মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৩

নির্বাচন ও রাজনীতি


চরম অনিশ্চয়তায় আছে বাংলাদেশের মানুষ। সামনের কয়েকটি মাস বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তো আছেই, এর সাথে যোগ হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার; বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একেকটা রায় হচ্ছে আর এই রায় নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ছে সব স্তরে ও সব মহলে। কয়েক দিন আগে একজন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যের রায় হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এ রায় এক দিন আগেই ফাঁস হয়ে গেছে গণমাধ্যমে। মানুষ বলছে, এটি এযাবৎকালের সেরা প্রহসন ও তামাশা; এমন নজিরবিহীন ইতিহাস বাংলাদেশের আইনের শাসনের েেত্র আর দ্বিতীয়টি নেই। একটি রায় বিচারপতি ঘোষণার আগেই মানুষ জেনে যাবে, এটি পরীার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার শামিল, যা পরীাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; প্রকারান্তরে পরীা বাতিলও করতে হয়। এই রায় আগেভাগে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেই, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আগে দেয়া সব রায়ও। মানুষের মাঝে প্রশ্ন জেগেছেÑ এই ট্রাইব্যুনালে আগে যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার হয়েছে কি না। উল্লেখ্য, স্কাইপ বিতর্ক নিয়ে এর আগেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ট্রাইব্যুনাল। অন্য দিকে রাজনীতি নিয়েও মানুষ স্বস্তিতে নেই। দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, নির্বাচন হবে কি না; হলেও কিভাবে হবে, সব দলকে নিয়ে হবে নাকি একতরফা হবেÑ এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মাঝে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকার যেনতেনভাবে মতায় থাকার চেষ্টা করছে, এ জন্য নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করেছে; নির্বাচনে কেউ আসুক-না-আসুক সংবিধানের দোহাই দিয়ে এরা নির্বাচন করতে চায়। সরকার বিভিন্ন েেত্র শোচনীয় ব্যর্থতার সমাধান খোঁজার পরিবর্তে নিত্যনতুন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। এরা জেনেশুনে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে একটা চরম নৈরাজ্য ও অচলাবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সরকারের কর্তব্য; কিন্তু মনে হয় সরকার ইচ্ছা করেই তা করছে না। তারা বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারের ব্লুপ্রিন্ট কোনো দিনই বাস্তবায়ন হবে না। একজন রাজনীতিবিদের অবশ্যই একটি দল থাকে, থাকে দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি; তবু একজন রাজনীতিবিদের চিন্তা থাকতে হয় সার্বজনীন, সবার চিন্তাই তাকে করতে হয়। এ বাস্তবতা যদি রাজনীতিবিদেরা উপলব্ধি না করেন, তাহলে দেশ বিভক্ত হয়; জাতি বিভক্ত হয়, চূড়ান্তভাবে তা রাষ্ট্র ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ঠিক এমন একটি সন্ধিণে দাঁড়িয়ে। অপরিণামদর্শী রাজনীতির কারণে এখানে ধর্মে-ধর্মে, ভাইয়ে-ভাইয়ে হয়েছে বিরোধ, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে, ধর্মের প্রবর্তকদের অশালীন ভাষায় গালমন্দ করার ঘটনাও ঘটেছে, ধর্মীয় উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; সর্বোপরি রাষ্ট্রের পরতে পরতে বিরোধ ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একই ধর্ম ও ভাষার মানুষের মধ্যে এমন বিভক্তি সৃষ্টি করা নিশ্চয় একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। এই বিভক্তির ফলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রের সব েেত্র। দেশের শিল্পোৎপাদন, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি আজ বিপর্যস্তের পথে। সম্ভাবনাময় তৈরী পোশাক শিল্প চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে মারাত্মক স্থবিরতা। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে। ধ্বংস করা রাজনীতিকদের কাজ নয়, রাজনীতিকদের কাজ গড়া। যেটুকু উন্নতি বাংলাদেশের হয়েছে, তা জাতি হিসেবে আমরা এক থাকার কারণেই হয়েছে আর এটি করেছেন রাজনীতিকেরাই। এখনো যে বিপদ বাংলাদেশের সামনে কড়া নাড়ছে, রাজনীতিবিদদের ঐক্যই এ বিপদ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে পারে। সংবিধান, আইন সব কিছুই পরিবর্তন সম্ভব; যখন সবাই এক হয়। কাজেই এখন রাজনীতিবিদদের এক হওয়ার সময়, সময় দেশপ্রেম জাগ্রত করার; সময় বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়ার; কেননা বিশ্বের নজর কাড়ছে এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্য জাতিসঙ্ঘ এগিয়ে এসেছে, আমেরিকা এগিয়ে এসেছে; এগিয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব বিশ্ব, চীন, ভারত, কানাডা ও অন্য সব রাষ্ট্র। এক কথায় এসব দেশ বাংলাদেশের ভালো চায়; বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতি অব্যাহত রাখার স্বার্থেই রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে এসব দেশ এগিয়ে এসেছে। এসব দেশের উপলব্ধিতে হয়তো এসেছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব দেশ একটি পপাতহীন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের উচিত এসব দেশের আবেগের মূল্য দেয়া। ভোটের রাজনীতিতে শাসকদল এতটা অসহায় হয়ে পড়েছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনলেই তারা ভয় পায়। সংবিধানের দোহায় দিয়ে বিএনপিকে বাদ দিয়ে একটা যেনতেন নির্বাচন করাই মতাসীনদের এখন একমাত্র সান্ত্বনা। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হারার পর মতাসীনেরা বুঝতে পারছে, সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের মতায় আসার সম্ভাবনা ীণ। তাই তারা একতরফা নির্বাচনের পথে পা বাড়িয়েছে। আসলে মতার মোহে হেন কোনো কাজ নেই যা মতাসীন দল আওয়ামী লীগ করতে পারে না। এর জন্য তারা রাজনীতির অত্যন্ত নিচু স্তরে নেমে যাবে। তা ছাড়া একতরফা নির্বাচন করার রাজনৈতিক প্রোপটও বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। একতরফা নির্বাচনের মানসিকতা নিয়ে মতাসীন দল বেশি দূর এগোতে পারবে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে সব দল একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছে, বিরোধী জোটের বাইরেও জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, সিপিবি, বিকল্প ধারা, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ আরো অনেক দল একতরফা কোনো নির্বাচনের বিরুদ্ধ কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। একতরফা নির্বাচনে মতাসীন দলের কোনো ফায়দা আছে বলে মনে হয় না। একতরফা নির্বাচন করে দেশ ও দলের তি করে কোনো লাভ নেই। একতরফা নির্বাচনে গঠিত সরকারের স্থায়িত্ব হবে ীণ সময়ের, যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি। দেশের অপূরণীয় তি করে, পরে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে লাভ নেই; সুষ্ঠু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের তি না করে আগে, কেবল তা হলেই দেশ উপকৃত হবে। উপকৃত হবে দেশের মানুষ। বাংলাদেশ ঐক্যের দিক থেকে পৃথিবীতে একটা নিদর্শন ছিল। কিন্তু এটি ভেঙে চুরমার হয়েছে। এখন জাতি হিসেবে সব দিক দিয়ে আমরা বিভক্ত। ুদ্র একটি আঘাত সহ্য করার মতো শক্তিও আমাদের নেই। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। সব কিছু বিপন্ন হওয়ার আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং সঙ্কট দূর করে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে ধাবিত করা। এর জন্য সঙ্কীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি শাসকদলকে অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে, জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে হবে; হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ক্রান্তিসময় অতিত্রম করা শাসকদলের পে অসম্ভব। এখন প্রয়োজন দলীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতি। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads