শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৩

এই পুলিশ কি সেই পুলিশ?


মুমূর্ষু অবস্থায় ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার পাওয়া শিশু আদুরীকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন অনেকের মতো ঢাকার পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদও। তিনি খালি হাতে যাননি। চিকিৎসাধীন কোনো বন্ধুস্বজনকে দেখতে যাওয়ার মতো নানা ফলমূল নিয়েই গেছেন তিনি। আদুরীর দেহে নির্যাতনের দগদগে ক্ষত আর আঘাতের চিহ্ন দেখে তার প্রতিক্রিয়া এ তো শিউরে ওঠার মতো দৃশ্য!আদুরীকে আমি দেখিনি, তবু ঘটনার বর্ণনাতেই চোখে পানি এলো অজান্তেই। স্বর্গ নয়, সমাজ জীবনে স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টির পবিত্র চিন্তা থেকেই পুলিশ পেশায় উৎপত্তি। আজকের দিনে পুলিশবিহীন রাষ্ট্র যেমনি অসম্ভব, তেমনি অবাঞ্ছিত বিবেচিত হয় পুলিশি রাষ্ট্রও। সমাজের সব মানুষ বিবেক ও নৈতিক চেতনার তাঁবেদার হতো তাহলে আইন আদালত, পুলিশ, দুদক প্রভৃতি সংস্থার কোনো প্রয়োজনই থাকে না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল (আইন যখন নৈতিক ও মানবিক চেতনার সমার্থক) শান্তপ্রিয় মানুষের সমাজে টিকে থাকার জন্য পুলিশ তাই এক অপরিহার্য প্রয়োজন। পৌষের কনকনে শীতে কি শ্রাবণের ঘন বর্ষণমুখর রাতে আরামের বিছানায় শুয়ে পাশের রাস্তায় যখন পুলিশের উপস্থিতি টের পাই, তখন নিজেকে কেমন নিরাপদ ও শক্তিধরই মনে হয়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে হৃদয়-মন ভরে ওঠে, মনে হয় বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে তাদের অভিবাদন জানাই। বলা যেতে পারে ওটা চাকরি রক্ষার জন্যই শুধু, কিন্তু তা পূর্ণ সত্য নয়। ডাকাতের গুলিতে মরতে যাওয়া দুর্বৃত্তের টার্গেট হওয়ার মতো ঝুঁকি নেয়া কেবলই চাকরির খাতিরে এমনটি ভাবা কৃপণতা। কোটি মানুষকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে নির্বিঘেœ সুখনিদ্রায় সুবিধা করে দিয়ে যে পুলিশ নিজে শঙ্কা ও আতঙ্কের মাঝে নির্ঘুম রাত কাটায়, তাদের চেয়ে উত্তম বন্ধু আর কে হতে পারে? হ্যাঁ, এই অভিযোগ মিথ্যে নয় যে, প্রকৃত অবস্থা তার বিপরীত নয় শুধু দ্রুত অবনিতশীলও বটে। তস্কর অপেক্ষা সমাজের ভালো মানুষটিই এখন পুলিশ আতঙ্কেভোগে বেশি। সরকারি দলের কেউ নন এমন কারো বাড়ির গেটে পুলিশের গাড়ি থামা মানেই আতঙ্ক! আর রাতে হলে তো নিশ্চিত হতেই হয় গুম হয়ে গেলাম বুঝি!পক্ষান্তরে সরকারি দলের যেকোনো কাসের নেতাই হোন, হোন না কেন ডজন দু-তিন মামলার নিখোঁজ(?) আসামি তার দরজায় পুলিশের গাড়ি দেখামাত্র জনসাধারণের ধারণা জন্মে। নেতা কোনো অপারেশনে বেরোচ্ছেন বুঝি?’ বাংলাদেশের পুলিশ পেশাগত যোগ্যতা ও দক্ষতার উন্নত দেশের তুলনাও যে পিছিয়ে নেই সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে খোদ জাতিসঙ্ঘ। তবু তাদের বদনাম, জনগণের হৃদয় পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনটি যে একেবারেই নড়বড়ে এর কারণ এবং এর প্রতিকারই বা কী, কোনো সরকারই কোনো দিন তা ভাবেনি। কারণ সরকার যে-ই হোক তাদের অসৎ উদ্দেশ্যসাধনে পুলিশকে তারা সদা বলির পাঁঠার মতোই ব্যবহার করে আসছে। সুতরাং পুলিশ এখন গণবিচ্ছিন্ন একটি সংস্থাই নয়, শুধু বরং সরকারের পাপের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে সামাজিক জীবনেও এক বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার। ফার্মগেটে ছিনতাই হওয়া টাকাভর্তি ব্রিফকেস ঘণ্টা দুইয়ের মাথায় সায়েদাবাদ থেকে উদ্ধারে সক্ষম, ব্র্যাক ব্যাংক লকার, চট্টগ্রামে সোনার দোকানে ডাকাতির মতো হাজারো চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কৃতিত্বের অধিকারী যে পুলিশ সেই চৌকস ত্বরিৎকর্মা পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে দিল ইলিয়াস, সাগর-রুনি। হাতের মুঠোয় থাকা আসামিদের ধরতে আর কত ৪৮ ঘণ্টা দরকার? ব্যর্থতার এই দায় কেবলই পুলিশের? গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে, এমনকি প্রকাশ্যে রাস্তা বা যানবাহন থেকে অস্ত্র হাতে পুলিশি পোশাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেয়ার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। ভাগ্য ভালো হলে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় হাসপাতালের বেডে বা মর্গে। নিখোঁজের বেলায় সাফ কথা এ ধরনের কোনো অপারেশনে যায়নি আমাদের কোনো টিম। রাষ্ট্রের প্রতি কত বড় চ্যালেঞ্জ! পুলিশি পোশাক, পুলিশের মতো গাড়ি, সাক্ষ্য দিচ্ছে শতজন! প্রশাসনের ঘুম হারাম হওয়ার মতো ঘটনা নয় কি? পুলিশ হেফাজতে পঙ্গুত্ব এমনকি মৃত্যুর ঘটনা অবশ্যই নির্মমতার শিকার আদুরীদের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশিই হবে। পুলিশি নির্যাতন আরামদায়ক না হলে নির্যাতক হিসেবে উভয়ে মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? কারণে-অকারণে বা তুচ্ছ কারণে গ্রেফতার, রিমান্ডের আগে আর এক রিমান্ড, আইন হাতে নেয়া আইনের রক্ষকদের জন্যও বেআইনি নয় কী? ১৫ দিন থেকে এক মাস বা তারও বেশি সময়ের রিমান্ডের আবেদন থেকে কি প্রতীয়মান হয় না যে, রিমান্ড এখন নির্যাতনের নেশায় পরিণত? ডাণ্ডাবেড়িতে কি পুলিশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হয়? জজ মিয়া নাটক বা লিমন কাহিনী রচনাও কি পুলিশের কাজ? পলায়নপর জনতার মিছিলের পেছনে থেকে মাথার গুলি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নয় কেন? গোপনে থানা হেফাজতে শুধু নয়, প্রকাশ্য রাজপথে শত জনতা, আর ক্যামেরার সামনে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করাও কি আইন রক্ষকদের জন্য শোভনীয়? নির্যাতনে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রমোশন, ‘প্রেসিডেন্ট পদকএমন ঘোষণা কোনো জাতি শুনতে পেল খোদ মন্ত্রীর মুখেই তো। মানবতার আহ্বানে, বিবেকের টানে ডিএমপি কমিশনার নির্যাতিতা শিশু আদুরীর পাশে দাঁড়ানো আমাদের কাছে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। আমরা কি আশা করতে পারি এরপর পুলিশ হেফাজতে আর কেউ লাশ হবে না? নিরপরাধ এমনকি অপরাধীও পুলিশি নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করবে না? ধর্ষিতা হবে না কোনো অসহায় নারী? অথচ প্রশাসনের কুম্ভকর্ণ নিদ্রায় এতটুকু ব্যত্যয় ঘটে না, পরিলক্ষিত হয় না উৎকণ্ঠা বা তদন্ত তৎপরতাও। জাতির প্রত্যাশা পূরণে সবচেয়ে বড় অন্তরায় সরকার ও রাজনীতিএমনটি বলা কি খুব অসঙ্গত হবে? সততার কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ, আপসহীন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি বাহিনী হিসেবে পুলিশ পরিচিত হতে পারছে না কার অভিষাপে? রুটি রুজির জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল একটি বাহিনীর পক্ষে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব নয় অন্তত এ মুল্লুকে তা কি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? দুদক প্রধান বিদায়ের বেলায় বলে গেলেন তিনি ছিলেন দন্তনখরবিহীন বাঘ, পুলিশের অবস্থা কি তার চেয়ে ভালো? হল বা টেন্ডার দখলের মহড়ায় সশস্ত্র জঙ্গিদের পেছনে পেছনে তৃতীয় বাহিনীর মতো অসহায় পুলিশ(!) এর বেইজ্জতি আর কী হতে পারে? এহেন নাজুক ও পতিত অবস্থা থেকে পুলিশের উদ্ধারপ্রাপ্তি ঘটবে কবে? কবে সবিস্ময়ে বলা যাবে এই পুলিশ সেই পুলিশ নয়?


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads