সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

নিছক সংলাপ নয় কেয়ারটেকার ব্যবস্থার পুনর্বহাল লক্ষ্য


বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে একটা গল্প প্রচলিত আছে। এক ছেলে নতুন বিয়ে করেছে। শ্বশুর বাড়িতে আসে, কিন্তু লজ্জায় শ্বশুরের সাথে কথা বলে না। এ নিয়ে শ্বশুরের বড় দুঃখ, বিষয়টি ছেলের মা-বাপের কানে যায়। তারাও ঘটনা শুনে দুঃখ পান। ছেলের মা-বাপ আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে ছেলেকে শ্বশুরের সাথে কথা বলতে পরামর্শ দেন এবং কথা না বলা যে বেআদবী এবং ভদ্রজনোচিত নয় তাও তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। ছেলে কথা বলতে রাজী হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কি বলবে এবং কখন বলবে? বউ এর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলো যে, খাবার টেবিলেই কথা হবে। সময় এলো, শ্বশুর-জামাইসহ সবাই খাবার টেবিলে বসলেন। জামাই, তথা ছেলেটি সাহস করে শ্বশুরের পাশে গিয়ে বসলো এবং অত্যন্ত ন¤্রভাবে শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করলো, “আব্বা আপনি বিয়ে করেছেন?” তার প্রশ্ন শুনে খাবার টেবিলে বসা পরিবার সদস্যদের কি অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার ফোনালাপের বিস্তারিত শুনে গল্পটির কথা মনে পড়লো। তারা কেউ কারুর সাথে কথা বলেন না। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিন ধরে। এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থান-উত্তর নির্বাচনে ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি ক্ষমতায় যাবার পর থেকে বেগম জিয়া শেখ হাসিনার চক্ষুশূলে পরিণত হন। তিনি তাকে ব্যক্তিগত শত্রু হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেন। অবশ্য এর আগেও বেগম জিয়াকে শেখ হাসিনা যে সম্মান করে কথা বলতেন তা নয়। তার ধারণা জেনারেল জিয়া ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে হত্যা করেছেন এবং তার স্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া ঘৃণার পাত্রী। যদিও সারা দুনিয়া জানে যে, শেখ মুজিবের সহচর আওয়ামী লীগ নেতারাই দুঃশাসন, অত্যাচার-অবিচার, গণতন্ত্র হত্যা, দুর্নীতির প্রতিষ্ঠা এবং দেশে একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে হত্যা করেছিলেন।
পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন যে, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সরকারি আমলা ড. কামাল সিদ্দিকী ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে তার সচিব হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই একটি মাত্র কারণে এই মুক্তিযোদ্ধা ও মেধাবী কর্মকর্তা শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালের দিকে তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদর দফতর ম্যানিলাতে পোস্টিং পেয়েছিলেন এবং আমিও ঐ সময় লসভেনাসে ইউপিএলবিতে উচ্চ শিক্ষার্থে অবস্থান করছিলাম। আমরা প্রায়ই এডিবি সদর দফতরের রেস্তোরাঁয় খেতাম এবং গল্পগুজব করতাম। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে সারা বাংলাদেশে বিরতিহীন হরতাল-অবরোধ, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও চলছিল তখন একদিন আমরা এডিবি’র সাউথ ও সাউথ ইস্ট ব্লকের রেস্তোরাঁর লাঞ্চ টেবিলে দেশের আইনশৃঙ্খলার অব্যাহত অবনতি এবং আওয়ামী লীগের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। আমাদের সাথে ফিলিপাইনের তৎকালীন চার্জ দ্য এফেয়ার্স মেজর (অব.) খায়রুজ্জামানও ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে ড. কামাল সিদ্দিকী শেখ হাসিনার আচরণ ও রাজনীতির উদ্দেশ্য নিয়ে দুইটি অবিশ্বাস্য তথ্য দিয়েছিলেন। এর একটি হচ্ছেÑ শেখ হাসিনা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য মনে করেন না। তার রক্তের প্রতিটি কণিকা জিয়া পরিবারের প্রতি বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। তিনি তার মেয়ের বিয়েতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খলেদা জিয়াকে দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং বেগম খালেদা জিয়া সেই দাওয়াত কবুল করে অনুষ্ঠানে যোগদানও করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তার এই বিশিষ্ট মেহমানের সঙ্গে সামান্য সৌজন্য বিনিময়ও করেননি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শেখ হাসিনার রাজনীতির প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে এই দেশের মানুষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণ। কেননা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন নৃশংসভাবে নিহত হবার পর বাংলাদেশের কোন মানুষ কাঁদেনি। শেষোক্ত তথ্যটি বিবিসি’র খ্যাতনামা সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের লেখায় আমরা পড়েছিলাম। কিন্তু প্রথমোক্ত তথ্যটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন। অবশ্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে দুই নেত্রীর চোখাচোখি অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু তাদের কথাবার্তা ও কুশল বিনিময়ের ঘটনা ছিল বিরল। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে বিরোধীদলীয় নেতার কাছে সংলাপের প্রস্তাব দেয়ার জন্যে টেলিফোনে কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে ১৫ আগস্টের ঘটনা কিংবা ঐ তারিখে বেগম জিয়ার জন্মদিনের কেক কাটার প্রশ্ন কিভাবে আসে? এটা কি প্রাসঙ্গিক কোন বিষয়? এই প্রশ্ন আলোচনা করে অথবা এই প্রশ্নটি তুলে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট কি নিরসন করা যাবে? এটা অনেকটা আমার কাছে লাজুক জামাইয়ের শ্বশুরকে “আব্বা আপনি বিয়ে করেছেন?” বলে কথা বলার লজ্জা ভাঙার মত মনে হয়েছে। নিঃসন্দেহে তার এই কথাটি ছিল অপ্রাসঙ্গিক। বেগম জিয়া এর জন্য যদি কঠোর কোন উত্তর দিয়ে থাকেন তাহলে তাকে দোষ দেয়া যায় না।
একজনের একটা ক্ষমতালিপ্সা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ সম্ভোগস্পৃহা, দুর্নীতি প্রবণতা এবং স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি যে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে তার প্রত্যক্ষ অনুশীলন এখন বাংলাদেশে চলছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত তার ভাষণে সঙ্কট নিরসনের জন্য একটি ফর্মুলা দিয়েছেন। তিনি তার ফর্মুলা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে বিরোধী দলকে তার পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রদানের অনুরোধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাবটি ছিল সংবিধান বহির্ভূত। কেননা সংবিধানের কোথাও সর্বদলীয় সরকারের বিধান নেই। তিনি এর আগে বলেছিলেন যে, সংবিধান থেকে একচুলও তিনি নড়বেন না। দেখা গেলো তিনি নড়েছেন। দেশবাসী আশ্বস্ত হলো। তারা ভাবলো, বরফ গলতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো জনপ্রত্যাশা পূরণে একটা সমঝোতায় আসবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো তার উল্টোটা।  তার ঘোষণার দ্বিতীয় দিনই মহানগরীতে সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল, মানববন্ধন এমনকি ঘরোয়া বৈঠকও নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো। অর্থাৎ জনগণের সমস্ত রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়া হলো। জামায়াত অফিস সরকার তিন বছর ধরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রেখেছেন। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। বিএনপি অফিসেও দেখা গেল শত শত পুলিশের উপস্থিতি, ২৫ অক্টোবর ১৮ দলীয় জোটের পূর্ব-ঘোষিত মহাসমাবেশ হবার কথা ছিল। তারা নয়াপল্টন বিএনপি অফিসের সামনে এই সমাবেশ অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়েছিলেন। তাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তারা যখন বাঁশ ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী এনে স্টেজ তৈরিতে হাত দিলেন তখন পুলিশ এসে বাধা দিল এবং সব সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করল। কিন্তু ১৮ দলীয় জোট হাল ছাড়েনি এবং শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশের অনুমতি দিল। বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও মহাসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হলো এবং লাখ লাখ লোক তাতে অংশগ্রহণ করে প্রমাণ দিলো যে, তারা শেখ হাসিনার দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায় এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানই তাদের একমাত্র কাম্য। বেগম জিয়া নির্দলীয় সরকারের একটি রূপরেখা প্রদান করলেন এবং সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়ে ১৮ দলীয় জোট্রে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলটিমেটাম দিয়ে বললেন এর মধ্যে যদি সংলাপ শুরুর প্রক্রিয়া শুরু না হয় তাহলে ২৭ তারিখ ভোর ৬টা থেকে ২৯ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৬০ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি পালন করা হবে। হরতালের আগের দিন অর্থাৎ শনিবার দুপুরের পর টেলিভিশন চ্যানেলসমূহের স্ক্রলে একটি খবর ভেসে উঠল এবং তাতে বলা হল প্রধানমন্ত্রী লাল টেলিফোনে বেগম জিয়াকে টেলিফোন করেছেন কিন্তু সোয়া একটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে পাওয়া যায়নি। পরে আরেকটি খবর আসলো যে তিনি সন্ধ্যা ৬টায় টেলিফোন ধরবেন বলে জানিয়েছেন। এরপর জানা গেল যে, বেগম জিয়ার লাল ফোনটি নষ্ট। যাই হোক সন্ধ্যা ৬টার পরে প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে টেলিফোন করেছেন এবং তার সাথে ৩৭ মিনিট ধরে কথা বলেছেন। তিনি তার লাল টেলিফোনটি মেরামত করে দেয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। একজন বিশ্লেষক এই ফোনালাপকে একটি নাটক বলেছেন এবং এই সম্পর্কে শ্লেষ্মাত্মক মন্তব্যও করেছেন। তিনি বলেছেন যে, বেগম জিয়াকে যখন লাল ফোনে পাওয়া যায়নি তখন তিনি তার সাথে মোবাইলে কথা বলতে পারতেন। তার মোবাইলে পয়সা না থাকলে মোবাইল কোম্পানিগুলো জরুরী অবস্থায় ৫ টাকা পর্যন্ত অগ্রিম ব্যালেন্স দিয়ে থাকে। এটা তিনি করেননি। আবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার লাল ফোন নষ্ট থাকবে কেন? আর তা মেরামতের জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই বা কেন হস্তক্ষেপ করতে হবে? এটা কি তার অযোগ্যতা নয়? আসলে টেলিফোনের আলাপটি ছিল লোক দেখানো। দেশ বিদেশের চাপের বহিঃপ্রকাশ। সংলাপ উদ্দেশ্যেও নয়। এটা তার মন্ত্রী-উপদেষ্টারাই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ সংলাপ করবে তবে সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে কিছুতেই নয়। তারা আরো বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে বেগম জিয়াকে দাওয়াত দিয়েছেন এবং তার সাথে তার সহযোগীদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে এই আমন্ত্রণ শুধু বিএনপির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর অর্থ কি? জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, কল্যাণ পার্টি, বিজেপি, প্রভৃতিসহ ১৮ দলীয় জোটের শরীকরা যাবে কোথায়? জামায়াতকে তারা ভাশুর বা মামা শ্বশুর বলে মনে করেন এটা অনেকেই জানেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতে নেই। তাহলে সংলাপের এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হবে কিভাবে?
জনগণের দাবি হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই ব্যাপারে একটি সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়েছিল। এবং তা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। দেশে নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি সিস্টেম গড়ে উঠেছিল। এর কারণ ছিল, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন দেখা গেছে যে, তারা দ্বিতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, তৃতীয় বার কিভাবে বিজয়ী হবেন এবং চতুর্থবার কিভাবে ক্ষমতায় থাকবেন সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে প্রশাসনকে দলীয়করণ করেন এবং সাজান। এই অবস্থায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগেরই নেতৃত্বে জামায়াতের সহযোগিতায় বহু রক্ত, জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে এই দেশে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বিদেশী শক্তির সহযোগিতা, অর্থানুকূল্য ও কুবুদ্ধি নিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আঁতাত ও পেশীশক্তির নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করেন এবং এ জন্যে আদালতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। আবার আদালতের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হবার পেছনে অনেক কেলেঙ্কারিও ছিল। অভিযোগ রয়েছে যে, একজন বিচারপতিকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে লাখ লাখ টাকার রিসওয়াত দিয়ে বশীভূত করে কেয়ারটেকার সরকারের বিরুদ্ধে রায় আদায় করা হয়েছে এবং এই রায়ের মধ্যেও শুভঙ্করের ফাঁক ছিল। আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ে আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত নোংরামির সাথে এই রায়টির অংশবিশেষ পরে বদলিয়ে ফেলা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় বের হবার আগেই শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধন করে কেয়ারটেকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করেন। কেলেঙ্কারির এখানেই শেষ নয়। সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার পর সংশ্লিষ্ট বিচারপতি অবসরে চলে যান। অবসরে যাবার ১৬ মাস পর তিনি পূর্ণাঙ্গ ও পরিবর্তিত রায়ে স্বাক্ষর করেন। একজন বিচারপতি যখন অবসরে যান তখন তার শপথের আর কার্যকারিতা থাকে না এবং তিনি বিচারপতি হিসেবে কোন রায়ে স্বাক্ষরও করতে পারেন না। কিন্তু তবুও তিনি করেছেন। কারণ তিনি পয়সা খেয়েছেন এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনার কোন নজির নেই। অনেক বিশ্লেষক একজন বিচারকের এই আচরণকে মারাত্মক ফৌজদারী অপরাধ বলেছেন এবং এই অপরাধের শাস্তি দাবি করেছেন।
আজকে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এর পেছনে শুধু এই রায় নয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতালিপ্সা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি উপেক্ষা এবং অত্যাচার-নিপীড়ন ও স্বৈরাচারী আচরণও দায়ী। তিনি তার একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং নাগরিকদের শান্তি ও নিরাপত্তাকে রাজপথের নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরস্ত্র মানুষের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন। এখন মিছিল-মিটিং এর উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা হয় না, সরাসরি গুলী করা হয়। যে অস্ত্র, একে ৪৭ রাইফেল যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার কথা সেই অস্ত্র এখন নিরস্ত্র গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদী নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। অস্ত্র সংস্কৃতি দলীয় কর্মী এবং দাগী সন্ত্রাসীদের মাঠে নামানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এখন যেভাবে মানুষের বুকের ওপর সরাসরি গুলী চালাচ্ছেন তাতে মনে হয় না যে তিনি বা তার সরকারের মন্ত্রীরা এই দেশে ভবিষ্যতে রাজনীতি করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। তারা ক্ষমতায় আসতে পারলেই সম্ভবত দেশে থাকবেন নতুবা বিদেশে চলে যাবার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। এটা অনেকেরই ধারণা। এই ধারণা অমূলক বলে মনে হয় না।  দেশের রাজনীতি ও ক্ষমতা তারা তাদের একচেটিয়া সম্পত্তি বলে মনে করেন।
গতকাল যখন আমি এই প্রবন্ধটি লিখছিলাম তখন সারাদেশে দ্বিতীয় দিনের মতো হরতাল চলছিল এবং পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডারদের হামলায় ১১ ব্যক্তি নিহত এবং সহ¯্রাধিক ব্যক্তি আহত হবার খবর শুনা যাচ্ছিল। সাথে সাথে ‘পিকেটারদের ককটেলবাজির ঘটনাও পত্রপত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল। এর জন্য একশ্রেণীর গণমাধ্যমে (পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেল) এর সমস্ত দায়ভার জামায়াত-শিবির ও ইসলামপন্থীদের ওপর চাপিয়ে তাদের জঙ্গিত্বের প্রমাণ হিসেবে ঘটনাগুলোকে উপস্থাপন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। হরতাল, অবরোধে বাংলাদেশে পটকা ও গ্রেনেডবাজি আজকের নতুন কোন ঘটনা নয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গ্রেনেড, বোমা ও ককটেল হামলার কথা দেশবাসী ভুলে যায়নি। ’৮৬ নির্বাচনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখার জন্যে বোমা ও গ্রেনেডবাজি শহর, নগর ও গ্রাম-গঞ্জকে প্রকম্পিত করে তোলার ঘটনা আমরা এখনো ভুলিনি। ’৯০ এর এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশের শহরগুলোর মহল্লায় মহল্লায় এবং হরতাল, অবরোধ প- করার জন্যে ককটেল বিস্ফোরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এগুলোর অনুঘটক ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ কতিপয় রাজনৈতিক দল এবং সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কিছু কিছু লোক। তখন এটাকে জঙ্গিবাদ বলা হয়নি। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগের অব্যাহত অত্যাচার-অবিচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ জামায়াত-শিবির ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছে সেহেতু ককটেলবাজিকে নতুন রং দিয়ে জামায়াতের উপর চাপানো হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে, এটা জঙ্গিদেরই কাজ। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজ্ঞ ড. তুহিন মালিক যথার্থই বলেছেন যে, এই সরকার দেশের মুসলমানদের জঙ্গি হিসেবে পৃথিবীকে দেখাবার জন্যে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের মতো জঙ্গি জঙ্গি খেলা খেলছেন। তারা এসএসএফ’এর সিকিউরিটি এলাকায় নিজেদের লোক দিয়ে বোমা ও পটকাগুলো ফুটাচ্ছেন। এইসব এলাকায় কাকপক্ষীও ঢুকতে পারে না, জামায়াত-শিবির, বিএনপি ঢুকবে কেমন করে? তার মন্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
দেশ এখন নৈরাজ্যের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এর জন্যে একজনের একটি ইচ্ছাই দায়ী। সেই ইচ্ছাটি হচ্ছে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির বিলোপ সাধন। এখন যদি দেশকে নৈরাজ্যের পথ থেকে স্বস্তির পথে ফিরিয়ে আনতে হয় তাহলে ফোনালাপ, সংলাপ কিংবা দিল্লী-ওয়াশিংটনের কোন ফর্মুলা কাজ করবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আগে সংবিধান সংশোধন যারা করেছেন তারা পুনরায় সংবিধান সংশোধন করে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করবেন। তা না হলে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তা কারোর জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads