সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

বেগম জিয়ার প্রস্তাব অবশ্যই গ্রহণযোগ্য


বেগম জিয়া নির্দলীয় সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, এর নানা ধরনের অপব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছেÑ এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়, এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়, এটি যথেষ্ট পরীা-নিরীা ছাড়াই দেয়া হয়েছে ইত্যাদি। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার যখন এ প্রস্তাবটি সংসদে উপস্থাপন করেন আশা করা হয়েছিল সরকার এ বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শুরু করবে; কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। সরকারি দলের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ পয়েন্ট অব অর্ডারে ফোর নিয়ে এ প্রস্তাবের তুলোধুনো করে প্রস্তাবটিকে অসাংবিধানিক ও অবাস্তব বলে মত দেন। তিনি বলেন, ৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে মৃত ও অসুস্থ বাদ দিলে বাকি থাকে মাত্র ১০ জন। এ ১০ জনের মধ্যে দুজন অস্বীকৃতি জানানোয় আটজন বাকি থাকে। তা ছাড়া এ দুই সরকারের উপদেষ্টারা নিরপে নন বলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ থেকে অভিযোগ আছে। তিনি সংসদে পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে তার মতামত তুলে ধরেন। আরো দুজন সংসদ সদস্য বেগম জিয়ার প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে একে অবাস্তব বলে মত দেন। একজন সদস্য ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে কটা করে বক্তব্য শুরু করলে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে। নির্দলীয় সরকারের দাবি ও আন্দোলন ২০১১ সাল থেকে শুরু। পঞ্চদশ সংশোধনী এনে আওয়ামী লীগ সরকার সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে মতায় ফেরার কূটকৌশল হিসেবে সংশোধনীটি সংবিধানে আনে। বিরোধী দল এতে প্রচণ্ড আপত্তি তুলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। দীর্ঘ সময় ধরে নির্দলীয় সরকার প্রবর্তনে বিরোধী দল রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। এরা সরকারকে সময় দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। সরকার প্রথম থেকে অগণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করতে বদ্ধপরিকর। বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ সরকারের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে নাস্তানাবুদ হতে থাকে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর ওপর মামলা, হামলা, দমন-পীড়ন চলতে থাকে। এক দিকে বিরোধী দল দমনে সরকার খড়গহস্ত অন্য দিকে বলা হচ্ছে তারা কী চায় স্পষ্ট করে বলছে না। এরা কোনো রূপরেখা দেয়নি। রাস্তায় আন্দোলন না করে সংসদে এসে দাবি-দাওয়া পেশ করুন ইত্যাদি। এরূপ মনোভাব অবশ্য দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহল থেকেও পোষণ করা হয়েছে। সংসদে প্রস্তাব দিলেই যেন সরকার লুফে নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করবে। ১৮ দলীয় নেতৃবৃন্দ অবশ্য সরকারের চাতুর্য ও অপকৌশল আগে থেকে আঁচ করতে পেরে নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এরা জানতেন সরকার নানা কৌশলে দেয়া রূপরেখাটির অসারতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবে। অবশ্য তাই ঘটে গেল। বেগম জিয়া রূপরেখা দেয়ার সাথে এটিকে অসাংবিধানিক, অবাস্তব ও অবাস্তবায়নযোগ্য বলে নানা দিক থেকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। গত ২৩ অক্টোবর সংসদে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর আগে বিএনপি মহাসচিব আওয়ামী লীগ মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। আওয়ামী মহাসচিব চিঠি প্রাপ্তি স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ করে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার সংবাদ নেই। সবার মনে আশার সঞ্চার হয়। জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো দুই মহাসচিবকে টেলিফোনে ধন্যবাদ দিয়ে আলোচনা শুরুর তাগিদ দেন। সারা দুনিয়ার মানুষ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেণ করে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এড়ানোর ল্েয সংলাপের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের তরফ থেকে নির্বিকার থেকে সন্ত্রাস-সংঘর্ষকে যেন আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতো বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক, চীন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র সাধারণত কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। বিশ্বব্যাংকের ঢাকার প্রধান জোহানেস জাট গত ২৩ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অবাধ, নিরপে ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে মতা হস্তান্তর চায় বিশ্বব্যাংক। বেগম জিয়া ১৯৯৬ ও ২০০১ সময়কালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে ১০ সদস্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এদের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন, চারজন অসুস্থ। বাকি ১০ জন নিয়ে সরকার গঠন করলে কোনো অসুবিধা নেই। বলা হচ্ছে দুইজন উপদেষ্টা দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আমাদের কথা হলো তারা এ দেশের নাগরিক, এ দেশের হালহকিকত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সর্বোপরি গরিব জনগণের জানমালের তির আশঙ্কা ইত্যাদি সম্পর্কে তারা নিশ্চয় অবগত আছেন। দেশের ও জনগণের স্বার্থে তাদের অনুরোধ জানালে তারা কিছুতেই অসম্মত হতে পারবেন না। তারা জানেন এ দাবি না মানলে বিরোধী দল কিছুতেই নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সর্বশক্তি নিয়ে বিরোধী দল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তা ছাড়া যদি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা রাজি না হন সে েেত্র দেশের সুধীজনের মধ্য থেকে নিরপে দু-একজনের অভাব হবে না। সব মিলে ১০ জনের প্যানেল করে সর্বসম্মতভাবে একটি পথ বের করে তাদের শপথ পড়াতে হবে। তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান করে নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তারাই ঠিক করে নেবেন। এতে কেটে যাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বয়ে যাবে শান্তির সুবাতাস। কেটে যাবে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে। বেগম জিয়ার প্রস্তাবটি এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রত্যাশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তার প্রস্তাব নির্দলীয় নিরপে সরকারের রূপরেখা যাকে মডেল হিসেবে ধরে আলোচনা শুরু করা যায়। তার মডেলটি হুবহু মানতে হবে এমন কোন কথা নেই। সংবিধানের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। নিজেদের সুপ্ত ও দুরভিসন্ধিমূলক আকাক্সা বাস্তবায়নের ল্েয সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানের অজুহাত দাঁড় করানো অযৌক্তিক ও অন্যায়। এটি জনগণের সাথে প্রতারণা ও বেঈমানির শামিল। এ সম্পর্কে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য ও সমালোচনা করেছেন। বেগম জিয়ার প্রস্তাব মেনে নিলে সংবিধানে সামান্য একটু সংশোধন দরকার হবে। এটুকু সংশোধনী জাতীয় স্বার্থে করা যেতে পারে। সংসদ চলছে। চলমান সংসদে একটু সংযোজনী আনলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। সংবিধান মানুষের জন্য মানুষ সংবিধানের জন্য নয়। মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে জীবন ও সম্পদহানি প্রতিরোধ করতে, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির স্বার্থে, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য বন্ধ করতে ও শিাব্যবস্থা সচল রাখতে কার্যকর পদপে নেয়া সরকারের দায়িত্ব। শান্তিপূর্ণ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি। বাংলাদেশের উন্নয়নসহযোগী বন্ধুরাষ্ট্রগুলো, জাতিসঙ্ঘ, ইইউ, ওআইসি একাধিকবার বাংলাদেশ সরকারকে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছে। সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসনযন্ত্র ও পেশিশক্তির জোরে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে মতায় ফেরার কূটকৌশল অবলম্বন করায় মানুষ হতাশ। ২১ অক্টোবর বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপরেখা দেন এটি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত একে ঐতিহাসিক বলে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ব্রিটেন ও কানাডা হাইকমিশনার বেগম জিয়ার রূপরেখাকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিশ্বের এত মতাধর রাষ্ট্্র, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার আগ্রহ ও তাগিদকে উপো করার সুযোগ নেই। সরকারের ভ্রান্তনীতি ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ দুর্নাম কুড়িয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু গিলে খেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশে বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ও হবে। জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ পুলিশ ও সেনা পাঠিয়ে শত শত কোটি ডলার আয় করছে। এসব উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বিবেচনা করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ইচ্ছা, আগ্রহ ও তাগিদকে অগ্রাহ্য করা সমীচীন হবে না। তাদের বিরাগভাজন হওয়ার অর্থ উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের মতো গরিব ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য জাতিসঙ্ঘ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বব্যাংক। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, মুসলিম দেশগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নসহযোগী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটকে অবশ্যই রাজনীতিকদেরই সমাধান করতে হবে। এ েেত্র সরকারের দায় বেশি। টালবাহানা করে অনেক সময় ব্যয় করা হয়েছে। সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের দাবির যৌক্তিকতা ইতোমধ্যে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মহলের সাথে আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, পেশাজীবী সংগঠনগুলো এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের প্রত্যাশা ও আদালতের পর্যবেণ দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে ঐকমত্য পোষণ করেছে। এ দাবি মানতেই হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগে কার্যকর পদপে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের তরফ থেকে প্রস্তাব আসা উচিত ছিল অথচ বিরোধী দল আলোচনার প্রস্তাব দেয়ায় তাদের উদারতা ও মহানুভবতা প্রকাশ পেয়েছে। ইতোমধ্যে গত ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্র থেকে ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর তিন দিনের টানা হরতাল আহ্বান করেছে। সংলাপ আয়োজনের এখনই সময়। বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবিত রূপরেখা নিয়ে সংলাপ শুরু করা যায়। সদিচ্ছা নিয়ে সংলাপ শুরু করলে সমাধান অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। শুভ ইচ্ছা পরিচালিত কর্মকাণ্ডের ফলাফল কখনোই অশুভ হতে পারে না। রাজনীতিকদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও গণমানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads