বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৩

আদৌ কি হবে ভোট?


প্রজাতন্ত্রের দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন একটি রুটিন কর্মসূচি। নির্বাচনে জনগণ ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের ভাল-মন্দের জবাব দেবেন এটাই নিয়ম হলেও বাংলাদেশের বহুল পরিচিত শিশু গণতন্ত্র এখন মুমূর্ষু! গণতান্ত্রিক দেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই তারপরও বাংলাদেশের নির্বাচন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে! আর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। এ কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে শংকিত দেশ-বিদেশের জনগণ। বাংলাদেশের শিশু গণতন্ত্রকে এতদিন ওরস্যালাইন দিয়ে টিকিয়ে রাখা গেলেও বর্তমান সময়ের সহিংস রাজনীতি ভয়াল থাবায় এ দেশের গণতন্ত্র এখন “নির্বাচন ক্লিনিকের” ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ ) গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা গণতন্ত্রের দ্রুত আরোগ্য লাভে নানা প্রেসক্রিপশন দিলেও সরকারের তরফ থেকে রুগ্ন গণতন্ত্রের উন্নয়নে আশু পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না বলে দেশের সংবাদপত্রগুলোতে লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা নানা মন্তব্য বিশ্লেষণ রূপরেখা উপস্থাপন করছেন! দেশের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা মোহের কারণে নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এ অনিশ্চয়তার জন্য সরকারের ক্ষতিই হবে বেশি! ২৫ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সংকট নিরসনে সরকারের উদ্যোগে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
গত ৪ দিনে দেশের রাজনীতিতে ৪ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ১ম দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় সর্বদলীয় সরকারের বাণী শুনালেও কয় সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে এবং বিএনপি আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রী কয়জন হবেন তা স্পষ্ট করেননি! এছাড়া নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন! এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না বললেও সংবাদ সম্মেলনের পরপরই টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে সরকারের উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলে দিয়েছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হবেন! এ যেন এক আমলে দু’সরকার বিচার মানি তাল গাছ আমার হলে! সংকট সমাধান হবে না, কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বক্ষমতার মালিক সরকার প্রধান। মন্ত্রীরা নামমাত্র সদস্য। তাই শেখ হাসিনা প্রধান হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের একদিন পর রাজধানী ঢাকায় সভা সমাবেশ, মানববন্ধন, মিছিলসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে সরকার সমালোচিত হয়েছে। এছাড়া সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে শেষ রক্ষা হয়নি কারণ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে দিনব্যাপী নানা নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত প্রশাসন অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। এই সমাবেশের প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্ট করে বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। সরকারবিরোধী আন্দোলনে কেউ যদি পাশে না-ও থাকেন খালেদা জিয়া একাই সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে শেখ হাসিনাও নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের পদটি ছাড়তে নারাজ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে হাতে পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ ৫ বছর পর নৈশভোজে দাওয়াত দিলেন। বেচারা এরশাদ সম্মান রক্ষার দাওয়াতে অংশগ্রহণ করলেও একদিন পরই প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, সৈয়দ আশরাফ যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে এরশাদের বৈঠকের পর জাতীয় পার্টি মহাসচিবকে পাশে রেখে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, জাতীয় পার্টি মহাজোটের সাথেই আছে, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জাতীয় পার্টি একক নির্বাচন করবে! এই নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয় কারণ এরশাদই কি তাহলে সরকারের বানানো পকেট বিরোধী দল হতে যাচ্ছে! সমালোচনার ঝড় ওঠার আগেই সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেই বলেছেন, সব দল অংশগ্রহণ না করলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না ফলে নির্বাচনকালীন সরকারের মহাজোটের প্রথম উদ্যোগ ভেস্তে গেল! জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মহাজোটের বড় শরীক হলেও পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় জর্জরিত গত কয়েক মাস থেকে সরকারের কড়া সমলোচক ছিলেন। একাধিকবার মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিলেও মামলা হামলার ভয়ে এতদিন তিনি মহাজোট ছাড়েননি। শেষমেষ ২৫ অক্টোবরের আগেই মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদের মান অভিমান ভাঙাতে পারেননি নৈশভোজনে দাওয়াত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী। ধর্মীয় অনুভূতির বাংলাদেশে বামনির্ভর বর্তমান আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কি সেটি প্রশ্নবোধক হয়ে আছে! যেখানে হেফাজত ইস্যুতে দেশের ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের পরাজয় হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, সেখানে ভোটারহীন বামরা কি সরকারের শেষ রক্ষা করতে পারবে? বর্তমান মহাজোট সরকারের দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অনেক অবদান থাকলেও, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় তথা বিভিন্ন পদক্ষেপে দেশের জনগণ ক্ষেপে উঠেছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের উন্নয়ন জনগণের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধির কারণে জনগণ অতিষ্ঠ। এছাড়া নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের সেবা খাত গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে জনগণ অতিষ্ঠ হয়েছে বারবার। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় সরকারের শেষ মুহূর্তে প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ কর্মকর্তা আমলারা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। ২৪ অক্টোবর পিছিয়ে ডেডলাইন এখন ২৫ অক্টোবর। তাই সরকারের ঘনিষ্ঠ সচিবরা স্বস্তিতে নেই! সচিবদের অধিকাংশই মনে করেন, অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বর্তমান মহাজোট সরকারের ক্ষমতার পরিবর্তন হবে এ কারণে সরকারের ঘনিষ্ঠ সচিবরা যারা দলীয় পরিচয়ে পদোন্নতি ও নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তারা ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভিসার টিকিট ওকে দিয়ে রেখেছেন বলে গুজব রটেছে। সচিবালয়ে এখন সরকারঘনিষ্ঠ সচিবদের চেয়ে বিএনপি ও জামায়াতঘনিষ্ঠ সচিব আমলারা আরামদায়ক অবস্থায় আছেন। এদিকে সরকারের শেষ সময়ে এসে সচিবালয়ে বিএনপিপন্থী আমলারা তৎপর হয়ে উঠেছেন। বর্তমান সরকারের সুবিধাবঞ্চিত আমলারা বিএনপিপন্থী আমলাদের সাথে যোগ দিচ্ছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার পাচ্ছে। ১৯ ও ২০ অক্টোবর ঢাকায় অবস্থানকালীন সময়ে সচিবালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে এমন অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। সরকারের শেষ মুহূর্ত প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে সচিবদের দৌড়ঝাঁপ সরকার পরিবর্তনের আলামত হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কি হবে ২৫ অক্টোবর-পরবর্তী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এই নিয়ে জনগণের আগ্রহ ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠারও কমতি নেই। এদিকে ২১ অক্টোবর  বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যারা আমার এবং আমার পরিবারের ওপর অত্যাচার করেছে আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম কারও প্রতি প্রতিশোধ নয় সবার প্রতি সহনশীলতা এবং মেধা ও মননের সরকার হবে ১৮ দলীয় জোট নির্বাচিত হলে। দলনিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোন নির্বাচনে অংশ নেবেন না। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া প্রস্তাব করেন বিগত দুটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৫ জন করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রী পরিষদ ও ১ জন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বকে প্রধান করে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আহ্বান জানান। দেশের মানুষ অবাধ দলনিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে সরকারের মান বিচারের অন্যতম মাধ্যম হলেও বাংলাদেশের নির্বাচন এখনও পুরোপুরি জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন ও গণতন্ত্র রক্ষার ধারাবাহিক প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠেনি। এই দেশের ভোটের রাজনীতির শিক্ষিত সমাজ সচেতন নাগরিকের চেয়ে অশিক্ষিত কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় তাদের কাছে নির্বাচন মানেই উৎসব। পাড়ায় পাড়ায় মিছিল সমাবেশ আর চায়ের দোকানের আড্ডায় কে ভাল কে খারাপ তার চেয়ে কার কত টাকা, কে কত বেশি টাকা দেবেন সেটাই বড়, এ কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই উৎসব। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এ কারণে অপার উৎসবে নির্বাচন এখন হতাশার কোমর পানিতে নিমজ্জিত। বাংলাদেশের মানুষ শান্তি চায়, তাই শান্তিপ্রিয় মানুষের আগ্রহের প্রতি সম্মান জানিয়ে সহিংস রাজনীতির পথ পরিহার করে গণতন্ত্র রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। গণতন্ত্র ও দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় অবাধ ও দলনিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads