের সময় এবার অতংকের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ঈদে আনন্দ করার পরিবেশও নস্যাৎ করেছে সরকার।
অন্তরালে যে উদ্দেশ্যই থেকে থাকুক না কেন, সরকার কিন্তু তাই বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে কিংবা তাদের মনোযোগকে অন্য কোনো দিকে সরিয়ে দিতে পারেনি। ঈদের ছুটিতে দেশের রাজনৈতিক সংকট ও সামনের অনিশ্চয়তা আলোচিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে। এরও কারণ ক্ষমতাসীনরাই তৈরি করেছিলেন। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী সংবিধান থেকে ‘এক চুলও’ নড়বেন না বলে ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন তারা। ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বলতে গেলে নষ্টই হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো আন্দোলনে যাওয়ার পরিবর্তে ঈদের প্রাক্কালে বারবার আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা যথারীতি সংবিধানের ‘হাই কোর্ট’ দেখিয়েছেন। বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ছাড়া যে কোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তার আগে বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দিতে হবে। কথাটার সঙ্গে অন্য একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন ‘কালো বিড়াল’ নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠা মন্ত্রী এবং সংবিধান বিষয়ক আওয়ামী মোড়ল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। তাছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারেও সংবিধানে স্পষ্টভাবেই বলা আছে। সুতরাং এ নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনে তারা যে বিরোধী দলকে ছাড়াই নির্বাচন করবেন সে কথাটাও যথেষ্ট ঔদ্ধত্যের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন মিস্টার সেনগুপ্ত। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ সময়ে কঠোর ভাষায় বিরোধী দলকে উস্কানি দিয়েছেন। বলে বেড়িয়েছেন, নির্বাচনে জিততে পারবে না জেনেই বিরোধী দল নাকি সংঘাতের উস্কানি দিচ্ছে এবং নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে! অসাংবিধানিক সরকারকে দিয়ে ভয় দেখাতেও ভুল হয়নি প্রধানমন্ত্রীর।
কৌশল হিসেরে হলেও ঈদের পর অবশ্য তাদের কার্যক্রমে দৃশত কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে বসেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবির পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নটিকেও সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে তিনি বলেছেন, নির্বাচনে যাতে কারো সন্দেহ না থাকে সেটা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চান। সে সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলেরও অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে। এজন্য বিরোধী দলের নেতার কাছে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নাম পাঠানোর জন্য প্রস্তাব পাঠাবেন তিনি। তবে প্রধানমন্ত্রী জানাননি, পরিকল্পিত ওই ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রধান কে হবেন এবং কিভাবে তাকে বাছাই বা মনোনীত করা হবে। মন্ত্রিসভায় কোন মাপকাঠিতে কোন দলের কতজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এতে বিরোধীদলকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বের কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে এ সম্পর্কেও নীরব থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সরকার কখন কিভাবে গঠন করা হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা থাকবে এবং সরকারের মেয়াদ কতদিন হবেÑ এসব বিষয়েও কোনো কথা পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য নির্বাচনের সময় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার (ক) ও (খ) উপ-দফার উল্লেখ করে বলেছেন, ২৫ অক্টোরর থেকে ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন যাতে ৯০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় সে জন্য তিনি সব দলের সঙ্গে, বিশেষ করে আওয়ামী মহাজোটের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দেবেন। এ বিষয়ে বিরোধী দলকেও পরামর্শ দেয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যেন প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন, প্রকাশ ঘটিয়েছেন সদিচ্ছারও। মনে হতে পারে যেন সব দলকে নিয়ে সরকার গঠন ও নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আসলেও উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে ভাষণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কিন্তু তেমন সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ, রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণটিরই ধারেকাছে যাননি প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দল আন্দোলন করছে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবিতে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের নামের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে বলে রেখেছেন, যে কোনো নামেই গঠন করা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় হতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। কিন্তু এ দুটি বিষয়েও ‘এক চুল’ পরিমাণ ছাড় দেননি প্রধানমন্ত্রী। পরিকল্পিত সরকারকে ‘সর্বদলীয়’ বলেছেন সত্য কিন্তু সে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার জন্য এমনভাবেই বিরোধীদলের কাছে নাম চেয়েছেন যা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সবই তার একার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। বড় কথা, প্রধানমন্ত্রী পদে তিনিই বহাল থাকবেন। অমন কোনো সরকারে বিরোধী দল যে অংশ নেবে না সে কথাটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীও জানেন। এজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী আদৌ চান না যে, বিরোধী দলকে নিয়ে সত্যিই তেমন কোনো ‘সর্বদলীয়’ সরকার তাকে গঠন করতে হোক। একথাই বরং পরিষ্কার হয়েছে, ‘সর্বদলীয়’ নামে যে সরকার তিনি গঠন করতে চাচ্ছেন সেটা আসলে হবে বর্তমান সরকারেরই অন্য রূপÑ সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসহ যার নেতৃত্বে শেখ হাাসিনা নিজেই থাকবেন।
ভাষণের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায়ও পরিষ্কার হয়েছে, রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আসলে ‘সর্বদলীয়’ নামে নিজেদেরই অন্য এক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চেয়েছেন। একই কারণে বিরোধী কোনো দলই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে স্বাগত জানায়নি। অনেকে সেই সাথে না বলে পারেননি যে, প্রধানমন্ত্রী আসলে সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেকটিই ঠুকে দিয়েছেন। ঠিক সে পর্যায়েই আরো একবার দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ২১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা পেশ করে বলেছেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। এই ১১ জনকে নির্বাচিত করার পন্থা সম্পর্কে খালেদা জিয়া বলেছেন, রাষ্ট্রপতি, স্পীকার এবং মহিলা এমপিদের যেভাবে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত করেন সেভাবেই তাদেরকেও নির্বাচিত করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রস্তাব নাকচ করলেও ক্ষমতাসীনদের উস্কানিমূলক বক্তব্যের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি ঘোষণা করেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে কারো বিরুদ্ধেই প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না। যারা তার নিজের এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তাদের সবাইকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। সরকারের প্রতি দাবি মেনে নেয়ার আহবান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, হিংসা ও শত্রুতা ভুলে এখন দরকার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া। এজন্য প্রথমে দরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের এই রূপরেখা দেশের সকল মহলেই ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়েছে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই তিনি দাবি জানিয়ে এসেছেন। আন্দোলনও করেছেন একই দাবি আদায়ের জন্য। সবশেষে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। জনগণের আশা ও ধারণা ছিল, ক্ষমতাসীনরা এই দাবি মেনে নেবেন এবং সে অনুযায়ী সংবিধানে সংশোধনী আনবেন। অন্যদিকে সরকার এগিয়েছে নিজেদের ছক অনুযায়ী, যার প্রকাশ ঘটেছে জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। ১৮ অক্টোবরের এই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এমন এক ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রস্তাব হাজির করেছেন, যে সরকার সংক্রান্ত বহু কিছুই ছিল অস্পষ্ট ও প্রশ্নসাপেক্ষ। বড়কথা, প্রস্তাবিত ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সে বিষয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রাখায় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি নিজেই বহাল থাকতে চান। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে ছাড় দিলেও বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যে কোনো নামেই গঠন করা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় হতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না।
এমন এক অবস্থায় সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে উঠছিল বলেই বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা পেশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে পরদিনই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তার চিঠি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদেও খালেদা জিয়ার রূপরেখা পেশ করা হয়েছে। ২৩ অক্টোবর পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে এটা পেশ করেছেন সাবেক স্পীকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। কিন্তু বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সমঝোতামুখী ও গণতন্ত্রসম্মত উদ্যোগ ও অবস্থান নেয়া হলেও ক্ষমতাসীনরা সে একই সংবিধানের দোহাই দিয়ে চলেছেন, যে সংবিধানকে তারা নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এমনভাবে সংশোধন করে রেখেছেন যাতে তারাই আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। এদিকে মুখে সমঝোতার কথা বললেও ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য যে অন্য রকম তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সরকারের অন্য কিছু পদক্ষেপে। যেমন দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হঠাৎ ২০ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করেছে। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা ও বগুড়াসহ দেশের প্রায় সব জেলা শহর ও মহানগরীতেই সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারও আগে ২১ অক্টোবর রাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে তার নিরাপত্তা রক্ষীদের মারধর করার এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সভাপতিকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়েও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, বিরোধী দল যতো নমনীয়তা ও সদিচ্ছাই দেখাক না কেন, সরকার সামান্যও ছাড় দেবে না। এমন বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়ার বিষয়টিকে সরকারের নতুন এক কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আর যা-ই হোক, সরকারের সদিচ্ছার এবং গণতন্ত্রসম্মত মনোভাবের অন্তত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বলা দরকার, ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব। কারণ, প্রতিটি প্রশ্নে নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সংবিধানের দোহাই তো দিচ্ছেনই, বিভিন্ন সময়ে নিজেদের দেয়া ঘোষণা থেকেও দিব্যি সরে এসেছেন তারা। উদাহরণ হিসেবে ২৫ অক্টোবরের কথা উল্লে¬খ করা যায়। তারিখটিকে প্রাধান্যে এনেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। বলেছিলেন, আগেরদিন অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এর পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও বলেছিলেন তিনি। তার সে ঘোষণার সূত্র ধরেই স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও ১২ সেপ্টেম্বর জানিয়েছিলেন, এবারের অধিবেশন চলবে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত। সেটাই হবে শেষ অধিবেশন। এরপর ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে পরবর্তী সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এরই মধ্যে সানাইয়ে নতুন সুর ধরেছেন ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের ডাকসাঁইটে নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী’ আগামী বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সংসদই বহাল থাকবে। তারপর সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে উদ্দেশ্য থেকেই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সংসদের চলতি অধিবেশনের মেয়াদ ২৪ অক্টোবর থেকে বাড়িয়ে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত করেছেন তারা।
আওয়ামী লীগের নেতারা তাই বলে কিন্তু ২৪ জানুয়ারির পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেননি। এসব কারণেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শুধু নয়, নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়েও গুরুতর সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ক্ষমতাসীনরা চাইলে ‘সংবিধানসম্মতভাবেই’ সংসদের মেয়াদকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু নয়, যে কোনো সময় পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা সংবিধানকে সেভাবেই সংশোধন করে রেখেছেন। তাছাড়া সংশোধিত সংবিধানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই রাখা হয়নি, জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতাও প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রেখেছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ‘পরামর্শ’ করে যে কোনো সময় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং যতোদিন ইচ্ছা তা বহাল রাখতে পারেন। ওই সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন, বহাল থাকবে বর্তমান সংসদও। তেমন অবস্থায় কতদিন পর্যন্ত দেশকে জরুরি অবস্থার মধ্যে রাখা এবং নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া যাবে এসব বিষয়ে সংবিধানে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। এর ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যতোদিন ইচ্ছা জরুরি অবস্থা বহাল রাখতে পারবেন। আর জরুরি অবস্থার অর্থ যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যথেচ্ছভাবে গ্রেফতার করা ও তাদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালানো সেকথা নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এভাবেই সংবিধানকে নিজেদের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার বানিয়ে রেখেছেন ক্ষমতাসীনরা। একই কারণে কথায় কথায় ভয়-ডরও দেখিয়ে চলেছেন তারা।
ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনাই শেষকথা হতে পারে কি না সে প্রশ্ন অবশ্য যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে। কারণ, মাঝখানে জনগণের পাশাপাশি রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত বিরোধী দল। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। তা সত্ত্বেও সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এভাবে রাজনৈতিক সংকটই শুধু আরো ঘনীভূত হবে না, সারাদেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়বেÑ যে ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশংকাজনক এবং জনগণের চিন্তা ও আশা-আকাঙক্ষার পরিপন্থী। এজন্যই সরকারের উচিত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া। সে প্রমাণ দিতে হলে ক্ষমতাসীনদের উচিত সময় একেবারে পেরিয়ে যাওয়ার আগেইÑ ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিরোধী দলের দাবি অনুয়ায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিধান যুক্ত করা। এ ব্যাপারে খালেদা জিয়ার উপস্থাপিত রূপরেখাকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সবশেষে বলা দরকার, সময় যেহেতু দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে সেহেতু প্রধানমন্ত্রীকেও উদ্যোগ নিতে হবে আজকালের মধ্যেই। না হলে সমঝোতা কিন্তু ‘দূরওয়াস্তÑ হনুজ দূরওয়াস্ত’ই থেকে যাবে, যার পরিণতি বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads