শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৩

কোন পথে রাজনীতি ও নির্বাচন


প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব; অতঃপর বিরোধী দলের নেতার পাল্টা প্রস্তাবে রাজনীতি এখন জটিল সন্ধিণে দাঁড়িয়ে। অন্য দিকে ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সরকার। এ দিকে বিরোধী দল বলছে, তারা যেকোনো মূল্যে ২৫ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশ করবে; এ অবস্থায় মানুষ স্বস্তিতে নেই, ছড়িয়ে পড়ছে উত্তাপ-উত্তেজনা। কী হবে, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, নির্বাচন হবে কি নাÑ হলেও কার অধীনে হবে, বিরোধী দল অংশ নেবে কি নাÑ এসব জটিল প্রশ্ন মানুষের মাঝে ঘোরপাক খাচ্ছে। এসব পশ্নের কোনো উত্তর মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর থেকেই কেউ স্বস্তিতে নেই, না সরকার; না বিরোধী দল, না জনগণÑ সবাই একটা অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে পরিস্থিতি উত্তরণের যতটা আশা মানুষ করেছিল, তারা ততটা নিরাশ হয়েছে; বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণে পরিস্থিতির যদি উন্নতি হয়, তা হলে মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণের পর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়েছে। সুশীলসমাজ, গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের মানুষ বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছে; এটি ছিল দূরদর্শী ও রাষ্ট্রনায়োকোচিত ভাষণ। রাজনীতির নিজস্ব স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কারণে সরকারের সব ভালো কাজ মøান হয়ে গেছে। সামনের নির্বাচন নিয়ে সরকার এখন মহা সঙ্কটে পড়েছে। একতরফা নাকি সব দলকে নিয়ে, দলীয়-অন্তর্বর্তীকালীন নাকি সর্বদলীয় সরকারের অধীনে, সংসদ ভেঙে দিয়ে, না রেখে নির্বাচন করবেÑ এ বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিল না। এ অবস্থায় বিরোধী দলের নেতার ভাষণ সরকারকে একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছে। চলমান প্রোপটে একদলীয় নির্বাচন করা কোনোভাবেই যে সম্ভব নয়Ñ এটি সরকার অনুধাবন করতে পারছে। মতার একবারে শেষপর্যায়ে এসে সরকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। অনেক জেলায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, যেমনটা থাকেনি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের পর। ওই সময় বাংলাদেশের প্রায় ৪০টি জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও রাজশাহীসহ আরো অনেক জেলা বলতে গেলে বেশ কয়েক দিন রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওই সব জেলার সরকারদলীয় কর্মী তো বটেই, জেলা প্রশাসকরা পর্যন্ত তাদের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি পাটিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। বিরোধী জোট ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুললে, অন্তত ওই সব জেলায় একতরফা নির্বাচন করা দুরূহ ব্যাপার। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে সংলাপে বসতে চিঠি দেন দুই শীর্ষ নেত্রীকে। এর একদিন পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল দেখা করেন মতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের সাথে। তারাও রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে তাগিদ দেন শাসকদলকে। এর আগে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন সমঝোতায় পৌঁছতে দুই শীর্ষ নেত্রীর সাথে সরাসরি ফোনে কথা বলেন। চীন-ভারত-কানাডাসহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতরাও সঙ্কট সমাধানে দ্রুত সংলাপ শুরুর আহ্বান জানান। অন্য দিকে সুশীলসমাজ ও দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতায় পৌঁছতে চাপ অব্যাহত রেখেছেন। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে দেশে এক নজিরবিহীন জাতীয় ঐক্যের আবহ তৈরি হয়েছে। রাজনীতিবিদরা যদি রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করতে ব্যর্থ হন, তাহলে প্রাকৃতিক নিয়মেই রাজনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। সংবিধান মানুষের জন্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়; আজ সংবিধানের একেকজন একেক রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। বর্তমান মতাসীন দল যখন তত্ত্বাবধায়কের দাবি তুলেছিল তখন এটা অসাংবিধানিক দাবিই ছিল; এ দাবির জন্য হেন কোনো আন্দোলন নেই, যা বর্তমান মতাসীন দল করেনি। ১৭৩ দিন পর্যন্ত হরতাল করেছে, বাসে গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে; সরকারি কর্মচারীদের গায়ের কাপড় খুলে নেয়া হয়েছে। এরই একপর্যায়ে তৎকালীন বিএনপি সরকার এটাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু বর্তমান সরকার উচ্চ আদালতের মতামত, অ্যামিকাস কিউরি, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও সুশীলসমাজসহ সব মহলের দাবি উপো করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে এবং দেশে একটা রাজনৈতিক সঙ্কটেরও জন্ম দিয়েছে। এ সঙ্কট এখন প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে। দেশ এক বেদনাবহ ও অস্থির সময় অতিক্রম করছে। বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এককভাবে বলছেনÑ নির্বাচনের সময় ভূমিকা রাখবে তার মন্ত্রিপরিষদ। প্রশ্ন হলো, যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে সাংবিধানিক বা আইনগতভাবে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সেখানে কিভাবে ভূমিকা রাখবে মন্ত্রিপরিষদ? আর সংসদ বহাল থাকলে নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পে কতটুকু নিরপে থাকা সম্ভব হবে, তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। এতসব বিতর্কের মধ্যে একতরফা নির্বাচন সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে বুমেরাং হবে। দেশের রাজনীতিতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে, তার পুরোপুরি সুফল বিরোধী দলের ঘরে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে জনমত সংগঠিত হচ্ছে বিরোধী দলকে ঘিরে। নীরব সমর্থকরা সরব হতে শুরু করেছে। কার্যত দলের নীরব সমর্থকরা যখন সক্রিয় হয় এবং রাস্তায় নেমে আসে, ঠিক তখনই রাজনীতিতে গণবিস্ফোরণ বা গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী পরিবারের কোটি কোটি নীরব সমর্থক রয়েছে দেশে। নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অবিবেচনাপ্রসূত ঘোষণার পর নীরব সমর্থকরা এখন সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হচ্ছে। বিরোধী দলকে যেকোনো সহযোগিতা করতে তারা এখন প্রস্তুত। তারা কোনো নির্দেশের অপো করবে না, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তারা নিজে নিজেই নেতৃত্ব হাতে তুলে নেবেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ফলে দেশে-বিদেশে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হচ্ছে যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে পপাতহীন নির্বাচন দিতে সরকার ভয় পাচ্ছে। তাই সরকার কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। তারা যেনতেনভাবে দেশে একটি নির্বাচন করতে চায়। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন দিয়ে ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে এবং হামলা-মামলা-ভয়-ভীতি-আতঙ্ক সৃষ্টি করে একটি আঁতাতের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার মতায় যাওয়ার রঙিন স্বপ্নে শাসকদল এখন বিভোর। দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে পপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়; তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়, মানুষের এই আবেগের মূল্য মতাসীন দলকে অবশ্যই দিতে হবে। তা না হলে সরকার অনিবার্য জনরোষের সম্মুখীন হবে; করুণ পরিণতি সরকারকে ভোগ করতে হবে। বিরোধীদলীয় নেতা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনÑ সঙ্কট সমাধানে আলোচনার দ্বার তিনি খোলা রেখেছেন। তার কথায় মনে হচ্ছে, সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হলেও দেশের স্বার্থে তিনি সঙ্কটের একটা সমাধান চান। এখন সমঝোতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। সরকার এগিয়ে এলেই সমাধান দোরগোড়ায়। রাজনীতিবিদেরা যদি রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করতে ব্যর্থ হন, তাহলে সঙ্কটে পড়বে গণতন্ত্র। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads