মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৩

দুই নেত্রীর ফোনালাপ


তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলে আসছে দুই নেত্রীর সর্বব্যাপী প্রভাব। একসময় দুই নেত্রীই ছিলেন বিরোধী দলে। তখন সরকারে ছিলেন এইচ এম এরশাদ। ’৯০-এর পর থেকে চলে এসেছে দুই নেত্রীর পালাক্রম শাসন। কখনো খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী আর শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী; আবার কখনো হাসিনা হন প্রধানমন্ত্রী, খালেদা হন বিরোধী নেত্রী। ক্ষমতার এই পালাবদলে খালেদা জিয়া এখন বিরোধী আসনে আর ক্ষমতায় আছেন শেখ হাসিনা। তবে আরেকটি পালাবদলের সন্ধিক্ষণ একেবারেই সামনে। ধারাবাহিকতায় ক্ষমতার অপেক্ষা খালেদা জিয়ার। কিন্তু যে ব্যবস্থা এই পালাক্রম তৈরি করছিল, সেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি আর বহাল নেই। শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়েছেন। এখন এ নিয়ে চলছে দুই পক্ষের টানাপড়েন। দেশ হয়ে পড়েছে দুই ভাগে বিভক্ত। জনমতের বড় ভাগটি বিরোধীদের পক্ষে, সরকারের আছে কেবলই প্রশাসন। এই টানাপড়েনে একসময় শেখ হাসিনা যে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার জন্য জামায়াতকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন, সেটি পুনর্বহাল দাবিতে হরতাল হচ্ছে, আসছে অবরোধ। এই আন্দোলন-সংগ্রামের এক চরম মুহূর্তে তথ্যমন্ত্রী তথ্য প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী ফোন করবেন বিরোধীদলীয় নেতাকে। এর পরদিন টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন, কিন্তু বিরোধী নেত্রীকে পাননি। আবার বিরোধীদলীয় নেতার অফিস থেকে বলা হয়, তারা ফোন পাননি। ফোন ধরতে অপেক্ষা করবেন ৯টার পর। অন্য পক্ষ থেকে বলা হয় ৬টার পর থাকতে। বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন, কিন্তু ফোন আসে বেশ কিছু সময় পর। কথা হয় টানা ৩৭ মিনিট। ৫০ টাকার বেশি আসতে পারে মোবাইল বিল। এই ফোনালাপ কয়েক দিন আচ্ছন্ন করে রাখে রাজনৈতিক উত্তাপকে। সরকারসমর্থক সংবাদপত্র টিভিতে ফলাও করে প্রচার করা হয় বিরোধীদলীয় নেতা কী খেতে চান, তার আয়োজন করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন। লাল ফোনটি সারিয়ে দেয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। তথ্য মন্ত্রীর তথ্যÑ তথ্যমন্ত্রীর কাজ যে কেবলই তথ্য নিয়ন্ত্রণ নয়, তার প্রমাণ রাখতে মধ্যে তথ্যের প্রকাশ ঘটান হাসানুল হক ইনু। ফোনালাপের তথ্যটিও তিনি প্রথম প্রকাশ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা ফোনে কী আলাপ করবেনÑ এ নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। ফোনালাপ বাস্তবে সংঘটিত হওয়ার পর পত্রপত্রিকা রেডিও টিভি সাথে সাথে খবর প্রচার করে। খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী হরতাল তুলে নিতে বলেছেন। বিরোধী নেতা রাজি হননি। তবে গণভবনে রাতের ভোজের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। ৩৭ মিনিটের আলাপে এটুকুতেই মিডিয়ার পাঠক-দর্শকের ুধা বা কৌতূহল কোনোটাই মেটেনি। এর মধ্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বললেন, দুই নেত্রী একে অন্যের সাথে কী কথা বললেন তা প্রকাশ হওয়া উচিত। এর পরদিনই সরকারদলীয় ভাবধারার মিডিয়া হিসেবে পরিচিত একাত্তর-এটিএন নিউজ দুই নেত্রীর ফোনালাপ স্বকণ্ঠ প্রকাশ করে। এতে অনেকের কৌতূহল থামে, তবে প্রশ্ন থেকে যায় অনেক। একাত্তর টিভি বা এটিএন নিউজ বলেনি তারা তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এই ফোন রেকর্ড পেয়েছে কি না। তবে তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য এবং দুই টিভির কথোপকথন প্রকাশের মধ্যে একটি যোগসূত্র থাকতেই পারে। ১৪ বছর জেল! তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কারো তথ্য ক্ষতিকারকভাবে প্রকাশ বা ব্যবহার করলে বিনা ওয়ারেন্টেই গ্রেফতার করার বিধান করা হয়েছে। এই অপরাধে অভিযুক্তের জামিনও নেই। দোষী হলে ৭ থেকে ১৪ বছর জেল। বর্তমান সরকার ২০০৬ সালের মূল তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সংশোধনী এনে ৫৭ নম্বর ধারা প্রতিস্থাপন করে এ বিধান করেছে। সংশোধিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের এই ৫৭ ধারাটি দেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেছেন দেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিক। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে, যা দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট হতে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যের মানহানি ঘটায়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ুণœ করে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়Ñ তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই আইন জামিনযোগ্য নয় এবং পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের এবং সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই তথ্যপ্রযুক্তি আইনেই আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক আদিলুর রহমান খান শুভ্রের বিরুদ্ধে সরকার মামলা দিয়েছে। দুই নেত্রীর কথা হয়েছে ফোনে। ফোনের এই কথোপকথন ব্যক্তিগত বিষয়। যদিও এতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তারা কথা বলেছেন। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যদি স্কাইপের কথোপকথন বিদেশী মিডিয়ায় প্রকাশের পর তা পত্রিকায় ছাপানোর জন্য এই ধারায় অভিযুক্ত হতে পারেন অথবা শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হতাহতের ব্যাপারে নিজস্ব অনুসন্ধানের তথ্য প্রকাশ করে অধিকার-প্রধান আদিলুর রহমান আইসিটি আইনে অভিযুক্ত হতে পারেন, তাহলে দুই নেত্রীর কথোপকথন ফাঁসকারীর বিরুদ্ধে কি আইসিটি আইনে মামলা হবে না? সত্যিই যদি মামলা হয় কার বিরুদ্ধে হবে এ মামলা, তথ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নাকি একাত্তর বা এটিএন নিউজের বিরুদ্ধে? কে হলেন কুপোকাৎ আমেরিকায় নির্বাচনের আগে একাধিকবার টেলিভিশন বিতর্ক হয়। ২০১২ সালের নির্বাচনে এ ধরনের এক বিতর্কে ওবামা হেরে গিয়ে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছিলেন। পরে শেষ বিতর্কে আক্রমণাত্মক হয়ে ফল জয় করে এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রথম কালো মার্কিন প্রেসিডেন্ট। দুই নেত্রীর ফোনের কথাবার্তা সম্মুখবাক্য-সমর ছিল না। দুইজন দুই জায়গা থেকে কথা বলেছেন। কিন্তু ফোনালাপটি অনেকটাই হয়ে পড়ে ফোনোবিতর্কে। টিভিতে এর অডিও শুনে শ্রোতারা অজান্তেই হিসাব কষে ফেলেন এই ফোন-বিতর্কে জিতলেন কে? আক্রমণাত্মক মনোভঙ্গির অধিকারিণী হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীকে ফোনোবিতর্কে বেশ ম্রিয়মাণই মনে হচ্ছিল। তিনি পয়েন্ট পেতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছেন, ২১ আগস্ট, ১৫ আগস্টে জন্মদিন, যুদ্ধাপরাধ অথবা রাজপথে মানুষ হত্যার মতো তার ফেবারিট ইস্যুতেও। এসব ইস্যুতে তার আঘাত ফিরিয়ে দিয়ে পাল্টা আঘাত হেনেছেন বিরোধী নেত্রী। প্রত্যাঘাত সামলে নিয়ে কেবলই প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন হরতাল প্রত্যাহার করে নিতে। একাত্তরের পরের সরকারের হত্যাকাণ্ডকে একাত্তরের বলে উল্লেখ করে যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ তুলে একটি পয়েন্ট পেতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেটিতেও সফল হননি। সংশয়ে ফেলতে চেয়েছেন বিরোধী নেত্রীর আলোচনায় গেলে হরতাল প্রত্যাহার করার বক্তব্যের ব্যাপারে। হরতাল প্রত্যাহারের এই একটি বাক্য ফোনালাপে বিরক্তিকরভাবে বারবার উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। উপসংহারে নির্দলীয় সরকারের বিষয়টি নীতিগতভাবে মেনে নেয়ার ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী দিলে হরতাল রাতেই প্রত্যাহারের কথা বলেন বিরোধী নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী পাল্টা আহ্বান জানান সর্বদলীয় সরকার মেনে নিতে। এতে মনে হয়েছে দুই পক্ষের মতের ব্যবধান ও অবস্থান ফোনালাপের আগে যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বিরোধী দলের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত যুক্তিসিদ্ধই প্রমাণিত হয় এতে। চায়ের কাপে ঝড় বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে মোটা দাগে রাজনৈতিক ভাবাদর্শগতভাবে বিভাজন করা হলে সরকারপক্ষ বরাবরই ছিল শক্তিমান অবস্থানে। বিরোধী পক্ষের যে ক’টি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র ছিল, তার মধ্যে চারটি টেলিভিশন চ্যানেল ও একটি সংবাদপত্র বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এর সাথে সরকারপক্ষে যোগ হয়েছে আরো ডজনখানেক। ফলে যেকোনো ইস্যুতে চায়ের কাপের ঝড়টি গণমাধ্যমের কল্যাণে সরকারপক্ষে টেনে নেয়া যায়। গণভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানোর পর সে ধরনের একটি আবহ সৃষ্টি করা হয়। ফোনালাপের পর গণমাধ্যমের আলোচনা-সমালোচনায় মনে হয় এখনকার রাজনৈতিক বা জাতীয় সঙ্কট বিরোধীদলীয় নেত্রী গণভবনের নৈশভোজের দাওয়াত খেলেই সমাধান হয়ে যেত। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি না, সব দল সমসুবিধা নিয়ে নির্বাচনে যেতে পারবে কি না, জনগণ মুক্তভাবে ভোট দিতে পারবে কি নাÑ এসব কোনো ইস্যুই নয়। দেশে আইনের শাসন বা গণতন্ত্র থাকবে কি না সেটিও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রীর গণভবনের রাজসিক ভোজ খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে আর লাল টেলিফোনটি সচল হয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী তো এ দু’টি কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে কেন হরতাল তুলে না নেয়ার ‘পাপ’ করতে গেলেন বিরোধদলীয় নেত্রী? এ ধরনের কথাবার্তা দুই দিনের আলোচনায় নানাভাবে এসেছে। দুই নেত্রীর ফোনালাপ বলা হোক অথবা ফোনযুদ্ধ বলা হোক, এর অডিওটি প্রকাশ হওয়ায় চায়ের কাপের সেই ঝড় থেমে যাবে। ক্ষমতায় থাকা পক্ষ যে আসলে আলোচনার কথা বলে, নৈশভোজের মেনুর কথা জানতে চেয়ে সংলাপের বিষয়টিকে হাস্যস্পদ করতে চেয়েছিলেন, এটি আর কারো কাছে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে না। দুই নেত্রীর ফোনালাপের পুরোটা টেলিভিশনে প্রচার করা হয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবে যেটি প্রকাশ হয়েছে সেটি তুলে ধরা হলো পাঠকদের সামনে। যা ছিল ফোনালাপে বেগম খালেদা জিয়া : হ্যালো, হ্যালো... শেখ হাসিনা : হ্যালো। কেমন আছেন? খালেদা : ভালো। হাসিনা : দুপুর থেকে ফোন করছি। খালেদা : দুপুরে কোনো ফোন আসেনি। হাসিনা : ফোন করেছি তো। খালেদা : কথা সত্য নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই টেলিফোনটি বিকল। দেশ চালান, সব খবর রাখেন, এ খবর রাখেন না? লোক পাঠান। হাসিনা : আপনি তো জানেন, রেড ফোন বিকল থাকে না। খালেদা : ফোন বিকল, এটাই সত্য। হাসিনা : আমি ফোন করেছি। খালেদা : দীর্ঘ দিন ধরে ফোন ডেড। মৃত ফোন কি হঠাৎ জেগে উঠবে? হাসিনা : যেকোনো কারণে ফোন ধরতে পারেননি। খালেদা : না ফোন বাজেনি। আমি ফোনের কাছেই থাকি। ফোন বাজলে না ধরার কথা নয়। হাসিনা : ফোন বেজেছে, ধরেননি। আমি আগামীকাল দেখব। খালেদা : ... হাসিনা : আমি ফোন করলাম। ২৮ তারিখ (২৮ শে অক্টোবর) আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। জানেন তো, আমরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছি। খালেদা : দাওয়াত কেন দিচ্ছেন? হাসিনা : আমার সঙ্গে রাতের খাবার খাবেন। খালেদা : ২৮ তারিখ আমি যেতে পারব না। ওই দিন হরতাল আছে। হরতাল থাকলে আমি বের হই না। হাসিনা : আপনি বলেছেন, দুই দিনের মধ্যে... খালেদা : বলেছি। আমার আন্তরিকতা আছে। আমি একা যাবো না। হাসিনা : যাকে ইচ্ছা আনেন, যতজন ইচ্ছা আনেন। খালেদা : যতজন না। আমার দলের প্রয়োজনীয় নেতাদের নেবো। হাসিনা : দেশ-জাতির স্বার্থে হরতাল প্রত্যাহার করুন। খালেদা : হরতাল প্রত্যাহার করতে পারব না। হাসিনা : মানুষ হত্যা বন্ধ করুন। খালেদা : মানুষ হত্যা আপনারা করছেন। আপনারা গানপাউডার দিয়ে বাস পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। এসব হত্যার নির্দেশ আপনার মুখ থেকেই বেরিয়েছে। এর দায় আপনাদের। হাসিনা : জনগণের স্বার্থে হরতাল প্রত্যাহার করুন। খালেদা : জনগণের স্বার্থে হরতাল দিয়েছি। হাসিনা : আমরা আলোচনা করতে চাই। খালেদা : আপনার মন্ত্রীরা তো বলেছেন, আলোচনা হবে না। আলোচনা হতে পারে, হরতালের পর। হাসিনা : আপনি তো দুই দিনের কথা বলেছিলেন। খালেদা : আপনি এক দিন পর ফোন করেছেন। তখন সুযোগ ছিল না। হাসিনা : আমি তো ব্যস্ত। খালেদা : আপনার মতো অত ব্যস্ত না হলেও আমরাও ব্যস্ত। হাসিনা : .... খালেদা : কাল আমাদের সমাবেশের এত দেরি করে অনুমতি দিলেন কেন? অনুমতি দিলেন মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিলেন না কেন? লোকজন আমাদের বক্তব্য শুনতে পায়নি। অতীতে আপনাদের তো এমন করিনি? হাসিনা : আমি বলেছি, আলোচনার কথা। খালেদা : সমাবেশে মাইকের অনুমতি কেন দিলেন না? হাসিনা : অনুমতি তো দিয়েছি। খালেদা : আমরা সমাবেশ করতে গেলে আপনারা ১৪৪ ধারা জারি করেন। দেশে কি ইমার্জেন্সি জারি হয়েছে? দেশে কি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে? হাসিনা : এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। খালেদা : কথা তো আপনাকে বলতে হবে। মিটিং করতে চাইলে মাইকের অনুমতি দেবেন না, আপনারা আগে মিটিং করেননি? হাসিনা : আমাদের গ্রেনেড হামলার কথা মনে আছে? খালেদা : আমরা নই, আপনারা করিয়েছেন গ্রেনেড হামলা। হাসিনা : আপনারাও কিন্তু রাত ১১টায় অনুমতি দিয়েছিলেন। খালেদা : আপনার দলের নেতারা ভেনু পরিবর্তন করেছিল... হাসিনা : আপনি মুক্তাঙ্গনে অনুমতি... খালেদা : অনুমতি দিয়েছি, রেকর্ড আছে। সে রেকর্ড দেখেন না... হাসিনা : ... খালেদা : এখন বলছি, সত্যিকার আন্তরিক হন। তবে ২৯ তারিখের পর বলেন, আমি যাবো। হাসিনা : আমি ঝগড়া করতে চাই না। আপনি একতরফা কথা বলছেন। খালেদা : কথা আপনিও বলছেন। হাসিনা : হরতাল প্রত্যাহার করেন। আসেন। খালেদা : হরতালের পর। হাসিনা : হরতালের মাধ্যমে মানুষ খুন করছেন। খালেদা : আপনারা মানুষ খুন করছেন। আপনার ছাত্রলীগ, যুবলীগ মানুষ খুন করছে। হাসিনা : খুনের রাজনীতি আমরা করি না। খালেদা : খুনের রাজনীতি আপনার পুরনো অভ্যেস। আপনাদের পুরনো অভ্যেস। ১৯৭১ এর পরও মতায় থাকাকালে মানুষ খুন করেছেন। সেটা কি ভুলে গেছেন? হাসিনা : ’৭১-এ মানুষ খুন করেছি? খালেদা : ’৭১-এর পর মতায় থাকাকালে মানুষ খুন করেছেন। হাসিনা : যুদ্ধাপরাধীদের রা করছেন। খালেদা : সত্যিকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলে আমরা সমর্থন দিতাম। কিন্তু আপনি তা করছেন না। আপনার দলেও অনেক যুদ্ধাপরাধী আছে... হাসিনা : সত্যিকার বিচার হচ্ছে। খালেদা : আপনি তো প্রধানমন্ত্রী নন। আপনি তো দলীয় প্রধানমন্ত্রী। আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন; আমার দলীয় কার্যালয়ে যে আচরণ করেছেন... হাসিনা : আপনি জবাব দিতে পারেন। অসাংবিধানিক সরকার... খালেদা : আপনারাই অসাংবিধানিক সরকারকে স্বাগত জানান। আপনিই এরশাদ মতা দখলের পর বলেছিলেন, আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। হাসিনা : বলিনি। খালেদা : আপনি মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে আপনাদের আন্দোলনের ফসল বলেছেন। হাসিনা : না। খালেদা : আপনি তাদের শপথ অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছেন, আপনাদের আন্দোলনের ফসল। মানুষ সে কথা ভোলেনি। হাসিনা : আপনি ৯ জনকে ডিঙিয়ে মইন উদ্দিনকে প্রধান বানিয়েছিলেন। খালেদা : আপনি অনেককে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ কথা বইলেন না। অনেককে বাড়ি পাঠিয়েছেন। মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সাংবিধানিক সরকার ছিল না। কিন্তু আপনি তাদের শপথ অনুষ্ঠানে গেলেন। সে দিন তো আমরা দুই দলই মতার বাইরে ছিলাম। আমি যাইনি, আপনি শপথ অনুষ্ঠানে গেছেন। হাসিনা : আমি আগুনে বসে হাসি পুষ্পের হাসি। আমার বাবা-ভাই মারা গিয়েছিল। খালেদা : আপনি অতীতের দিকে নয়, সামনের দিকে আগান। সৎ উদ্দেশ্য থাকলে সামনে আগান। হাসিনা : আপনারা ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে হত্যাকাণ্ড করেছেন। খালেদা : হত্যা আমরা করিনি। আপনি যত দিন থাকবেন, ততই আমাদের লাভ। আপনি যতই অশ্লীল কথা বলবেন ততই আমাদের লাভ। হাসিনা : ১৫ই আগস্ট আপনি কেন কেক কাটেন? খালেদা : ওই দিন কি কোনো মানুষ জন্ম নেবে না। আপনারা জিয়াউর রহমানের কথা বলেন। জিয়াউর রহমান তো আপনাদের আওয়ামী লীগকে জন্ম দিয়েছেন। আপনারা তো বাকশাল ছিলেন। হাসিনা : ... খালেদা : এ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসেন। আসুন নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করি। হাসিনা : আপনি হরতাল প্রত্যাহার করবেন না? খালেদা : হরতাল প্রত্যাহার করতে পারব না। এটা ১৮ দলের সিদ্ধান্তে ঘোষণা করা হয়েছে। হাসিনা : আপনি ১৮ দলকে ডেকে সিদ্ধান্ত নিন। খালেদা : তাদের তো পুলিশ তাড়াচ্ছে। হাসিনা : পুলিশ ধরবে না। বলে দেন। খালেদা : পুলিশ কি আমাদের কথায় চলে? হাসিনা : বোমা বাস্ট হবে... খালেদা : বোমা বাস্ট আপনারা করেন। আপনি ২৯ তারিখের পর বলেন, আমরা আসব। হাসিনা : আপনি দুই দিনের আলটিমেটাম দিলেন। এর মধ্যেই তো ফোন করলাম। খালেদা : বলেছি তো, আপনি দেরি করেছেন। আমরা বলেছি, সংলাপ ও আন্দোলন একসঙ্গে চলবে। হাসিনা : আপনারা কি ক্যামেরায় ... খালেদা : আমাদের এখানে ক্যামেরা নেই। আমরা ক্যামেরা ছাড়া কথা বলছি। অফিসে থাকলেই বরং ক্যামেরা থাকত। আপনারা সম্ভবত ক্যামেরাই দেখাচ্ছেন...। হাসিনা : ফোন করেছি। ফোন তো ঠিক আছে। খালেদা : লোক পাঠান। হাসিনা : ১০-১২ বার ফোন করেছি। খালেদা : আমরা শুনিনি, আপনি কেবল শুনেছেন। হাসিনা : আমি কিভাবে শুনবো? আমার তো এক কান নষ্ট। ফোন আমি নিজেই করেছি। খালেদা : ডেড ফোনে কথা বলেছেন। হাসিনা : রিং হচ্ছিল। খালেদা : ঠিক নয়। আমরা অনেকবার লোক ডেকেছি। আপনার লোকজন আমাদের তো মানুষই মনে করে না। হাসিনা : ফোন দিয়েছি। খালেদা : আপনি চাইলে মোবাইলে কথা বলতে পারতেন। মৃতকে তো মৃত বলতেই হবে। হাসিনা : (...নাম্বার বলে যান) খালেদা : আপনার মুখস্থ থাকতেই পারে। হাসিনা : কাল খবর নেবো। খালেদা : গুলশান এক্সচেঞ্জের লোক মিথ্যা বলেছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সে সত্য কথা বলেনি। হাসিনা : আলাদা এক্সচেঞ্জ। খালেদা : টেলিভিশনে স্ক্রল দেখাচ্ছে... হাসিনা : গণভবনে আমরা কথা বলছি, এখানে কোনো টেলিভিশন নেই। খালেদা : তাহলে কেন এটা বলা হচ্ছে... হাসিনা : তাহলে কি কথা বলবেন না? খালেদা : আমি আধা ঘণ্টা ধরেই বসে আছি। আপনার ফোন আসবে এ জন্য। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। কথা বলেছি। এখন কেন কথা বলবো না? হাসিনা : ২৮ তারিখে আসেন। খালেদা : সত্যিই আন্তরিক হলে ২৯ তারিখের পর বলেন। হাসিনা : কাল বলেছেন... খালেদা : আমরা তো হরতাল দিয়েছি। হাসিনা : আমি তো ফোন করেছি। খালেদা : আগে কেন করেননি? পরে করছেন কেন? হাসিনা : আমি দুঃখিত। খালেদা : বাংলাদেশের মানুষ... হাসিনা : আপনি দুই দিনের কথা বলেছেন... খালেদা : বলেছি, কিন্তু হরতালও দিয়েছি। হাসিনা : কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। খালেদা : ১৮ দলকে এখন কই পাবো? হাসিনা : হুকুম করেন, পাবেন। খালেদা : কই পাবো? তারা তো ... হাসিনা : মিথ্যা বলছেন। খালেদা : আপনি কাল রাতে ফোন করতে পারতেন... হাসিনা : আমি রাত জাগি না। আমি সকালে নামাজ পড়ি। খালেদা : নামাজ পড়েন। কুরআন পড়েন। নামাজিদের গুলি করেন, হত্যা সবই করেন। আবার কুরআন শরিফ জ্বালান। হাসিনা : কুরআন শরিফ কারা জ্বালান সবাই জানে। খালেদা : আপনি পুড়িয়েছেন, আপনারা পুড়িয়েছেন। কারণ এগুলো আপনারা বিশ্বাস করেন না। ... ২৯ অক্টোবরের পরে তারিখ দেন। এর পরে যদি চান আলোচনা হবে। এর আগে আলোচনার সুযোগ নেই। হাসিনা : আপনি আপনার বক্তব্য থেকে সরে যাচ্ছেন। খালেদা : আমার দলের নেতারা এখন নেই। ১৮ দল নেই। আমি একা কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবো? হাসিনা : হুকুম দেন। এটা হয় নাকি... খালেদা : আপনার ডিবি-এসবি তো আমাদের ঘেরাও করে রেখেছে, কিভাবে আসবে। হাসিনা : আপনারা তো দা-কুড়াল নিয়ে মানুষ হত্যার কথা বলছেন। খালেদা : বিশ্বজিৎকে আপনারা হত্যা করেছেন। হাসিনা : তারা আগেই ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত ছিল। খালেদা : আমরা এ রকম আরো উদাহরণ দিতে পারব। আপনারা আমাদের বক্তব্য টেলিভিশনে প্রচার করতে দেননি। নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছেন। আল্লাহ আপনাদের বিচার করবে। হাসিনা : ধরা পড়ার পর দেখা গেছে। তাদের বাবা-মা জামায়াত-বিএনপি করে। খালেদা : না, তারা ছাত্রলীগই করে। আমি আপনাকে অনুরোধ করি, সদিচ্ছা থাকলে ২৯ তারিখের পর ডাকেন। হাসিনা : এ কথাটি রাখেন। খালেদা : ২৯ তারিখের পর ডাকেন। অন্য কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে। আমরা কর্মসূচি দেবো না। হাসিনা : দিনের কথা বলেছিলেন। খালেদা : ৩০ তারিখ হলে আমি রাজি আছি। হাসিনা : আপনার তো ভারপ্রাপ্ত আছে। যদিও প্রটোকলে মেলে না। তার পরও আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ কথা বলবেন। তাদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে... খালেদা : কাল রাতে কেন ফোন দিলেন না? তাহলে আমি দলের নেতাদের সঙ্গে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। আমি তো ৭টায় অফিসে গিয়েছিলাম। ফোন করলেই পেয়ে যেতেন। হাসিনা : তখন তো রাত। খালেদা : ৭টা রাত নয়, সন্ধ্যা। হাসিনা : আমার তো নেতাদের সঙ্গে কথা বলে... খালেদা : আমারও তো নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। হাসিনা : আমাদের কিন্তু ’৯৬-এর কথা মনে আছে। খালেদা : ১৭৩ দিন হরতাল করেননি? হাসিনা : ’৯৬তে আপনারাও করেছেন। খালেদা : ১৯৯১ সালে আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছি। একসঙ্গে কাজ করতাম। কিন্তু আপনি প্রথম দিনেই সংসদে বললেন, এক দিনও শান্তিতে থাকতে দিবেন না... হাসিনা : নো। খালেদা : আপনি একবার তত্ত্বাবধায়কের কথা বলবেন, একবার সংবিধানের কথা বলবেন। হাসিনা : নির্বাচনের পর যে সিচুয়েশন হয়েছিল। খালেদা : ৩০ তারিখের পর হলে আমরা রাজি আছি। হাসিনা : আমার পার্টি স্ট্রং। আমাদের ভোট আছে। আমরা সংগ্রাম করেই এটা অর্জন করেছি। খালেদা : আমার দলও অনেক সংগ্রাম করে মতায় এসেছিল। হাসিনা : দুঃখিত। খালেদা : সময়মতো ফোন করেননি। আমি দুঃখিত। কাল ফোন করলে পরিবেশ পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। হাসিনা : আমার এডিসি দেড়টা থেকে চেষ্টা করেছে। খালেদা : ফোন না বাজলে ধরার উপায় নেই। হাসিনা : শিমুল বিশ্বাসের ফোনেও অনেক চেষ্টা করেছে। খালেদা : আপনি বসে ছিলেন ৬টার জন্য। হাসিনা : আপনি জানেন আমাদের মিটিং ছিল। আমি মিটিংয়ে দেরি করতে পছন্দ করি না। খালেদা : মিটিং জরুরি না এটা জরুরি ছিল। হাসিনা : সিদ্ধান্ত নেন। খালেদা : কিভাবে নেবো? হাসিনা : জাতির কাছে বলেন। খালেদা : আপনি নির্দলীয় সরকার মেনে নিন। আমি হরতাল প্রত্যাহার করব। হাসিনা : আমাদের ৯০ ভাগ সিট ... খালেদা : আপনি বলেন, নির্দলীয় সরকার মেনে নেবেন, আমি হরতাল তুলে নেবো। হাসিনা : যারা মাইনাস-টু করতে চেয়েছিল আপনি তাদের আনতে চাইছেন... খালেদা : আমি না, আপনি। আপনি যে ভাষায় কথা বলেন... হাসিনা : আপনি তো মধুর ভাষায় কথা বলেন। আমরা সংসদে আছি। একসঙ্গে কাজ করব... আপনি দলের নেতাদের মিটিং করেন। খালেদা : পুলিশকে বলে দেন। তত্ত্বাবধায়ক মানেন। সবাইকে ডাকি। হাসিনা : হরতাল তুলে নেন। খালেদা : নির্দলীয় সরকার মানার ঘোষণা দেন। হাসিনা : আপনার দলের লোকের ওপর ভরসা নেই? খালেদা : আমার দলের লোকের ওপর ভরসা আছে। হাসিনা : তাদের ডাকেন। খালেদা : আপনি দাবি মানেন, হরতাল ... হাসিনা : আপনি সর্বদলীয় মানেন। খালেদা : সবর্দলীয় মানা যায় না। হাসিনা : আবার কাকে আনবেন, মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের মতো... খালেদা : আপনিই আনেন। হাসিনা : ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সৃষ্টি করবেন না। খালেদা : কী বলেন... হাসিনা : আসেন। হরতাল তুলে নেন। খালেদা : ২৯ তারিখের আগে পারব না। হবে না। হাসিনা : ধন্যবাদ...

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads