মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৩

বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রস্তাব


বেগম খালেদা জিয়া গত সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ১৯৯৬ সাল এবং ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তাতে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও ১০ জন করে উপদেষ্টা ছিলেন। প্রস্তাবে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ঐ দুই নির্বাচনে যারা উপদেষ্টা ছিলেন তাদের মধ্য থেকে আওয়ামী লীগ ৫ জনের নাম প্রস্তাব করবে। আর বিএনপি ৫ জনের নাম প্রস্তাব করবে। তারাই হবেন উপদেষ্টা। যেভাবে জাতীয় সংসদ প্রেসিডেন্ট, স্পীকার ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যদের নির্বাচিত করে, সেভাবে তাদের নির্বাচিতও করা সম্ভব। আর প্রধান উপদেষ্টা হবেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন সম্মানিত ব্যক্তি।
একটি পত্রিকা অভিযোগ করেছে যে, এই প্রস্তাব উত্থাপনকালে বেগম খালেদা জিয়া যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেননি। করেননি যে একথা সত্য। কারণ ঐ ২০ জন উপদেষ্টার ৬ জন ইতোমধ্যেই পরলোকগমন করেছেন। এদের মধ্যে আবার কয়েকজন বার্ধক্যজনিত কারণে এই দায়িত্ব পালনে অপারগ। আর কেউ কেউ ঐ দায়িত্ব গ্রহণে নারাজ। ফলে যে ১০/১২ জন আছেন তাদেরকেই দু’দল মিলে আগামী নির্বাচন পরিচালনার জন্য রাজী করাতে হবে। সেটা একটা সমস্যা বটে। এদের কেউ আবার বলেছেন, রাজনীতি এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তাতে তাদের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। যে সংকট রাজনীতিবিদরা তৈরি করেছেন, তাদেরই উচিত সে সংকটের সমাধান করা। ফলে অপশন প্রায় শূন্যের পর্যায়ে ঠেকেছে। এই ফর্মুলা মানতে হলে জীবিতদের ও সুস্থদের উপদেষ্টা হতে রাজী করাতেই হবে।
দ্বিতীয় সংকট হলো সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রধান উপদেষ্টা। বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমার প্রস্তাব সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সম্মানিত নাগরিককে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্ধারণ করা হবে। আমি আশা করি শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন।’
বেগম খালেদা জিয়ার এই ভাষণে কোথায়ও সরকারের বিরুদ্ধে কোন কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। কিংবা ‘দেখে নেবো’ জাতীয় কোন কথাও বলা হয়নি। বরং বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ও সৌহার্দ্যমূলকভাবে তিনি প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেছেন। বিএনপির সাধারণ কর্মীদের কেউ কেউ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তারা আশা করেছিলেন, ভাষণটি হবে মারমুখী এবং দাবি না মানা হলে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া সে পথে অগ্রসর হননি। তার ভাষণ শুনে মনে হয়েছে, বর্তমান উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থেকে তিনি যেনো জাতিকে পরিত্রাণের একটি পথনির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি এও বলেননি যে, এই ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেয়া না হলে তিনি কী কর্মসূচিতে যাবেন। তার এই ভাষণের বৈশিষ্ট্য সেটাই। আর সে কারণেই দেশের বিশিষ্টজনেরা তার ভাষণকে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেছেন।
একথা সত্য যে জনগণ সংঘাত চায় না। তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়। সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ চায়। নির্বিঘেœ স্বাধীনভাবে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। আর চায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাদের অনুকূলে কাজ করে যাবেন। কিন্তু সরকার দেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে গেছে। এটি প্রধানত হয়েছে সরকারের সর্বব্যাপী দলীয়করণের কারণে। প্রশাসন, পুলিশ থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ পর্যন্ত সর্বত্র দলীয়করণ চরম রূপ নিয়েছে। তাছাড়া সরকার হয়ে পড়েছে সন্ত্রাস ও খুনিবান্ধব। তার ফলে সাধারণ মানুষ আরও ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। তারা সংঘবদ্ধভাবে পুলিশের উপর হামলা করছে, নিজের দলের লোকরাই এমপিদের বিরুদ্ধে জুতা মিছিল, ঝাড়– মিছিল করছে। ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, মন্ত্রী-এমপিরা নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেতে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশী নিরাপত্তা দাবি করছেন। নিজ দলের লোকদের কাছেই যদি তাদের অবস্থা এমন হয়ে থাকে তাহলে বিরোধী দলের লোকদের কাছ থেকে এর চাইতে ভালো কিছু পাবার আশা সম্ভবত তারা করতে পারে না।
সরকার তার ব্যর্থতা ঢাকতে কুৎসা, চরিত্রহনন, গালিগালাজ এসব পথেরই আশ্রয় নিয়েছে। ফলে যে ঐক্যের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হবার কথা, গত পাঁচ বছর কোনভাবেই সেরকম দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যদি বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে একটি কথা বলেছেন, তাহলে তার পারিষদেরা শতমুখে খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত, সেসব গালিগালাজ আনন্দের সঙ্গে উপভোগই করেছেন। কারণ তিনি কোনদিন তার পারিষদদের এসব ইতর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি।
এই কুৎসা ও অপবাদের জন্য সরকার তার বশংবদ দুর্নীতি দমন কমিশনকেও নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করেছে। বিচার বিভাগকেও যে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি দেশের সিনিয়র আইনজীবীরা একবাক্যে বলেছেন। দুদক যেমন বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের চরিত্রহননে নানান আজগুবি বক্তব্য দিয়েছে, তেমনি সরকারের বড় বড় দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। এদের সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে নির্বাচন কমিশন। পৃথিবীর দেশে দেশে নির্বাচন কমিশন যখন নিজেদের আরও শক্তিশালী করে তোলার দাবি জানায় তখন আমাদের নির্বাচন কমিশন যতোটুকু ক্ষমতা তাদের আছে তাও নিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের কাছে আকুল আবেদন করে। এমন মেরুদ-হীন নতজানু নির্বাচন কমিশন পৃথিবীতে সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।
পরিস্থিতি এরকমই। মিথ্যাচার, কুৎসা, অপপ্রচার এই সরকারের অলংকারে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ কখনও কখনও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে ভদ্র বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কিন্তু তিনিও যে মিথ্যা বলেন, সেটা শুধু বিএনপির বেলায় সত্য নয়। আওয়ামী লীগের ‘জানী দোস্ত’ এরশাদ সম্পর্কেও একই কথা বলে তিনি ফেঁসে গেছেন। গত রোববার শেখ হাসিনা এরশাদকে গণভবনে নৈশভোজে ডেকেছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার ১৪ জন সহযোগী নিয়ে সেই নৈশভোজে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে সৈয়দ আশরাফ সাংবাদিকদের জানান যে, আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। এরশাদ শেখ হাসিনাকে কথা দিয়েছেন যে, আগামী নির্বাচনে কেউ না এলেও জাতীয় পার্টি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবে। কিন্তু পরদিন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনানীতে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, মহাজোটে থাকা না থাকা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য, ভিত্তিহীন ও দুর্ভাগ্যজনক। এ বক্তব্য পড়ে ও শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। সরকারের মিথ্যাচার আসলে এই মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
এই ধরনের মনোভঙ্গি কোন জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। গত পাঁচ বছরে আমরা এসবই দেখে আসছি। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। রুষ্ট হয়েছে। ওয়াদা ভঙ্গ করা সরকারের দৈনন্দিন আচারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কোন পর্যায়েই সরকার এর পরিণতি সম্পর্কে ভাববার চেষ্টা করেনি। এর পরিণতি যা হয় তা হলো জনরোষ। জনগণ তাদের রোষের বহিঃপ্রকাশ সব সময় কিলিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে। সে কারণেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকেই বর্তমান সরকারের এতো ভয়। আর তাই প্রশাসনকে নিজের মতো সাজিয়ে, পুলিশকে গোপালীদের নেতৃত্বে দিয়ে, বিচার বিভাগ দলীয়করণ করে, নির্বাচন কমিশনকে নতজানু করে, দুদককে ফিডার খাইয়ে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবারই কোন সুযোগ না পায়। কিংবা পেলেও তা যেনো আওয়ামী লীগের পক্ষে দিতে বাধ্য হয়। ফলে নির্বাচনকে নিয়ে সারাদেশে সংশয়।
ভয় আরো একটি আছে। সরকার যে পরিমাণ দুর্নীতি, খুন, গুম করেছে তার বিচার যদি শুরু হয় তাহলে এই সরকারের বহু চাঁইকেই মৃত্যুদ- কিংবা যাবজ্জীবনের মুখোমুখি হতে হবে। এসব কারণেই সরকার সাংঘাতিক বেসামাল।
বেগম খালেদা জিয়া এখানেও যে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন তা চমৎকৃত হওয়ার মতো। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে সরকারের করণীয় প্রধান কাজগুলো কম গুরুত্ব পায় এবং এতে হিংসা এবং হানাহানি প্রশ্রয় পায়। তাই তিনি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে নতুন এক পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজ আমি আপনাদের মাধ্যমে খুব স্পষ্ট করে একটি কথা বলে এই পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটাতে চাই। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, যারা আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অতীতে নানারকম অন্যায়-অবিচার করেছেন, ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন, আমি তাদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করছি। আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। সরকারে গেলেও আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিশোধ নেবো না। আমি কথা দিচ্ছি, আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ও অধিক নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার কাজে। প্রতিশোধ নেয়া, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মতো কোনো ইচ্ছা ও সময় আমার নেই।’
বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণের পরদিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তার জবাবে সৈয়দ আশরাফ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন। এ লেখা যখন প্রকাশিত হবে তখন চিঠি ও দু’জনের ফোনালাপ উভয়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু এই রকম উদ্যোগের কথা শুনলে কেমন যেনো ভয় ভয় লাগে। ২০০৬ সালে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল জলিলের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রতিদিন আলোচনা হতো। আলোচনা শেষে দুইজনই হাসিমুখে সাংবাদিকদের বলতেন, আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। শেষ দিকে বলেছিলেন, আমরা সমঝোতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। কিন্তু ততোদিনে গোকুলে বেড়ে উঠেছিলো মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন গং। দেখা যাক এ যাত্রায় কী হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads