শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৩

বিবেকযন্ত্রণা ও দেশের রাজনীতি


আমি রাজনীতিবিদ নই, রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য নই, কোনো আগ্রহও ছিল না। তবে রাজনীতিবিদদের ভাষণ এবং সংবাদপত্রের কলাম মনোযোগ দিয়ে পড়তে অভ্যস্ত। আশির দশকে একটা সুযোগ এসেছিল। তখন আমি রূপালী ব্যাংকের আঞ্চলিক অফিস রাজশাহীতে কর্মরত। সে সময়ের এক মিটিংয়ে শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ইয়াংম্যান, জয়েন মাই পার্টি। তাকে কোনো জবাব দিতে পারিনি। শুধু একটু হাসি দিয়ে বলেছিলামÑ স্যার, চিন্তা করে বলব। প্রায়ই মনে পড়ে শেরেবাংলা ফজলুল হকের কথা যখন দেখি, বাংলাদেশের চার দিকে ব্যাংক লুটপাট, টেন্ডারবাজি, হলমার্কের দুর্নীতি, ডেসটিনির দুর্নীতি, শেয়ারবাজারের ধস, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, রেলওয়ের দুর্নীতি, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশৃঙ্খলা। রূপকথার গল্পের মতোই মনে হয় যখন শুনি, শেরেবাংলা যখন কোর্ট থেকে বের হয়ে আসতেন তখন যদি কোনো গরিব ছাত্র তাকে বলত, স্যার টাকার অভাবে ফি জমা না দিতে পারায় আমার আর পরীক্ষা দেয়া হবে না। তিনি কোনো চিন্তা না করেই ওই দিনের কোর্টে অর্জিত সব টাকাই দিয়ে দিতেন। কত বড় বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশের এই দুঃসময়ে তার মতো সৎ, কর্মঠ ও নিঃস্বার্থ মানুষের নেতৃত্বের বড় প্রয়োজন। বড় কষ্ট হয় আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ দেশের জন্য কিছুই করতে পারব না ভেবে। কেন এই অরাজকতা। কেন এত সব দুর্নীতি। তবে জনগণ জানে, দায়ী কারা? তারা সবাই অত্যধিক প্রতাপের অধিকারী। জনগণ খুব ভালোভাবেই জানে, তারা ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থনপুষ্ট। দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২৪ অক্টোবর সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। নতুন সরকার গঠনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে; কিন্তু মন্ত্রীবর্গ ও সরকারপ্রধানের কার্যকলাপ দেখে মানুষের মনে ভয়, সব কিছুই যেন পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। অনিশ্চয়তা চেপে বসেছে। জনগণের অবশ্যই স্মরণে আছে, আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে, তখন স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ারের ওপর ছোবল দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, শেয়ারের ব্যাপারটা বুঝি না; কিভাবে কী করে শেয়ারবাজারে ধস নেমে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারের মূল্য হঠাৎ করে পড়ে যায়। শেয়ারবাজারে অসৎ ব্যবসায়ী, ফড়িয়া ও সরকারি সমর্থনপুষ্ট লোকজন প্রতারণার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। এক সময় তারাই শেয়ার কেনার জন্য নিরীহ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে বলে, এই শেয়ারগুলোর মূল্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেড়ে যাবে। ধরে রাখতে পারলে প্রচুর মুনাফা। নিরীহ বিনিয়োগকারীর কোনো ধারণাই নেই, এই কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন, কী ধরনের ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিগত ও বর্তমান বছরের ছয় মাসে মুনাফার কী অবস্থা, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির কী পরিমাণ এবং তার বর্তমান বাজারমূল্য কত প্রভৃতির ওপর ওই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য নির্ভর করে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কখনো এসব বিষয় বিবেচনায় আনেন না। শেয়ারবাজারের অসৎ ও ফটকাবাজ এবং স্টক এক্সচেঞ্জের প্রশাসনযন্ত্রে যারা জড়িত তাদের অনেকে এ ধরনের অপকর্মে ইন্ধন জোগায় এবং নিজেদের আখের গোছায়। এ দিকে গণতন্ত্র আজ ভূলুণ্ঠিত। বাকস্বাধীনতা নেই। চলতে-ফিরতে নেই নিরাপত্তা। সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করা যায় না। করলে হয় নির্যাতিত কিংবা গুম হয়ে যেতে হবে। মানুষ কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিল? জনগণ কি এ জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছিল জীবনকে বিপন্ন করে? এই সরকার সমাজ ও দেশের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে। তাদের দাবি, তারাই একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে। শুধু তারাই এ দেশে থাকবে মনে হয়, এমনই চিন্তাধারা তাদের। সর্বক্ষেত্রে তাদের বল প্রয়োগ। যুদ্ধংদেহি মনোবৃত্তির ছত্রছায়ায় যত দিন পারা যায় ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী জনগণকে নৌকায় ভোট দানের জন্য অনুরোধ করছেন। তাদের আমলে যত উন্নয়ন হয়েছে অন্য কোনো আমলে নাকি তা হয়নি। সন্তু লারমার সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শান্তিচুক্তি করেছিলেন ১৯৯৭ সালে। কে এই সন্তু? এই চুক্তির পরও সেখানে গুম, হত্যা, অরাজকতা চলছে। নানাভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী উপজাতির মনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সরকার নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে। ভাবছি, ২৫ অক্টোবরের পরে পরিস্থিতি কী হবে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি ২০১৪-এর মধ্যে নির্বাচনের বিধান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ অক্টোবর থেকে ওই পদে থাকবেন কী করে? রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনার জন্য একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন। সব রাজনৈতিক দলের প্রধানের কাছে তা গ্রহণীয় হতে হবে। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন এবং সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে; কিন্তু মনে হচ্ছে, এসব সুদূরপরাহত। কেননা সংবিধান সংশোধন করার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা আপাতত নেই। প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, তিনি এক চুলও নড়বেন না। তার অন্তর্বর্তীসরকারের অধীনেই হবে নির্বাচন। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য শেখ হাসিনা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন। তখন হত্যা, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ ঘটেছিল। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে খালেদা জিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ নিজেদেরই আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দেশী-বিদেশী অনেক নেতা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও সংলাপের জন্য দুই নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। জনমনে আশঙ্কা, প্রিয় বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য কোন অজানা অন্ধকার গহ্বর ও সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা যার মুল্লুক তারÑ এটা তো সত্য হতে পারে না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, প্রখ্যাত আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদসহ আরো অনেকে সংলাপের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তার পরও কোনো সমাধান বের হয়ে আসেনি। এমন ব্যবস্থা করা হোক যাতে ১৬ কোটি মানুষের ইচ্ছা মোতাবেক তত্ত্বাবধায়কসরকারের অধীনে যথাসময়ে নির্বাচন করে দেশকে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এ দেশ কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এ দেশ জনগণের।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads