সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৩

নির্বাচনবাদী গণতন্ত্র বনাম সাংবিধানিক গণতন্ত্র


গতকালের পর : সেই সংবিধানের পক্ষে কোনোদিন জনমত যাচাইও করা হয়নি। তাছাড়া ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ যেমন সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করেছিল তেমনি ১৯৭৫ সালে দেশে একটিমাত্র দল বাকশাল রেখে বাকি সব দল নিষিদ্ধ করেছিল সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে।’ অথচ আমরা সবসময়ই দেখেছি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও দলের প্রতি আমাদের দেশের সংখ্যাগুরু ধর্মপ্রাণ তৌহিদি মানুষের আবেগ ও সমর্থন নিরঙ্কুশ ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং জনমতের প্রতিকূলে এ ধরনের আকাশ-কুসুম ও বিতর্কিত সংবিধান প্রায় জোরপূর্বক এই দেশের গণমানুষের ঘাড়ের ওপর সেদিন চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ সেই সংবিধানকে রাষ্ট্র বা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও মানানসই করে তোলা সম্ভব হয়নি। শেষপর্যন্ত ৭২-এর সংবিধান এদেশের ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতা কর্তৃক চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। এমনকি কথিত মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্টের একমাত্র দাবিদার বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জনপ্রত্যাখ্যাত সেই বাহাত্তরের সংবিধানের পুনরুজ্জীবন (জবংঁংপরঃধঃরড়হ) ঘটানোর প্রবল খায়েশ পোষণ করলেও তাদের দলীয় সেই ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাইছে না বলেই আমার মনে হয় (যদিও আওয়ামী লীগের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া পরগাছা বামপন্থী বুদ্ধিজীবীগণ নানাভাবে প্ররোচিত ও প্রভাবিত করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে)।
যাই হোক, শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত নয়। সংবিধানের মর্যাদা ও অক্ষুণœতা যথাযথ রক্ষা করাও গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত। কেবলমাত্র সংবিধানমুখী গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই এটি রক্ষা করা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। তা নাহলে এদেশে গণতন্ত্র কখনোই ইতিবাচক ও উন্নয়নমূলক ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারবে না। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চর্চা একটি সফল ও সুসংহত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক বলে আমি মনে করি। কিন্তু তার আগের মূল কর্তব্য হলো, সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গতিশীল ও অব্যাহত রাখার জন্য যথোপযোগী অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিক এবং বিবদমান শ্রেণী ও গোষ্ঠীর সর্বোপরি বহুবিধ মত ও পথের সমন্বয়ে অবিসংবাদিত একটি সম্পূর্ণ গণক্ষমতাসম্পন্ন সংবিধান প্রণয়ন করাÑ যার অধীনে গণতন্ত্র অক্ষত ও প্রাণবন্ত থাকবে। সেই সংবিধান বর্তমান সমাজের চরম বিভাজক মেরুকরণ দূর করে গণসম্মিলন ও গণঐক্য গঠনপূর্বক জনগণের যাবতীয় গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামকে বৈধতা ও অনুপ্রেরণা দেবে। রাষ্ট্রশক্তিকে আইনগতভাবে বাধ্য করবে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে। সেই সংবিধানই সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ তথা ব্যাপক জনসমষ্টির গণতান্ত্রিক-নাগরিক-সাংবিধানিক অধিকার সুষ্ঠুরূপে সংরক্ষণ ও দাবি-দাওয়া পূরণের নিশ্চয়তা দেবে। গণশক্তির সুষ্ঠু বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সংবিধানই উল্টো জিম্মি হয়ে আছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তির করতলে। আগামী দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একপক্ষ সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে আবার অন্যপক্ষ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছে। রাষ্ট্রশক্তি তথা বর্তমান সরকার নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থের অনুকূলে কথিত আদালতের রায়ের মারফত সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বাতিল করে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন করার পক্ষে মরণপণ অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে অনড়। এছাড়া দেখা যাচ্ছে, একপক্ষ সংবিধানের বাইরে এসে আলোচনা করতে চাচ্ছেন, আবার আরেক পক্ষ স্বার্থের অনুকূলে সংবিধান সংশোধনপূর্বক সংবিধানানুযায়ী নির্বাচন করতে চান। কিন্তু সংবিধান যেমন কারো বাপের সম্পত্তি নয়, তেমনি সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো গুরুত্ব্পূর্ণ জাতীয় প্রশ্ন বা বিষয়ের মোকাবিলা আপাতত সাময়িক সুফল দিলেও নিশ্চিতভাবেই তা সুদূরপ্রসারী হবে না। মনে রাখতে হবে, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই সংবিধান। সুতরাং দল-মত নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে যেকোনো জাতীয় সমস্যা বা ইস্যুতেই হোক, পুনরায় সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তন বা সংস্কার ঘটিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করাই যথোচিত কর্তব্য বলে বিবেচিত হবে। অথচ সরকার সেই দিকে না গিয়ে এবং আলোচনার জন্য সুষ্ঠু ও আন্তরিক পরিবেশ সৃষ্টি না করেই বিরোধী দলকে রেটোরিক ধরনের আলোচনার আহ্বান জানানোর ফলে কোনো পক্ষেরই আলোচনার বন্ধ দুয়ার খুলছে না। ফলত দু’পক্ষের মাঝখানে পড়ে বেচারা সংবিধান আর্তনাদ করে ধুঁকছে। কিন্তু এভাবে সাংবিধানিক সংকট ও জটিলতা জিইয়ে রেখে কি সংবিধানমুখী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব? এতকাল পরেও কেন নির্বাচনের সময় এলে তাদের মধ্যে সংবিধান নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যায়? উভয় দলই তো পালাক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাহলে কেন তারা গণতন্ত্রকে শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক হিসেবে গড়ে না তুলে পুরোপুরি সংবিধানপন্থী হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করলেন না? তারা যার যার ক্ষমতার স্বার্থে ইচ্ছামতো সংবিধান পরিবর্তন করবেন আর গণতন্ত্রের বারোটা বাজাবেন এটা তো হতে পারে না। কিন্তু আমাদের শেষ গতিও যে তারাই। কেবলমাত্র তাদের ইতিবাচক ও আন্তরিক নীতিনির্ধারণী ভূমিকাই এইসব রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধান করতে পারে। তাই আমরা আশা করি, তারা অতিসত্বরই অন্ততপক্ষে জনগণের কল্যাণস্বার্থে হলেও আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আগামী দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সফল আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে সকল বিভেদ-বিরোধ অবসানপূর্বক মূল সমস্যার সুরাহা করে একটি স্বচ্ছ, সর্বজনগ্রাহ্য ও বিতর্কহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্মরণীয় ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখবেন।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads