রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৩

নির্বাচনবাদী গণতন্ত্র বনাম সাংবিধানিক গণতন্ত্র


বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়ার সংকট বা সমস্যাটা কোথায়? স্বাধীনতার কয়েক দশক পার হয়ে গেলেও এখনো প্রকৃত ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বা প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে যেই অশুভ রাজনৈতিক দলাদলি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি আমরা ধারণ করেছিলাম, সেটি আমাদের মাঝে ধারাবাহিকক্রমে অদ্যাবধি আরো প্রকটভাবে বিদ্যমান। প্রত্যেক সরকার মেয়াদপ্রান্তে এলেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী উভয় দলের বিভীষণ ক্ষমতার রাজনৈতিক লড়াইয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়ে যায় নৈরাজ্যকর ও ভীতিময় পরিস্থিতি। দেশ ও জনগণের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। গুজব, আতঙ্ক ও ভীতি সর্বত্র পাখা বিস্তার করে। সুতরাং এই অবস্থায় কেউ যদি বলেন যে, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম, জাতীয় ঐক্য, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবের কারণেই এই সংকট দেখা দিয়েছে তাহলে আমি বলবো, এই বিষয়গুলো অন্যতম কারণ হলেও বস্তুতপক্ষে প্রধান কারণটি হচ্ছে, আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতি সবসময়ই নির্বাচনবাদী বা নির্বাচনপন্থী হয়ে থেকেছে, তবে একদমই সংবিধানমুখী বা সাংবিধানিক হয়ে উঠতে পারেনি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, আমাদের বর্তমান সংবিধান কি একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার পক্ষে পুরোপুরি উপযোগী? কেননা বর্তমান শাসকগোষ্ঠী পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এমনভাবে সংবিধানের মৌলিক চারিত্রিক বদল ঘটিয়েছেÑযা রীতিমতো গণ-অধিকার ও গণতন্ত্র হরণকারী। এক কথায় এই সংবিধান ফ্যাসিজমের নির্যাসে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তক ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার এই পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের চরম গণতন্ত্রবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে লিখেছেন, ‘....জনগণ কেমন রাষ্ট্র চায় এবং তাদের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের যে অসঙ্গতি ও বৈরী চরিত্র সে সম্পর্কে কিছু বলার অধিকার এভাবেই হরণ করা হয়েছে। কিচ্ছু বলা যাবে না। সংবিধান নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণœ করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা করা নিষেধ, কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এই ধরনের ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে রেখে বর্তমান সরকার দেশ শাসন করছে’ (নির্বাচন নাকি গণতন্ত্র : নয়া দিগন্ত, ০৭ আগস্ট)। সুতরাং যেই সংবিধান নিজেই গণতন্ত্র ও গণ-অধিকার হরণকারী, সেই সংবিধান নিয়ে আর যা-ই হোক, সংবিধানমুখী সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা ও চর্চা এইদেশে গড়ে তোলা সুদূর পরাহত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে এই গণবিরোধী সংবিধানের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা যে থাকার কথা নয়- তা বর্তমান প্রেক্ষাপট তথা ক্ষমতাসীন দলের যাবতীয় কার্যাবলীই প্রমাণ করে। ফলত আমাদের বিরোধী ও ক্ষমতাসীন উভয় দলের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞ আদৌ সাংবিধানিক সভ্যতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণে কাক্সিক্ষত মাত্রায় সক্ষম হয়ে ওঠে নি।
তবে আমাদের এখানকার গণতান্ত্রিক কালচার হচ্ছে, ‘জোর যার মুল্লুক তার/সংবিধানের থোড়াই কেয়ার’। সুতরাং এই মুহূর্তে আমরা যদি শুধু নির্বাচনকে ঘিরেই গণতন্ত্রের চর্চা ও উন্নয়নের কথা বলি তাহলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান পূর্ণাঙ্গ কিংবা যথার্থ হবে না বলেই আমার ধারণা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু নির্বাচনই শেষ কথা নয়। আমরা এই মুহূর্তে অত্যাসন্ন দশম সংসদীয় নির্বাচন সম্পর্কে অর্থাৎ নির্বাচনী সরকার পদ্ধতি নিয়ে এত হৈ-হুল্লোড় করছি বটে, তার মানে আমরা আসন্ন দশম জাতীয় নির্বাচনের পর ভবিষ্যতে ধারাবাহিকক্রমে আগত জাতীয় নির্বাচনগুলোর সময়েও কি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনী সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এরূপ হৈ-হুল্লোড় করতে থাকবো? এটাই কি আমাদের নিয়তি? কিন্তু নির্বাচনী সরকার পদ্ধতি নিয়ে একটি যৌক্তিক ও পরিণত সমাধানের দিকে যেতে হলে আগে আমাদের গোড়ার মৌলিক সংস্কার ও গুণগত পরিবর্তন অনিবার্য। সে জন্যই আমি শুরুতে প্রশ্ন তুলেছিলাম, আমাদের বর্তমান সংবিধান প্রকৃত ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ভাবধারাসম্পন্ন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম কিনা। পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো, সময়ে অসময়ে সংবিধান পরিবর্তনের অপসংস্কৃতিও আমাদের মধ্যে প্রকট। যখন যে দল ক্ষমতায় আরোহণ করবে সেই দলই দেখা যায় তাদের স্বার্থের অনুকূলে ইচ্ছামতো সংবিধান পরিবর্তন করছে। এমনকি সংবিধান ও নিরঙ্কুশ সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে খেয়ালখুশি মতো যেনতেন আইন সংসদে পাসও করতে পারছে তারা। এক্ষেত্রে জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না তারা। তাদের হাতে সংবিধান প্রকারান্তরে কাটাছেঁড়ার খেলায় পরিণত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয়না। বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ উভয় দলই যার যার শ্রেণিস্বার্থের অনুকূলে সংবিধানের একেবারে ব্যবচ্ছেদ করে ছেড়েছে শেষ পর্যন্ত। অথচ সংবিধানের প্রকৃত চরিত্র ও গঠন এমন নয় যে, যার যার দলগত ও শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করার জন্য অনভিপ্রেত ও অযৌক্তিকভাবে যখন-তখন সংবিধানের পৌনঃপুনিক পরিবর্তন ঘটানো হবে।
সাধারণত সমাজ বা রাষ্ট্রের সর্বস্তরের গোষ্ঠী ও শ্রেণীর সম্যক অংশগ্রহণ তথা বহুবিধ দল-মতের সুষ্ঠু সমন্বয়ের ভিত্তিতেই সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধান পরিগঠিত হয়। সংবিধান বা গঠনতন্ত্র হলো রাষ্ট্রপরিচালনা বা রাজনীতির মূল কেন্দ্রকোরক। সংবিধান ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্রের কথা চিন্তাই করা যায় না। সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর একক অখন্ড রাজনৈতিক সত্তা ধারণ করবে সংবিধান। সংবিধান এমন হওয়াই বিধিসম্মত যে, জনগণের যাবতীয় শ্রেণিসংগ্রাম-চেতনা ও গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে সেখানে। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূল সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে ধারণপূর্বক অগ্রাধিকার দেয়ার পাশাপাশি সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও তাদের ধর্ম-বিশ্বাস-মূল্যবোধকেও শ্রদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করবে। এটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নিয়ম ও কালচার। কেননা গণতন্ত্রে ‘মেজরিটি মাস্ট বি গ্রান্টেড’ বলে একটি কথা প্রচলিত ও স্বীকৃত আছে। কিন্তু বাস্তবে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আমাদের রাষ্ট্রের প্রথম কনস্টিটিউশন অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধান থেকেই আমাদের বিপর্যয়ের সূচনা ঘটে। এখানে বিপর্যয় বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, সংবিধানপন্থী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য যথোপযোগী সংবিধান অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বস্তরের শ্রেণী ও গোষ্ঠীর সম্যক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে এবং আমাদের প্রকৃত জাতিসত্তার নিরিখে সম্পূর্ণ গণক্ষমতাসম্পন্ন একটি সংবিধান আমরা প্রণয়ন করতে সেই শুরু থেকেই ব্যর্থ হয়েছি। কেননা সূচনালগ্নেই আমাদের তৎকালীন শাসকবর্গ আমাদের এই জনপদের লোকাচার, জীবনাচরণ, চেতনা, মনন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ-বিশ্বাসকে গভীরভাবে অনুধাবন না করে এবং আমাদের জনমানসে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা দীর্ঘকালের ঔপনিবেশিক শাসনপ্রক্রিয়ার ধ্যান-ধারণাকে বহাল রেখেই- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মিশেলে রেটোরিক (জযবঃড়ৎরপ) ধরনের তথাকথিত আধুনিক কিন্তু এই তীব্র ধর্মপ্রাণ জনপদের সঙ্গে প্রায় অসঙ্গতিপূর্ণ একটি সংবিধান তথা বাহাত্তরের সংবিধান চেয়েছিল। গত ১০ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক ‘লিখনী’ সংখ্যায় বিতর্ক-বাহাস আয়োজনে বিপক্ষের পাল্টা যুক্তি হিসেবে শ্রদ্ধেয় গাজী আতাউর রহমান বাহাত্তরের সংবিধান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি।
সেই সংবিধানের পক্ষে কোনোদিন জনমত যাচাইও করা হয়নি। তাছাড়া ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ যেমন সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করেছিল তেমনি ১৯৭৫ সালে দেশে একটিমাত্র দল বাকশাল রেখে বাকি সব দল নিষিদ্ধ করেছিল সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে।’ অথচ আমরা সবসময়ই দেখেছি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও দলের প্রতি আমাদের দেশের সংখ্যাগুরু ধর্মপ্রাণ তৌহিদি মানুষের আবেগ ও সমর্থন নিরঙ্কুশ ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং জনমতের প্রতিকূলে এ ধরনের আকাশ-কুসুম ও বিতর্কিত সংবিধান প্রায় জোরপূর্বক এই দেশের গণমানুষের ঘাড়ের ওপর সেদিন চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ সেই সংবিধানকে রাষ্ট্র বা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও মানানসই করে তোলা সম্ভব হয়নি। শেষপর্যন্ত ৭২-এর সংবিধান এদেশের ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতা কর্তৃক চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। এমনকি কথিত মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্টের একমাত্র দাবিদার বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জনপ্রত্যাখ্যাত সেই বাহাত্তরের সংবিধানের পুনরুজ্জীবন (Resuscitation) ঘটানোর প্রবল খায়েশ পোষণ করলেও তাদের দলীয় সেই ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাইছে না বলেই আমার মনে হয় (যদিও আওয়ামী লীগের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া পরগাছা বামপন্থী বুদ্ধিজীবীগণ নানাভাবে প্ররোচিত ও প্রভাবিত করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে)।
যাই হোক, শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত নয়। সংবিধানের মর্যাদা ও অক্ষুণœতা যথাযথ রক্ষা করাও গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত। কেবলমাত্র সংবিধানমুখী গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই এটি রক্ষা করা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। তা নাহলে এদেশে গণতন্ত্র কখনোই ইতিবাচক ও উন্নয়নমূলক ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারবে না। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চর্চা একটি সফল ও সুসংহত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক বলে আমি মনে করি। কিন্তু তার আগের মূল কর্তব্য হলো, সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গতিশীল ও অব্যাহত রাখার জন্য যথোপযোগী অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিক এবং বিবদমান শ্রেণী ও গোষ্ঠীর সর্বোপরি বহুবিধ মত ও পথের সমন্বয়ে অবিসংবাদিত একটি সম্পূর্ণ গণক্ষমতাসম্পন্ন সংবিধান প্রণয়ন করাÑ যার অধীনে গণতন্ত্র অক্ষত ও প্রাণবন্ত থাকবে। সেই সংবিধান বর্তমান সমাজের চরম বিভাজক মেরুকরণ দূর করে গণসম্মিলন ও গণঐক্য গঠনপূর্বক জনগণের যাবতীয় গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামকে বৈধতা ও অনুপ্রেরণা দেবে। রাষ্ট্রশক্তিকে আইনগতভাবে বাধ্য করবে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে। সেই সংবিধানই সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ তথা ব্যাপক জনসমষ্টির গণতান্ত্রিক-নাগরিক-সাংবিধানিক অধিকার সুষ্ঠুরূপে সংরক্ষণ ও দাবি-দাওয়া পূরণের নিশ্চয়তা দেবে। গণশক্তির সুষ্ঠু বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সংবিধানই উল্টো জিম্মি হয়ে আছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তির করতলে। আগামী দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একপক্ষ সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে আবার অন্যপক্ষ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছে। রাষ্ট্রশক্তি তথা বর্তমান সরকার নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থের অনুকূলে কথিত আদালতের রায়ের মারফত সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বাতিল করে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন করার পক্ষে মরণপণ অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে অনড়। এছাড়া দেখা যাচ্ছে, একপক্ষ সংবিধানের বাইরে এসে আলোচনা করতে চাচ্ছেন, আবার আরেক পক্ষ স্বার্থের অনুকূলে সংবিধান সংশোধনপূর্বক সংবিধানানুযায়ী নির্বাচন করতে চান। কিন্তু সংবিধান যেমন কারো বাপের সম্পত্তি নয়, তেমনি সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো গুরুত্ব্পূর্ণ জাতীয় প্রশ্ন বা বিষয়ের মোকাবিলা আপাতত সাময়িক সুফল দিলেও নিশ্চিতভাবেই তা সুদূরপ্রসারী হবে না। মনে রাখতে হবে, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই সংবিধান। সুতরাং দল-মত নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে যেকোনো জাতীয় সমস্যা বা ইস্যুতেই হোক, পুনরায় সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তন বা সংস্কার ঘটিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করাই যথোচিত কর্তব্য বলে বিবেচিত হবে। অথচ সরকার সেই দিকে না গিয়ে এবং আলোচনার জন্য সুষ্ঠু ও আন্তরিক পরিবেশ সৃষ্টি না করেই বিরোধী দলকে রেটোরিক ধরনের আলোচনার আহ্বান জানানোর ফলে কোনো পক্ষেরই আলোচনার বন্ধ দুয়ার খুলছে না। ফলত দু’পক্ষের মাঝখানে পড়ে বেচারা সংবিধান আর্তনাদ করে ধুঁকছে। কিন্তু এভাবে সাংবিধানিক সংকট ও জটিলতা জিইয়ে রেখে কি সংবিধানমুখী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব? এতকাল পরেও কেন নির্বাচনের সময় এলে তাদের মধ্যে সংবিধান নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যায়? উভয় দলই তো পালাক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাহলে কেন তারা গণতন্ত্রকে শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক হিসেবে গড়ে না তুলে পুরোপুরি সংবিধানপন্থী হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করলেন না? তারা যার যার ক্ষমতার স্বার্থে ইচ্ছামতো সংবিধান পরিবর্তন করবেন আর গণতন্ত্রের বারোটা বাজাবেন এটা তো হতে পারে না। কিন্তু আমাদের শেষ গতিও যে তারাই। কেবলমাত্র তাদের ইতিবাচক ও আন্তরিক নীতিনির্ধারণী ভূমিকাই এইসব রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধান করতে পারে। তাই আমরা আশা করি, তারা অতিসত্বরই অন্ততপক্ষে জনগণের কল্যাণস্বার্থে হলেও আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আগামী দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সফল আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে সকল বিভেদ-বিরোধ অবসানপূর্বক মূল সমস্যার সুরাহা করে একটি স্বচ্ছ, সর্বজনগ্রাহ্য ও বিতর্কহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্মরণীয় ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads