মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

ত্যাগের মহিমায় জীবন অর্থবহ হয়ে উঠুক



আজ ১৬ অক্টোবর বুধবার পবিত্র ঈদুল আজহা। আমাদের কাছে যা ‘কোরবানির ঈদ’ হিসেবে পরিচিত। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম আ:-এর স্মৃতিবিজড়িত এই ঈদ আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল আ:কে আল্লাহর নির্দেশে কোরবানি দেয়ার জন্য আদিষ্ট হয়ে হজরত ইব্রাহিম আ: সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। পুত্র ইসমাইল আ: মেনে নেন আল্লাহর আদেশ। নিজেকে সঁপে দেন ধারালো ছুরির নিচে। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের এই পরম ত্যাগের প্রস্তুতিতে খুবই সন্তুষ্ট হন। আল্লাহ এই সন্তুষ্টির কারণেই সন্তানের পরিবর্তে পশু কোরবানির নির্দেশ দেন। মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর কোরবানির মাধ্যমে সে ঘটনা স্মরণ করে। পশু কোরবানির মাধ্যমে মূলত নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা পশুত্বকেও জবাই করে পরিশুদ্ধ হওয়ার শপথ গ্রহণ করা হয়। এই ত্যাগ বা কোরবানি আল্লাহর প্রতি বান্দার অকুণ্ঠ আনুগত্যের প্রকাশ। এর মাধ্যমে আল্লাহর রাহে ত্যাগের আনন্দে মুমিনের মন অনাবিল প্রশান্তি ও আনন্দে ভরে ওঠে। অর্থসম্পদ, বিত্তবৈভব মানুষকে সুকৃতির পথ থেকে বিচ্যুত করে। বিলাসী জীবনে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। একই সাথে অপব্যয়ী করে তোলে। তাই ইবাদতের অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর রাহে অর্থসম্পদ ব্যয় করা যেমন মৌলিক ইবাদতের অংশ, তেমনি সামর্থ্যবানদের অর্থ থেকে পশু কোরবানিও আল্লাহর পথে ব্যয়ের উৎকৃষ্ট পন্থা। ভোগের বিপরীতে ত্যাগই কোরবানির শিক্ষা। কোরবানির গোশতে স্বজন ও দরিদ্রদেরও শরিক করা হয়। এর চামড়ার মূল্য প্রকৃত হকদারদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। কোরবানি প্রদর্শনের বিষয় নয়, আভিজাত্য প্রকাশের উপায়ও নয়। হালাল রুজির শর্ত পূরণ না হলে গোশত খাওয়ার অর্থহীন উৎসব ছাড়া আর কোনো তাৎপর্য বহন করে না কোরবানি। আল্লাহর কাছে পশুর রক্ত এবং গোশত পৌঁছায় না। আল্লাহ গ্রহণ করেন বান্দার ত্যাগের অনুভূতি থেকে জন্ম নেয়া ঈমানকে। আজকাল কোরবানির মতো মহান ইবাদতও অনেকের কাছে নেহাত প্রদর্শনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি কোরবানির মতো পবিত্র বিষয়কে বিতর্কিত করার মতো প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। ইবাদতের অনুভূতিতাড়িত ত্যাগের আনন্দকে ‘নিষ্ঠুরতার মহড়া’ বলেও ধর্মবিদ্বেষী মহলবিশেষ প্রচারণা চালাচ্ছে। অথচ কোরবানির ধর্মীয় গুরুত্ব যেমন অনন্য, তেমনি এর আর্থিক ও সামাজিক কল্যাণ ও গুরুত্বও অপরিসীম। দরিদ্র মানুষের প্রোটিনের অভাব ঘুচানো, গরিব এতিমদের মুখে হাসি ফোটানো এবং জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গতি সঞ্চারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে কোরবানির মধ্য দিয়ে সাধিত হয়ে থাকে, তা কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। কোরবানিকে ঘিরে পশুপালন, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা ও বিপণন এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। কোরবানি আসে হিংসা, বিদ্বেষ ও পশুত্বকে জবাই করার মহান প্রেরণা নিয়ে এবং আল্লাহর প্রতি চরম আনুগত্য প্রকাশের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য। সেই সাথে মানুষের মধ্যে সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই কোরবানির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন এবং কুরআন সুন্নাহ অনুসরণ করে এই উৎসব পালন করার মধ্যেই সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিতে ত্যাগের পরিবর্তে ভোগ ও লুণ্ঠন, ক্ষমার পরিবর্তে প্রতিহিংসা, সাম্যের পরিবর্তে বৈষম্য, হৃদ্যতার পরিবর্তে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। পবিত্র ঈদুল আজহা আমাদের জীবনকে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত করুক এবং সব ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রেরণা জাগ্রত করুক। মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা পশুত্ব তথা মনুষ্যত্বহীনতাকে ধ্বংস করে দিক। জুলুম-অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা আর দুর্বিষহ জীবনের গ্লানি মুছে দিক। এটাই হোক সবার ঐকান্তিক কামনা। ঈদের আনন্দ আমাদের জাতীয় জীবনে যাবতীয় অন্যায় ও অসদাচরণকে দূর করে দেবে বলেই প্রত্যাশা। সবাইকে পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads